বঙ্গবন্ধু সার্বজনীন, কারও দলীয় সম্পত্তি নয়: মোকতাদির চৌধুরী

মোহাম্মদ সজিবুল হুদা

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর ও বিজয়নগর) আসনের সংসদ সদস্য যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী বলেছেন, সকলকেই এটা জানা দরকার- বাংলাদেশটা কারও পৈতৃক সম্পত্তি নয়। লুটের টাকা দিয়ে লন্ডনে বসে বসে সুখের জীবনযাপন করবেন এটার জন্য বাংলাদেশ নয়। বঙ্গবন্ধু কারও পারিবারিক সম্পত্তিও নয়, এমনকি কারও দলীয় সম্পত্তিও নয়। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপিতা। তিনি সার্বজনীন। আপনি যখন জাতির পিতা বলবেন, তখন তিনি খালেদা জিয়ারও জাতির পিতা; খালেদা জিয়া এই কথাটি যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে তত দ্রুত সংঘাত কমে যাবে। যারা এখনও পাকিস্তানের মুসলিম লীগের রাজনীতি থেকে বের হতে পারছে না, তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

১৩ আগস্ট (রোববার) দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গনে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের মাসব্যাপী কর্মসূচির অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধু পরিষদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখা আয়োজিত জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন বিষয়ে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

মোকতাদির চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধুর যে একটি সার্বজনীন গ্রহণ যোগ্যতা আছে এই কথাটি আমরা কখনো আমাদের কার্যকলাপের দ্বারা মানতে চাই না। যত পারি আমরা, এটা পৈতৃক সম্পত্তির মতো ব্যবহার করি। যেমনিভাবে স্বাধীনতা অনেকের জন্য একটা সুন্দর সুযোগ এনে দিয়েছে লুটপাট করে নিজেদের সম্পদ গড়ার। তেমনিভাবে অনেকে বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করে, বঙ্গবন্ধুকে নিজেদের পৈতৃক সম্পত্তি হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের পাল্লা ভারী করার জন্য সুযোগ এনে দিয়েছে।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শুধু রাজনীতির বিষয় নয়, বঙ্গবন্ধু সামগ্রিক অর্থেই বাংলাদেশ। এখানে রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, ইতিহাস, ভূগোল অনেক কিছু আছে, সব মিলিয়েই বঙ্গবন্ধু।

জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, আমি বঙ্গবন্ধুর দর্শনকে একভাবে দেখি। সেটা- বঙ্গবন্ধু একজন মানুষ ছিলেন এবং তিনি একটি মানবিক দেশ গঠন করতে চেয়েছিলেন। তাঁর জীবন চরিতও মানবিক ছিল। তাঁর তিনটি গ্রন্থে (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারে রোজনামচা ও আমার দেখা নয়াচীন) এই চিত্রটিই পাওয়া যায়। সেখানে অর্থনীতি ও রাজনীতির চেয়ে মানবিক দর্শনের দিকটি সবচেয়ে বেশি উচ্চকিত। তাঁর বক্তৃতাগুলোতেও দেখা যায়, তিনি মানুষকে প্রতিপাদ্য করেছেন। কারণ তাঁর রাজনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি, এমনকি তাঁর ধর্মীয় চেতনাবোধও ছিল মানুষকে ঘিরে।

প্রবীণ এই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, বাংলাদেশে কিন্তু বহু রাজনীতিবিদ ছিলেন, বঙ্গবন্ধুর সমসাময়িক অনেক রাজনীতিবিদকে অনেকে তাঁর চেয়ে উঁচু রাজনীতিক মনে করেন, যেমন শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, এমনকি তাঁর গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকেও অনেকে বড় রাজনীতিবিদ মনে করেন, তাঁর আরও মেন্টর মাওলানা ভাসানীকেও অনেকে বড় রাজনীতিবিদ মনে করেন। কিন্তু যখন পাকিস্তানে রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, তখন সক্রিয় রাজনীতিবিদদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু-ই রবীন্দ্র সঙ্গীতের পক্ষে জাস্টিস মুর্শেদদেরকে নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।

পঁচাত্তরের প্রতিরোধ যোদ্ধা মোকতাদির চৌধুরী বলেন, যখন আদমজীতে বাঙালি ও অবাঙালিদের মধ্যে দাঙ্গা সংঘটিত হয় তখন বঙ্গবন্ধু নির্যাতিতদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৬২ সালে যখন হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা সংঘটিত হয় আমিরুল ইসলাম চৌধুরী নামে যে বিখ্যাত মানুষ আত্মদান করেছিলেন মানুষের অধিকার রক্ষা করার জন্য, সেই সময় রাজনীতিবিদে পূর্ব বাংলা ভরপুর ছিল; কিন্তু সরব রাজনীতিবিদ ছিলেন একজন, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু বাকশাল করতে চাননি। কিন্তু তিনি বাকশাল করেছিলেন, এটি সত্য কথা। তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র পরিহার করতে চাননি, কিন্তু তাকে একদলীয় গণতন্ত্র চালু করতে হয়েছিল। কেন করতে হয়েছিল? বাকশাল গঠনের সময় তিনি জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে যে ভাষণ দিয়ে ছিলেন আপনারা সেটা দেখবেন। সেখানে কী দরদ, ভালোবাসা, কমিটমেন্ট ছিল। সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই, এই কমিটমেন্ট থেকেই তিনি দেখলেন বহুদলীয় গণতন্ত্র আমার সমাজটাকে এমন একটি জায়গায় পৌঁছে দিচ্ছে, যেখানে মানুষের দাঁড়াবার মতো জায়গা নেই। তখন বিশ্বব্যাপী, তৃতীয় দুনিয়া বলে পরিচিত যে দেশগুলো ছিল, তাদের মধ্যে ওয়েলফেয়ার স্টেট গঠনের একটি ট্রেন্ড চলছিল। জুলিয়াস নায়ার যেটি তানজানিয়ায় করেছিলেন। আরবদের মধ্যে ইউনাইটেড আরব রিপাবলিক গঠন করেছিলেন নাসের। এমনকি বাশার আল আসাদের পিতা হাফেজ আল আসাদও এক্সপেরিমেন্ট করেছেন কীভাবে একটি ওয়েলফেয়ার স্টেট গঠন করা যায়, যেখানে মানুষকে প্রধান্য দেওয়া হবে।

বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদ আরও বলেন, আপনারা জানেন পাকিস্তান আমলে বাইশ পরিবার ছিল। বঙ্গবন্ধু এই বাইশ পরিবারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। দুর্ভাগ্যবশত এখন আমাদের আছে বাইশ হাজার পরিবার। যারা বাংলাদেশকে শোষণ করছে। বঙ্গবন্ধু এটি চাননি। তিনি এটি চাননি বলেই- যে বহুদলীয় গণতান্ত্রিকতার সুযোগ নিয়ে এই লুটেরা ধনিক শ্রেণি মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছিলো এবং নিজেদের পুঁজি গঠনের প্রক্রিয়ায় লিপ্ত ছিল তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতেই তিনি সেদিন বাকশাল গঠন করেছিলেন।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু যারা হত্যা করেছিলো, আমরা তাদের কয়জনের নাম জানি? গুটিকয়েক লোকের নাম জানি। কিন্তু আওয়ামী লীগের একটি বিরাট অংশ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিল। যেজন্য আমরা যারা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড কখনোই মেনে নিতে পারিনি, তারা বহুদিন ধরে বলে আসছি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের কুশীলবদের খুঁজে বের করার জন্য একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হোক। যেখানে ওঠে আসবে কারা ষড়যন্ত্রকারী। কী ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল? সেটা কিন্তু হচ্ছে না। মৌখিকভাবে বলা হচ্ছে। এমনকি জননেত্রী শেখ হাসিনার সময়ে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে। সেখানে আপনি দেখবেন সব সামরিক কুলাঙ্গারদের ফাঁসি হয়েছে কিন্তু সিভিলিয়ানদের কারও ফাঁসি হয়নি। তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে তো খালাসই দেওয়া হয়েছিল। অথচ এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিল খন্দকার মোশতাক, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, ছাত্রলীগের একসময়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী সভাপতি শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, কে এম ওবায়দুর রহমান, ছাত্রলীগের বিশাল বড় নেতা নুরুল ইসলাম মঞ্জু; কে ছিল না? অনেকে ঐসময়ের প্রতিরক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম চৌধুরীর কথাও বলে থাকেন। বিচার হয়নি তাদের। বিভিন্ন ফাঁকফোকরে তারা বেরিয়ে গিয়েছিলেন।

মোকতাদির চৌধুরী বলেন, কেননা আওয়ামী লীগের একটি শক্তিশালী অংশ বিশ্বাস করত, পাকিস্তানটা ভেঙে দেওয়া দরকার এজন্য যে, আমাদেরকে বাইশ পরিবার হতে হবে। সেজন্য তারা পাকিস্তানকে ভাঙার ক্ষেত্রে শেখ মুজিবুর রহমানের যে আন্দোলন-সংগ্রাম সেটার জন্য একমত হয়েছিল এবং তারা সাথে ছিল। কারণ পাকিস্তানকে ভাঙার ক্ষেত্রে যারা একমত হতে পারেনি তারা কিন্তু আওয়ামী লীগ ছেড়ে অন্য দল করেছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বঙ্গবন্ধুর পক্ষের বড় বড় দু’জন আইনজীবী তারাও কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বিপক্ষে ছিলেন এবং পরবর্তীতে বিপক্ষে দাঁড়িয়ে ছিলেন; একজন সালাম খান অন্যজন জহির উদ্দিন। এই বিষয়গুলো কিন্তু অনুধাবন করা প্রয়োজন।

তিনি বলেন, অনুধাবনের বিষয় আছে যে আমরা কোথায় চলেছি। ধর্মের বিরুদ্ধে আমরা নয়, কিন্তু ধর্মানুভুতির নামে আমরা চলেছি। যারা আমাদেরকে নিয়ে কটাক্ষ করতে চাই যে, আমরা ধর্মানুভুতিতে আঘাত করি, আসলে তারাই কী ধর্মানুভুতিতে আছেন? তারা যে ধর্মের কথা বলেন, সেই ইসলাম ধর্ম কিন্তু মানবিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে নয়। অথচ তারা এমন একটি ইসলাম আপনার সামনে নিয়ে আসবে যে ইসলাম, মানুষকে মানুষই মনে করে না। স্বাধীনতায় তারা বিশ্বাস করে না। অথচ আমরা অনেকেই তাদের সঙ্গে আমরা রাজনীতি করতে চাই। এই ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেই অনেকে আছেন, আমি নাম ধরে বলতে পারব। আমি যে সংগঠনটির সঙ্গে জড়িত, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখা; আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি সেই জেলা শাখার অন্তর্ভুক্ত অনেক নেতা আছেন- যারা স্বাধীনতা বিরোধীদের গাঁটছাড়া বাঁধতে চান। তাহলে কোথায় আছি আমরা?

মোকতাদির চৌধুরী বলেন, কারা এই স্বাধীনতা বিরোধী? চিহ্নিত করা খুবই সহজ। ওমুক মাওলানা, তমুক মাওলানা এরকম নাম বলাও দরকার নেই। শুধু জিজ্ঞেস করবেন, ভাই আপনি কী জাতীয় সঙ্গীত গান? আপনি কী আপনার প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা ওঠান? আপনি কী একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করেন? আপনি কী পহেলা বৈশাখ পালন করেন? তাহলেই বেরিয়ে যাবে কে স্বাধীনতার পক্ষে আর কে স্বাধীনতার বিপক্ষে।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শন কী? একটি মানবিক জীবন দর্শন। তিনি মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। ধনী-দরিদ্র, হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান এ হিসেবে দেখতে চান নাই। আমরা সকলে যদি বঙ্গবন্ধুর এই আদর্শটাকে লালন করতে পারি, তাহলেও তো একটু কাছে যেতে পারি।

তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু যে বাইশ পরিবারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। ঐ বাইশ পরিবারের বিরুদ্ধে কী তাঁর কোনো ব্যক্তিগত আক্রোশ ছিল? না। কিন্তু বাইশ পরিবারের বিরুদ্ধে তিনি লড়াই করেছিলেন কেন? এজন্য যে, এই বাইশ পরিবার বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে শোষণ করে দরিদ্রতর থেকে দরিদ্রতর অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছে। আর এখন বাইশ হাজার পরিবার। বঙ্গবন্ধুর দর্শনের সঙ্গে এখানেই তো দ্বন্দ্ব আমাদের। এই বাইশ হাজার পরিবারকে আমরা হয় জ্ঞাতে না হয় অজ্ঞাতে সহযোগিতা করি। এজন্যই বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির সাথে আমাদের বিরোধ হয়ে যাচ্ছে। তাহলে কীভাবে আমরা বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির পক্ষের লোক দাবি করব?

উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী বলেন, আইয়ুবীয় স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ করেছিলেন। আমরা যুদ্ধ করেছি বাংলাদেশের সামরিকতন্ত্রগুলোর বিরুদ্ধে। এরশাদ সাহেব হোক আর জিয়া সাহেবই হোক। কিন্তু নিশ্চয়ই নিজেরা স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে ওঠার জন্য নয়। আমরা একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য, গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের জন্য লড়াই করেছি। কেননা গণতান্ত্রিক সমাজ ছাড়া মানবিক সমাজ গড়ে ওঠে না। অনেকেই পশ্চিমা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলেন, আমি নিজেও পশ্চিমা গণতন্ত্রের খুব একটা অনুরাগী মানুষ নয়।কিন্তু পশ্চিমা গণতন্ত্রই, যখন আপনি তিউনিসিয়া দিয়ে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপে আশ্রয় নিতে চান, তারাই মানুষের হৈচৈ করে, আপনি কিন্তু করেন না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনেক সদস্য আছে, যারা বলে- এদেরকে আশ্রয় দিতে হবে। সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, ইন্দোনেশিয়া কোনো ইসলামিক রাষ্ট্র কিন্তু জায়গা দেয় না। কেননা এরা কেউই মানবিক নয়। এরা মুসলিম রাষ্ট্র বলে দাবি করে, আসলে মুসলিমও নয় তারা।

তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নে কিন্তু বাধা দেওয়ার লোক আছে।কট্টরপন্থী ইউরোপীয়রা বাধা দেয়। কিন্তু একশজন যদি বাধা দেয়, একশ দশ জন পক্ষে বলে। কেননা একটা মানবিক রাজনীতি সেখানে আছে, একটা মানবিক দর্শন সেখানে কাজ করে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দর্শনগতভাবে আমাদের বিশাল বড় বিরোধ রয়ে গেছে। অথচ আমরা বঙ্গবন্ধুর কথা বলি। আমার আওয়ামী লীগের বন্ধুরা আমার কথা শুনলে মনে মনে দুঃখিত হবেন, সেটি আমি জানি। অনেকে আমার সামনে এই নিয়ে তর্ক করতে চাইবেন না। কিন্তু যা আমি বললাম, তা আমার বিশ্বাস থেকে বলেছি। আমার মনের কথা বলেছি।

মোকতাদির চৌধুরী আরও বলেন, আমি শোষনমুক্ত সমাজের স্বাক্ষী এমনটিও নয়। শোষণের হাতিয়ার হিসেবে যারা ব্যবহৃত হয়, আমি তাদেরই একজন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শোষনমুক্ত সমাজ চেয়েছিলেন, এতে কোনো সন্দেহ নাই। যত সমালোচনাই করুক তার, যতভাবেই তাকে আখ্যায়িত করা হোক না কেন। তাঁর শাহাদতবরণের পরে দেখা গেছে, এই ভদ্রলোক নিঃস্ব ছিলেন, কিছুই ছিল না, ব্যাংকে একটি টাকাও ছিল না। পরিবারের জন্য একটি বাড়ি ছাড়া আর কিছুই রেখে যেতে পারেননি। পৈতৃক সম্পত্তি যা ছিল, তাতে হাত পড়েনি বলেই পৈতৃক সম্পত্তি বেঁচে গিয়েছিল। অন্যথায় ঐটাও বাঁচতো না। এই ছিলেন বঙ্গবন্ধু। আপাদমস্তক একজন মানুষ। হিন্দু না, মুসলিম না, খ্রিস্টান না, ইহুদি না। কী ছিলেন তিনি? একজন মানুষ ছিলেন। এই বিষয়টি আমরা উপলব্ধি করতে না পারি তাহলে তাঁর প্রকৃত দর্শন কী সেটি আমরা বুঝতে পারব না।

সাবেক ছাত্রনেতা মোকতাদির চৌধুরী বলেন, তিনি মানুষের সমতায় বিশ্বাস করতেন। মানুষের সমতায় বিশ্বাস করলে আপনি আইনের সমতায়ও বিশ্বাসী হবেন। এভরি ওয়ান ইজ ইকুয়্যাল ইন আই অব ‘ল’ এটি আপনি বুঝবেন। মানুষের সমতায় আমরা বিশ্বাস করিনা বলেই, আইনের সমতায় আমরা বিশ্বাস করিনা। আমি এমপি, আমি আইন ভঙ্গ করলে আমাকে সহযোগিতা করার জন্য যেভাবে আইনজ্ঞরা দাঁড়িয়ে যাবেন, সাধারণ মানুষ যদি আইন ভঙ্গ করে তার পক্ষে সেভাবে দাঁড়াবে না কেউ। এটাই আমাদের সমাজ! এখান থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। তাঁকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কেন বলি? তিনি যে কাজটি করে গেছেন সেটি বাঙালিদের মধ্যে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ। সেটি হলো তিনি বাঙালিদের একটি স্বাধীন দেশ দিয়ে গিয়েছেন। বাঙালিদের কখনো কোনো স্বাধীন দেশ ছিল না। বঙ্গবন্ধুই প্রথম বাঙালির জন্য নিজস্ব রাষ্ট্র উপহার দিয়ে গিয়েছেন।

তিনি বলেন, ত্রিশ লক্ষ মানুষ রক্ত দিয়ে গিয়েছেন এই স্বাধীনতার জন্য। আড়াই লক্ষ থেকে তিন লক্ষ কন্যা, মা, বোন এবং সহধর্মিণী বা প্রেমিকা তাঁরা নিজেদের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে এই দেশের স্বাধীনতা অর্জন করেছেন। এখনও অসংখ্য অগণিত মুক্তিসংগ্রামী পঙ্গু হয়ে আছেন। এতো সহজ না, যতো পেয়ারের লোকই হোক, যারা জাতীয় সঙ্গীত গায় না- এমন লোকদের সঙ্গে আমি হাত মিলাবো না। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে অনীহা প্রকাশ করে, এমন কোনো লোকের সঙ্গে আমি হাত মিলাবো না। এমনকি আমার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও যদি করে, আমি সেটি করবো না। কারণ আমি যুদ্ধে তো আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশে যায়নি। আমি যুদ্ধে গিয়েছিলাম ঐ ব্যক্তির নির্দেশে, যিনি বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তিনি তো আমাকে বলেননি। তিনি কিন্তু তথাকথিত ধর্মীয় রাজনীতিবিদদের (যারা আসলেই ধর্মান্ধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, ইসলামের পক্ষের লোকও নয়) সঙ্গে হাত মিলান নাই। সত্তর সালে ওনার সম্পর্কে বলা হয়েছে নৌকা মার্কায় ভোট দিলে এদেশে ইসলাম থাকবে না, চুয়ান্ন সালে বলা হয়েছিল নৌকায় ভোট দিলে বিবি তালাক হয়ে যাবে। কিন্তু বাংলাদেশের মুসলমানরা ঠিক করেছে, বিবি তালাক হোক তবু আমরা নৌকায় ভোট দিব, আর বিবিরা বলেছেন যাক স্বামী- আমরা নৌকায় ভোট দিব। মোল্লাদের কথা কেউ শুনে না।

মোকতাদির চৌধুরী বলেন, আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, সারাদেশে স্বচ্ছ সুন্দর ভোট হলে সমস্ত মোল্লারা মিলে পাঁচ ভাগের বেশি ভোট পাবে না। এই ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে খুবই একজন সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন মাওলানা তাজুল ইসলাম সাহেব, আমি তাঁর ওপর সর্বোচ্চ সম্মান রেখেই বলছি, তিনি আধা মাওলানা রুকুন্ উদ্দিন সাহেবের কাছে ১৯৪৬ সালে পরাজিত হয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালেও এখান থেকে দেওয়ান মাহবুব আলীর সাথে পরাজিত হয়েছিলেন। এইতো অবস্থাটা। এখানে একজন মওলানা জিতে ছিলেন, তিনি কিন্তু ইসলামের নামে নির্বাচন করেননি, তিনি হলেন ছতুরার পীর সাহেব(মাওলানা আব্দুল খালেক), তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এছাড়া এখানে ইতিহাস নাই।

তিনি বলেন, যারা রেললাইন ভাঙে, রেলস্টেশনে আগুন দেয় তাদেরকে কে কে ভদ্রলোক বলবেন? তিনি যদি জবরদস্তর মওলানা হন, তাকে কী আপনি আলেম মনে করবেন? আমি তো তাকে দেশদ্রোহী মনে করব। একজন দেশদ্রোহী কখনোই আলেম হতে পারে না। জাতীয় সঙ্গীত যে গায় না, সে কখনো দেশপ্রেমিক নয়, সে দেশদ্রোহী; জোব্বা যতো বড়ই হোক। জোব্বা আবু জাহেলেরও খুব বড় ছিল, দাঁড়ি আবু জাহেলেরও খুব বড় ছিল। সুতরাং এদেরকে ভয় পাওয়ার কিছু নাই। কিন্তু আমাদের কিছু লোক আছে, যারা অপরাজনীতিতে বিশ্বাস করে, নিজেদের কোনো জনপ্রিয়তা নাই, এই কৌশলের রাজনীতি করে করে সামনে এগুতে চায়; মানুষকে ধোঁকা দিয়ে রাজনীতি করতে চায়, তারাই এসমস্ত মৎস্যাশী লোকদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে। রাতের অন্ধকারে তাদেের সাথে বৈঠক করে। ধিক তাদেরকে। যারা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না, তার সাথে আমি হাত মিলাবল কীভাবে? যে বাংলা ভাষায় তার প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদান পর্যন্ত করে না।

তিনি আরও বলেন, আপনারা জানেন, এই সমস্ত লোকেরা জাতীয় সঙ্গীতের বিরুদ্ধে? জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে? তারা তাদের প্রতিষ্ঠানে কী ভাষায় শিক্ষা দেয়, জানেন আপনারা? তারা উর্দুতে শিক্ষাদান করে। উর্দু ভাষার প্রতি আমার কোনো বিদ্বেষ নাই। উর্দু ভাষার মহান কবি আল্লামা ইকবালসহ বহু উর্দু ভাষার কবির আমি ভক্ত। আমি নিজেও উর্দুর ছাত্র। আমি উর্দু পড়ি। কিন্তু উর্দুকে যখন আমার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, উর্দুকে যখন বলা হয় এটাই তোমার ভাষা। কেননা মুসলমানদের ভাষা হলো উর্দু! হঠকা লাগে তখন। যারা আমার সংস্কৃতিকে ভুলিয়ে দিতে চায়, যারা আমার ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ভুলিয়ে দিতে চায়, যারা আমার পরিচয়কে ভুলিয়ে দিতে চায়, ম্যাকিয়াভেলিয়ান পদ্ধতিতে আমাকে শেষ করে দিতে চায়; সেটা নিয়ে আমার বিরোধ। আসেন, যেকোনো লোকের সঙ্গে আমরা হাত মিলাতে রাজি, যদি সে আমার সাথে সংবিধান মেনে আসে। সংবিধান যেকোনো দেশের জন্য একটি মানদণ্ড। এই সংবিধান না থাকলে আমার কোনো অস্তিত্ব থাকে না। সুতরাং সংবিধান ধরে তো এগুতে হবে।

মোকতাদির চৌধুরী বলেন, আপনারা জানেন যে, কিছু লোক পাজি, তারা বঙ্গবন্ধুর কথাও মুখে বলেন, একইসঙ্গে আবার বলেন- পহেলা বৈশাখ পালন করা হারাম! আবার বলেন- শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হারাম! কোথায় আছে হারাম? কোন কিতাবে আছে? কোরআনে আছে? নাই। হাদিসে আছে? তাও নাই। চ্যালেঞ্জ দিলাম তাদেরকে। কোরআনে নাই, হাদিসে নাই, তুমি যে বলছো- সেটি তোমার বানানো কথা। তোমার বানানো কথা তো ইসলাম না। ইসলাম হলো আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের বানানো কথা এবং হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর প্রদর্শিত পথ। এর বাহিরে তো ইসলাম হতে পারে না। সুতরাং এইটা যারা করে তাদের সঙ্গে কীভাবে আমি হাত মিলাই?

শেয়ার করুন