যুদ্ধাপরাধী দেলোওয়ার হোসেইন সাঈদীর মৃত্যুতে প্রশাসন ও ছাত্রলীগের যারাই সোশ্যাল মিডিয়ায় অপপ্রচার চালিয়েছে, শোক জানিয়েছে, তাদেরকে সবাইকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন বিশিষ্টজন। শুক্রবার এক আলোচনা সভায় বক্তারা আরও বলেন, ছাত্রলীগে বিএনপি-জামায়াতের লোকেরা অনুপ্রবেশ করে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগকে কলুষিত করছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বিলীন করতে বিশ্বাসঘাতক রাজাকার, আলবদরের বংশধররা উঠেপড়ে লেগেছে। যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর প্রেত্মাদের যে কোনো মূল্যে প্রতিরোধ করতে হবে।
রাজধানীর রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৮তম শাহাদৎ বার্ষিকী উপলক্ষে ‘বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন বনাম ধর্মের নামে রাজনীতি’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এই আলোচনা সভার আয়োজন করে। সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।
সংগঠনের সভাপতি শাহরিয়ার কবিরের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী দক্ষিণ এশীয় গণসম্মিলনের সভাপতি বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, ১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্টের সভাপতি মুনতাসীর মামুন, মানবাধিকার নেত্রী ও সংসদ সদস্য আরমা দত্ত, অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং আবৃত্তিশিল্পী শওকত আলী। অনুষ্ঠান সঞ্চালন করেন শহীদসন্তান অধ্যাপক ডা. নুজহাত চৌধুরী।
অনুষ্ঠানের আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ধর্মের নামে রাজনীতি চলে আসছে সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই। পাকিস্তান আমলেও আমরা একশ্রেণির মানুষকে দেখেছি, যারা ইসলামের নামে রাজনীতি করেছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এসে ধর্মের নামে রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করেছেন। কারণ, তিনি জানতেন ধর্মান্ধরা রাজনীতিতে ধর্মকে শুধু অপব্যবহারই করে। তারা ধর্মব্যবসায়ী।
মন্ত্রী বলেন, জামায়াত এ দেশে ধর্মের নামে রাজনীতি করতে গিয়ে মানুষ হত্যা করেছে। তাদের শিকড় অনেক গভীরে। তাদেরকে উপড়ে ফেলার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর দর্শন বাস্তবায়ন করতে হলে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।
শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, আমরা এখনো অন্ধকার থেকে মুক্তি পাইনি, যার প্রমাণ আমরা সম্প্রতি দেখতে পেয়েছি যুদ্ধাপরাধী সাঈদী মারা যাওয়ার পর। বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, রাজাকার চোখা মিয়ার পুত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেলু রাজাকারের (সাঈদী) মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করবেন, এটাই স্বাভাবিক। আমি অবাক হয়েছি যখন দেখি, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা বলা কিছু মানুষও তার পক্ষে কথা বলছেন।
মুনতাসীর মামুন বলেন, একাত্তরের পরাজিত শক্তির মদদদাতা ও উৎসাহদাতা জেনারেল জিয়া যেভাবে বঙ্গবন্ধুর লালিত সকল আদর্শকে একে একে বাতিল করেছিলেন, ঠিক তেমনিভাবে গণতন্ত্রের মানষকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সকল আদর্শকেও নস্যাৎ করার জন্য জেনারেল জিয়ার যোগ্য উত্তরসূরী ফখরুল উঠে পড়ে লেগেছেন। সাঈদীর জন্য ধর্মান্ধরা রাস্তায় নেমে গায়েবানা জানাজা করছে। মানুষ কতোটা ধর্মান্ধ হলে রাষ্ট্রের মূলনীতি, আদালতের রায়ের তোয়াক্কা না করে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অবদমিত করে এ কাজ করতে পারে?
তিনি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর নিকট প্রশ্ন রাখেন, কেন এখন পর্যন্ত একজন চিহ্নিত দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুর পরও মিছিল বের হলো না? কেন ভাতা প্রাপ্ত দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধারা রাস্তায় নামলেন না? আমাদের রাস্তায় নামা উচিত ছিলো না?
সংসদ সদস্য অ্যারোমা দত্ত বলেন, বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক মনোভাব প্রত্যাখান করে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে ইসলামিক রাজনীতি চালু করেন এবং মুসলিম জাতিসমূহের সহযোগিতা সংস্থায় বাংলাদেশকে তুলে ধরেন। এসব ব্যবস্থা বাংলাদেশের অনেক উপজাতীয় ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিচ্ছিন্ন ও বিরুদ্ধাচরণ করে যা ভবিষ্যতের বেশ কিছু সাম্প্রদায়িক ও উপজাতিক দ্বন্দ্বকে ত্বরান্বিত করে।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ একটি আদর্শ ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। সেই ধর্মনিরপেক্ষতাকে সরিয়ে দিয়ে সংবিধানের পরিবর্তন করা হলো। নিষিদ্ধ করে দেওয়া ধর্মভিত্তিক রাজনীতি আবার তার বিষাক্ত নখ-দন্ত নিয়ে এই দেশের মাটিতে ফিরে আসার ফলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে গড়ে তোলা বাংলাদেশ পথ হারিয়ে বিভ্রান্তির কানাগলিতে হারিয়ে যায়।
সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চনকে কেন্দ্র করে ’৭১-এর গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত এবং তাদের সহযোগীরা বিএনপির ছত্রছায়ায় নির্বাচন বানচালের জন্য বহুমাত্রিক তৎপরতা চালাচ্ছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে সারাদেশে তারা যে আগুন সন্ত্রাস, হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনের মতো ঘটনা ঘটিয়েছিল, এবারও তার পুনরাবৃত্তির ক্ষেত্র তৈরি করছে। এর সাম্প্রতিকতম উদাহরণ ’৭১-এ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা দেলোয়ার সাঈদীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিএনপির ছত্রছায়ায় জামায়াত শিবির চক্রের তাণ্ডব।