একটা যুগের সমাপ্তি! বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান তিনি। তামিম ইকবালের বিদায়ের মুহূর্তে এমন কিছু বলবেন অনেকেই। ১৬ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ১৫ হাজারের বেশি রান, বর্ণাঢ্য এক ক্যারিয়ারই তার। কিন্তু যে ক্রিকেট তারকা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলার সঙ্গে সঙ্গে দেশের ক্রিকেটের একটা যুগ শেষ হলো, তার সেই বিদায়ের মুহূর্তে একটা আক্ষেপ থেকেই যাচ্ছে—মাঠ থেকে হলো না তামিমের শেষটা।
চট্টগ্রামের এক হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে অশ্রুসজল ছিলেন তামিম। সংবাদকর্মীদের ভিড়, ফটো সাংবাদিকদের ক্যামেরার ক্লিকের মধ্যে আটকে আসছিল তার গলার স্বর। নিজেকে সামলে নিয়েই যা বলার, বললেন। অনুচ্চারে সেই আক্ষেপটাও কি থেকে গেল না তার চোখেমুখে! মাঠ থেকে বিদায় নেওয়ার স্বপ্নটা যে থাকে সব ক্রীড়াবিদেরই।
এমন সংস্কৃতিটাই যে সেভাবে নেই বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে। একসময় দেশের অনেক শীর্ষ ফুটবল তারকাদের কেউ কেউ মাঠে দাঁড়িয়ে বিদায় নিতে পেরেছেন। সতীর্থ কিংবা প্রতিপক্ষের কাছ থেকে পেয়েছেন বিদায়ী সংবর্ধনা। তবে সেগুলো ঘরোয়া ম্যাচে। আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে বিদায় নিতে পেরেছেন, এমন উদাহরণ নেই বললেই চলে। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাহমুদ সেটা পেরেছেন। সেবার বগুড়ায় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজের শেষ ম্যাচের আগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন খালেদ মাহমুদ। কিন্তু বাকিরা? মাশরাফি বিন মুর্তজা অবশ্য ২০২০ সালে বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়কত্ব ছেড়েছিলেন মাঠ থেকে।
একদিক দিয়ে তামিম ভাগ্যবান। তিনি নিজের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচটি খেলেছেন নিজের শহর চট্টগ্রামে। ২০১৩ সালের নভেম্বরে নিজের মাঠ মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে জীবনের শেষ টেস্টটি খেলেছিলেন কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকার। ভারতীয় ক্রিকেটের এই গ্রেটকে বিদায় জানানো হয়েছিল বিপুল সংবর্ধনা দিয়ে। সেটি তার প্রাপ্যই ছিল। কী চমৎকার একটা বক্তব্য দিয়েছিলেন তিনি ওয়াংখেড়ের হাজারো দর্শকের সামনে। সেই বক্তব্যের সময় আবেগতাড়িত ছিলেন টেন্ডুলকার, ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন ভক্ত-সমর্থকেরা। একজন ক্রীড়াবিদের জীবনে এর চেয়ে বড় সম্মান আর কী হতে পারে!
শ্রীলঙ্কান গ্রেট কুমার সাঙ্গাকারাও নিজের শহর কলম্বোতে টেন্ডুলকারের মতোই সংবর্ধনা পেয়ে বিদায় নিয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ তার সেরা ক্রীড়াবিদদের এমন বিদায় দিতে পারল না, এই আক্ষেপের শেষ হবে কবে!
বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে তামিমের অবস্থান অবশ্যই আলাদা। ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে পোর্ট অব স্পেনের সেই ম্যাচটি কেউ ভুলতে পারবেন না কখনোই। ছটফটে এক তরুণ সেদিন কি কাণ্ডটাই না করেছিলেন। উইকেটের চারদিকে আছড়ে ফেলছিলেন ভারতীয় বোলারদের। ফিফটি করেছিলেন। খুব বেশি বল খেলেননি, কিন্তু যতক্ষণ উইকেটে ছিলেন, বিপুল বিক্রমেই খেলেছেন। জহির খানকে গ্র্যান্ড স্ট্যান্ডে আছড়ে ফেলা সেই ছক্কাটা তো এ দেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে দুর্দান্ত এক দৃশ্যই হয়ে আছে। তামিমকে দিয়েই সেদিন বাংলাদেশের ক্রিকেট ঘোষণা দিয়েছিল নতুন দিনের।
পরের ১৬ বছর কত কীর্তি ব্যাট থেকে। লর্ডসে সেঞ্চুরি করে অনার্স বোর্ডে নাম লেখানো। পরের টেস্টেই ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে আবারও সেঞ্চুরি। খুলনায় টেস্টে পাকিস্তানের বিপক্ষে ডাবল সেঞ্চুরি, ভারতের বিপক্ষে মিরপুর টেস্টে ১৫১ রান— এসব দৃশ্য মনে করার পাশাপাশি তামিমের ক্যারিয়ারের সংখ্যাগুলোই বলে দিচ্ছে, এ দেশের ক্রিকেটে কতটা, কী ছিলেন তিনি।
তামিমের আগে বাংলাদেশের ক্রিকেটের অবস্থান বিবেচনায় অনেক বড় বড় নামই এসেছে। গাজী আশরাফ হোসেন, জাহিদ রাজ্জাক, গোলাম নওশের, ফারুক আহমেদ, মিনহাজুল আবেদীন, এনামুল হক, আমিনুল ইসলাম, আকরাম খান, খালেদ মাসুদ, মোহাম্মদ রফিক, হাবিবুল বাশার—সবাই বিদায় নিয়েছেন মাঠের বাইরে থেকেই। সেই আক্ষেপের সঙ্গে আরও একটি নাম যোগ হলো—তামিম ইকবাল।