একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি মোহাম্মদ রফিকের চিরবিদায়

নিজস্ব প্রতিবেদক

না ফেরার দেশে চলে গেলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা কবি মোহাম্মদ রফিক (৮০)। উন্নত চিকিৎসার জন্য বরিশাল থেকে ঢাকা নেওয়ার পথে রোববার (৬ আগস্ট) রাত ৯টার দিকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

পরিবার সূত্র জানায়, নিজের গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের চিতলীতে অবস্থানকালে রোববার সকালে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন কবি মোহাম্মদ রফিক। তাকে প্রথমে বাগেরহাট এবং পরে বরিশাল নেওয়া হয়। বরিশালের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে বিভিন্ন পরীক্ষার পর বেশকিছু শারীরিক জটিলতা ধরা পড়লে চিকিৎসকরা তাকে ঢাকায় নেওয়ার পরামর্শ দেন। সন্ধ্যায় পরিবারের সদস্যরা কবিকে নিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় রওয়ানা দেন। ঢাকায় নেওয়ার পথেই তিনি মারা যান।

১৯৪৩ সালে বাগেরহাট জেলার বৈটপুরে জন্ম নেওয়া মোহাম্মদ রফিকের বাবা সামছুদ্দীন আহমদ এবং মা রেশাতুন নাহার। তাদের আট সন্তানের মধ্যে রফিক ছিলেন সবার বড়। তার ভাইদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক অর্থ সচিব মোহাম্মদ তারেক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মোহাম্মদ নাসের। তিনি দুই ছেলেসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

মোহাম্মদ রফিকের শৈশব কাটে বাগেরহাটে; ম্যাট্রিক পাস করে তিনি ঢাকায় আসেন, ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন ঢাকা কলেজ থেকে। বিএ পাসের পর ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে এমএ ডিগ্রি নেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই মোহাম্মদ রফিকের কবি প্রতিভার বিকাশ ঘটে। এসময় তিনি পাকিস্তানের সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হন। তখন সামরিক আদালতে তাকে কারাদণ্ডও দেওয়া হয়েছিল। স্বাধীন দেশেও পরে তিনি সামরিক শাসকের রোষের শিকার হয়েছিলেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন মোহাম্মদ রফিক, স্বাধীন বাংলা বেতারেও তিনি কাজ করেন।

স্বাধীনতার পর বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা শেষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে যোগ দেন রফিক। ২০০৯ সালে তিনি অবসরে যান।

মননশীল আধুনিক কবি হিসাবে পরিচিত রফিক আলোচিত হয়ে আছেন গত শতকের আশির দশকে সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের রিরাগভাজন হয়ে।

এরশাদকে নিয়ে তিনি লিখেছিলেন ‘খোলা কবিতা’ নামে আলোড়ন তোলা কবিতা, যার কয়েকটি পঙক্তি ছিল এমন- ‘সব শালা কবি হবে, পিঁপড়ে গোঁ ধরেছে উড়বেই, দাঁতাল শুয়োর এসে রাজাসনে বসবেই’।

এই কবিতা তখন কেউ ছাপাতে সাহস পায়নি। গোপনে তা ছাপানো হয় এক ছাপাখানায়। নিউজপ্রিন্টে এক ফর্মায় ছাপানো সেই কবিতা গোপনে বিলি করেন মোহাম্মদ রফিকের ছাত্র-ছাত্রীরা। এভাবে হাতে হাতে সেই কবিতা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।

এরশাদবিরোধী আন্দোলনে কাব্যিক রসদ জুগিয়ে তোলা এই কবিতার জন্য মোহাম্মদ রফিককে সেনানিবাসে ডেকে নেওয়া হয়েছিল। তার নামে হুলিয়াও জারি হয়। তাকে কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছিল।

মোহাম্মদ রফিকের প্রথম কাব্যগ্রন্থ বৈশাখী পূর্ণিমা প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে। তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- ধুলোর সংসারে এই মাটি, কীর্তিনাশা, কপিলা, স্বদেশী নিঃশ্বাস তুমিময়,

মৎস্যগন্ধা, বিষখালী সন্ধ্যা, কালাপানি, নোনাঝাউ, ত্রয়ী, চিরহরিতের উপবাস।

এছাড়া বেশ কিছু গদ্য ও আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থও লিখেছেন তিনি।

মোহাম্মদ রফিক ২০১০ সালে ভাষা ও সাহিত্যে একুশে পদকে ভূষিত হন। তার আগে ১৯৮৬ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলেন। এছাড়া নানা পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত তিনি।

শেয়ার করুন