দেশের পরবর্তী প্রধান বিচারপতি গুরুতর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক বিভক্তি রাজপথ অতিক্রম করে বিচারালয় অভিমুখে ধাবিত হলে সেটা বিচারলয়ের জন্য মঙ্গলজনক হয় না। আমাদের মনে রাখতে হবে, আইনজীবীদের বিভক্তি ও মতভেদ এবং তার প্রতিক্রিয়া বিচারালয়কে ক্ষতিগ্রস্ত করে।’
আজ বৃহস্পতিবার বিচারিক জীবনের শেষ কর্মদিবেসে অ্যাটর্নি জেনারেল ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতির দেওয়া বিদায়ী সংবর্ধনায় এসব কথা বলেন তিনি। প্রধান বিচারপতির এজলাস কক্ষে এ সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
দেশের ২৩তম প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী অবসরে যাচ্ছেন আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর। সে সময় সুপ্রিমকোর্ট অবকাশকালীন ছুটিতে থাকবে বিধায় আজই প্রধান বিচারপতির বিচারিক জীবনের শেষ কর্মদিবস। প্রথা অনুসারে আজ তাকে আপিল বিভাগের এক নম্বর বিচার কক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি (সুপ্রিম কোর্ট বার) বিদায়ী সংবর্ধনা দেয়।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিরা ও সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবীরা যোগ দেন। অনুষ্ঠানে অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ (এএম) আমিন উদ্দিন ও সুপ্রিমকোর্ট বার সভাপতি মো. মোমতাজউদ্দিন ফকির প্রধান বিচারপতির কর্মময় জীবনের নানা দিক তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন।
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘রাজনৈতিক বিভক্তি রাজপথ অতিক্রম করে বিচারালয় অভিমুখে ধাবিত হলে সেটা বিচারলয়ের জন্য মঙ্গলজনক হয় না। আমাদের মনে রাখতে হবে, আইনজীবীদের বিভক্তি ও মতভেদ এবং তার প্রতিক্রিয়া বিচারালয়কে ক্ষতিগ্রস্ত করে। রাজনৈতিক মতাদর্শ রাজনৈতিকভাবে বাস্তবায়ন করলে এবং বিচারলয়কে নিরাপদ দূরত্বে রাখলে বিচার বিভাগ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।’
তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় আমার উত্তরাধিকারী গুরুতর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবেন। আমি এটাও মনে করি মহান আল্লাহ তাকে সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার অধিকারী করবেন এবং বিচার বিভাগকে আরও গতিশীল বিচার বিভাগে পরিণত করবেন। আমার কাছে মনে হচ্ছে আমি আমার বিচার বিভাগ তার কাছেই হস্তান্তর করতে যাচ্ছি, যিনি এই বিভাগকে আরও গতিশীল করার জন্য ক্ষমতাবান এবং মনোযোগী হবেন। আমি অপেক্ষা করবো আপনাদের ভবিষ্যতের সাফল্যের গল্প শোনার জন্য।’
হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, ‘আইনের নিরঙ্কুশ আধিপত্য বা প্রাধান্য কার্যকর করার দায়িত্ব বিচার বিভাগের। বিচার বিভাগ যদি আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগ করতে ব্যর্থ বা পিছপা হয় তাহলে রাষ্ট্র এবং নাগরিক ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য। বিচার বিভাগ সংবিধানের আধিপত্য রক্ষার পাশাপাশি জনগণের মৌলিক অধিকারের রক্ষক।’
তিনি বলেন, ‘সত্যিকারের অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের বিকাশ, আইনের শাসন সংরক্ষণ এবং সমাজের দুর্বল অংশের অধিকার এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অপরিহার্য। সুপ্রিম কোর্ট বিচার প্রশাসনের সর্বোচ্চ আদালত আর বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সর্বোচ্চ গুরুত্বের ওপর নির্ভর করে। যে মহান চিন্তা ও কল্যাণ চেতনা সন্নিবেশিত করে আমাদের সংবিধান প্রণীত হয়েছে, তার ধারক ও বাহক হিসেবে, দেশের সব আইন ও সব আইনগত কার্যক্রম সাংবিধানিক চেতনার প্রতিফলন নিশ্চিত করার সুমহান জাতীয় দায়িত্ব আমাদের সবার। মানুষ চায় শান্তি আর শান্তি, কিন্তু পরিপূর্ণ শান্তির জন্য আমাদের এখনো অনেকটাই এগোতে হবে। আমাদের আঁকা-বাঁকা জায়গাগুলোকে সোজা করতে হবে।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘সংবিধান প্রণেতারা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন- সে স্বাধীনতা কার্যকর করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গের এবং প্রতিটি নাগরিকের। সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে একাত্তরের রক্ত বৃথা যাবে। মনে রাখতে হবে, জনগণের ঐক্যবদ্ধ বীরত্ব এবং সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে আমরা এই দেশ, এই বিচারালয় পেয়েছি। ১৯৭১ সালে জাতি চরম ত্যাগ স্বীকার করে স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছে। আমাদের জাতীয় দায়িত্ব হলো সবক্ষেত্রে সেই দেশকে এগিয়ে নেওয়া। আমরা ব্যর্থ হলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। আমাদের সব আইনে মানবিকতার স্পর্শ থাকতে হবে। আইন যদি দরিদ্রকে পিষে দেয় আর ধনী ব্যক্তি যদি আইনকে পিষে দেয় তাহলে রাষ্ট্র এবং বিচার বিভাগ সঠিকভাবে চলছে- এটা কোনোভাবেই বলা যাবে না।’
তিনি বলেন, ‘শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য শক্তিশালী ও স্বাধীন বিচারবিভাগ অপরিহার্য। গণতন্ত্রের ভিত্তি হলো আইনের শাসন এবং বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা। বিচারকদের রাজনৈতিকভাবে বয়ে যাওয়া হাওয়া থেকে নিজেদের মুক্ত রেখে সংবিধান, আইন নিজেদের বিচারিক বিবেকের প্রতি পরিপূর্ণ অনুগত থেকে বিচারকাজ সমাধান করা। বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় জনগণের অগাধ আস্থা স্থাপন করতে হবে এবং থাকতে হবে। নাহলে দেশের জনগণের অধিকার রক্ষা হবে না এবং স্বাধীনতাও বিপন্ন হবে। সব বিচারককে অসামান্য নৈতিকতার অধিকারী হতে হবে, নইলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা শুধুমাত্র সংবিধানের ভেতরই আবদ্ধ থাকবে। ধন্য তারাই, যারা অন্তরে শুদ্ধ।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমাদের সংবিধান ৩০ লাখ শহীদের রক্তে রঞ্জিত এবং দেশবাসীর ওপর পবিত্রভাবে বাধ্যতামূলক। যেখানে রাষ্ট্রে বিভিন্ন অঙ্গের এখতিয়ার এবং ক্ষমতা, সঠিক আইন প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের পবিত্র দায়িত্ব হলো এর প্রতিটি অক্ষরের প্রতি অনুগত থাকা এবং সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া। সবার ভেতর এমন একটা ভিত তৈরি করতে হবে যেন প্রতিটি নাগরিক আমাদের এই দেশটাকে প্রচণ্ডরকম ভালোবাসে।’