আজকের লেখায় আমি আমার তিন স্নেহভাজনের ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাস উদ্ধৃত করে দু-একটি কথা বলবো। কেন অন্যদের লেখা উদ্ধৃত করছি? কারণ লেখাগুলোতে যুক্তি আছে এবং দেশের মানুষের এগুলো জানা প্রয়োজন। আমরা অনেক সময় সব কিছু বিবেচনা না করে মুখরোচক মন্তব্য করে তাৎক্ষণিক বাহবা কুড়াতে গিয়ে যে দেশের কতবড় ক্ষতি করি, সেটা বুঝতেও পারি না। নেতিবাচক কথা বলতে ও শুনতে আমরা অনেকেই বেশি পছন্দ করি। গড়ার চেয়ে ভাঙার আনন্দ আমাদের কাছে বেশি। ভাঙা সহজ, গড়া কঠিন।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে এই গড়ার কাজটি চলছে। ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন কিংবা জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ যে উপস্থিত থাকার জন্য বিশেষ আমন্ত্রণ পেয়েছে, সেটা এই নতুন ভাবমূর্তি নিয়ে গড়ে ওঠার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। রাশিয়ার পররামন্ত্রী সের্গেই লাভরভ ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর বাংলাদেশ সফর দেশের জন্য সম্মান ও গৌরবের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে সত্যি সত্যি বাংলাদেশকে এক নতুন উচ্চতায় নিতে সক্ষম হয়েছেন, তা অস্বীকার করা ঈর্ষাপরায়ণতা ছাড়া আর কিছু নয়।
সব ক্ষেত্রেই সরকারের শতভাগ সফল, সেটা নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকার অবশ্যই ব্যর্থ। দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরার ক্ষেত্রে সরকারের শিথিলতা আছে, অর্থনীতির নানা অসঙ্গতি দূর করার ক্ষেত্রেও আন্তরিকতার ঘাটতি লক্ষ করা যায়। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানও স্বীকার করেছেন, সারাদেশে অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতির মাত্রা আগের তুলনায় বেড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে না পারাও সরকারের এক বড় অসফলতা। কিন্তু এর বাইরে সরকারের যেসব বড় বড় সাফল্য তা অস্বীকার করা তো অন্ধ বিরোধিতার শামিল।
আমি প্রথমেই সিনিয়র সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জুর একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করছি। মঞ্জু লিখেছেন : ‘আমার পিতা-পিতামহের জন্মস্থান ও গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা থানার মধ্যে অজ গাঁ গুণপালদিতে। আমার শৈশব থেকে প্রৌঢ় বয়স পর্যন্তই বলা যায় এলাকাটা প্রান্তিক ছিল। ধীরগতিতে কিছু অবকাঠামো ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি এবং শিক্ষা বিস্তারসহ মধ্যবিত্তের বিকাশ ঘটেছে। ২০১৪ সালে পদ্মা সেতু ও ২০১৬ সালে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের কাজ শুরুর মাত্র অনধিক ৯ বছরে ওই এলাকার চেহারা রূপকথার মতো বদলে গেছে।
ভাঙ্গার মোড়ে বিরামহীন দ্রুতগামী মোটর চলাচলের ইন্টারসেকশন ইউরোপ-আমেরিকার মহাসড়কের আদল পেয়েছে। এই এক্সপ্রেসওয়ে এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে। ভাঙ্গা এখন দেশের দক্ষিণাঞ্চলের আধুনিক প্রবেশদ্বার, সড়কে ও রেলে। রেল সংযোগ সম্পূর্ণ হয়েছে এবং দেড় শতাব্দীর রেলবঞ্চিত বরিশাল বিভাগও এখন রেলের আওতায় আসছে দ্রুত।’
তিনি লেখেছেন, ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে আমি যখন প্রথম ঢাকায় ডেরা বাঁধি তখন এই প্রাদেশিক রাজধানী ছিল মোগল ও ব্রিটিশ স্মৃতির বিলীয়মান অবশিষ্ট নিয়ে পাকিস্তানি শাসকদের অবজ্ঞা-অবহেলায় দীন-দরিদ্র কিন্তু পর্যাপ্ত শ্যামলিমার ফাঁকে ফাঁকে পলাশ কৃষ্ণচূড়ার লালিমা মাখা, তরুণদের স্বপ্ন ও সংগ্রামে উজ্জীবিত, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে স্পন্দিত এক মায়াময় শহর। স্বাধীনতার ৫০ বছরে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে।
গত ২ সেপ্টেম্বর উদ্বোধন করা হলো ঢাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বা উড়ালসড়ক। আধুনিক অবয়ব পাচ্ছে আমাদের জাতীয় রাজধানী। অল্পদিনের ব্যবধানে পদ্মা সেতু ও এই উড়ালসড়ক দুটোই উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যোগাযোগ ব্যবস্থার অবকাঠামো উন্নয়নে এগুলো বড় উল্লম্ফন। মোটরযান এখন শাহজালাল বিমানবন্দরের কাছ থেকে দক্ষিণ প্রান্তের কুতুবখালীতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গিয়ে পড়তে পারবে আগের তুলনায় প্রায় বিদ্যুৎগতিতে। মহানগরের অভিশাপের মতো যে যানজট তা কমবে। এখনই পুরো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না, চালু হয়েছে আংশিক, ফার্মগেট পর্যন্ত। আরও অনেক প্রকল্প চালু রয়েছে।
শাসন ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের সংকট, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের চ্যালেঞ্জ, দুর্নীতির আধিক্য, রাজনীতি ও সমাজে নীতি-নৈতিকতার অবক্ষয় প্রভৃতি নানা সমস্যা মোকাবিলা করছি আমরা। এর মধ্যে অর্থনৈতিক ও বৈষয়িক উন্নয়নের ক্ষেত্রে গত দেড় দশকে আমাদের যে নজরকাড়া অর্জন তার জন্য বর্তমান আওয়ামী লীগের সরকার ও তার প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আমরা আধুনিকতার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি।’
এরপর কানাডাপ্রবাসী আমার স্নেহভাজন সাবেক ছাত্র নেতা মঞ্জুরে খোদা টরিকের একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করছি। টরিক তার ফেসবুক পেজে লিখেছেন: ১৯০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন প্রায় দেড়শ ব্যক্তি। শান্তিতে নোবেল পাওয়া এখনো প্রায় শতজন বেঁচে আছেন। বিশ্বে এখন কতটা শান্তি বিরাজ করছে তা শুধু বাজারের তেজেই প্রতিটা মানুষ বুঝে যান।
একটা হিসাব দেই, আগে আমি ৫০ ডলারে গাড়িতে ফুল ট্যাংকি তেল নিতে পারতাম, এখন ১০০ ডলার লাগে। মাসে চারবার তেল তুললে আমার খরচ হয় ৪০০ ডলার। মানে প্রতি মাসে ২০০ ডলার বাড়তি খরচ হচ্ছে শুধু গাড়ির তেলের পেছনে! খাবার তেল, চাল-রুটি, সবকিছুর দামেই দুই/তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তেল শুধু গাড়িতে নয়, কল-কারখানাসহ অনেক কাজেই লাগে। আগে প্রতি মাসে সংসার খরচ করে কিছু টাকা থাকতো। এখন সে চিন্তা বাদ। তাহলে আমার ঘরের শান্তি কেড়ে নিল কে?
শুধু ভাবুন তেল থেকেই এদের এই যুদ্ধ বাণিজ্যের মুনাফার পরিধি কত! কিন্তু আমি, আমরা কেন যুদ্ধের দায় বহন করবো? সত্য হচ্ছে, বিশ্বের প্রত্যেকটা মানুষ এই যুদ্ধের ব্যয় বহন করছে। সরকার জনগণের ট্যাক্সের টাকা তো সেখানে ঢালছেই।
যুদ্ধ করছে রাশিয়া-ইউক্রেন, আর পশ্চিমারা সেখানে ঘি ঢালছে, লাকড়ি ঠেলছে, মুনাফা করছে। এই যুদ্ধে বিশ্বের প্রতিটি পরিবারের ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাদের টিকে থাকার যুদ্ধ চলছে। কিন্তু এর দায় কার?
শান্তিতে নোবেল পাওয়া এখনো প্রায় শতজন ব্যক্তি বেঁচে আছেন কিন্তু যুদ্ধ বন্ধ ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় তাদের কোনো যৌথ বিবৃতি, অবস্থান, অনশন, লেখালেখি, চিঠিপত্র, দৌড়ঝাপ নেই! কিন্তু কেন? ব্যক্তির স্বার্থে- প্রয়োজনে তাদের বক্তব্য-বিবৃতি দেখি কিন্তু মানবতার শান্তিতে তাদের কোনো ভূমিকা নেই! বিষয়টা অদ্ভুত না?’
টরিক খুব সঠিক প্রশ্ন তুলেছেন। তার লেখা থেকে এটাও স্পষ্ট যে মূল্যবৃদ্ধির সমস্যাটি শুধু বাংলাদেশের নয়। গোটা দুনিয়ার মানুষই এ সমস্যায় ভুগছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষত শুধু ওই দুই দেশের মধ্যে সীমিত নেই। সব দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। অথচ নোবেলজয়ী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা ওই যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে সোচ্চার না হয়ে ড. ইউনূসের ব্যক্তিগত একটি বিষয় নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন।
এ প্রসঙ্গে আমি উল্লেখ করতে চাই আমার আরেক স্নেহভাজন সাংবাদিক মাহবুব কামালের বক্তব্য। সেটাও তার ফেসবুক পেজ থেকেই। মাহবুব লিখেছেন: ৯ সেপ্টেম্বর রাতে বাইডেন-হাসিনার ছবির গ্রামাঞ্চলে প্রতিক্রিয়া কী, তা জানতে তিন জেলার তিন পাঠককে ফোন দিয়েছিলাম। একজন বললেন, আপনারা তো শহরের বুদ্ধিজীবী, গ্রামের খবর রাখেন না। গ্রামগঞ্জে শোর উঠেছে, হাসিনা বাপের বেটি, আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ছবি তুলেছেন।
এরপর মাহবুব কামাল লিখেছেন, দিন পনেরো আগে এক টকশোতে আমি বলেছিলাম জি-২০ সামিটের পর অনেক কিছুই বোঝা যাবে। সঞ্চালক জিজ্ঞেস করেছিলেন, কী কারণে বলছেন? বলেছিলাম, জি-২০’র সদস্য না হাওয়ার পরও দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের একমাত্র শেখ হাসিনাকে দাওয়াত করেছেন মোদী, যে সামিটে বাইডেনও থাকবেন। টকশো শেষে সঞ্চালক বলেছিলেন, আপনার পয়েন্টটা ভাইটাল। আজ সকালে সেই সঞ্চালকের সঙ্গে কথা হলো। প্রথমেই তিনি বললেন, আপনি তো বাজিমাৎ করে দিয়েছেন। হাসিনার half of the battle is done. আমি বললাম, আপনি কি সেলফিটির কথা বলছেন?
তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমি বললাম, সেলফিটির চেয়ে যে ছবিটিতে বাইডেন, মোদি ও শেখ হাসিনা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন, সেটাই আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মনস্তত্ত্ব বলে, বসে কথা বলার চেয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলার গুরুত্ব বেশি। আমিও দেখেছি, আড্ডা শেষে যখন আমরা পরস্পর বিদায় নেই, তখনই ঠিক হয় নেক্সট কবে দেখা হবে। অর্থাৎ উপসংহার টানা হয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই।
তবে হাসিনা দিল্লি গিয়ে যুদ্ধের অর্ধেক জয় করেছেন, এটা আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না। কারণ আমেরিকার প্রশাসন কীভাবে কাজ করে তা আমি মোটামুটি জানি। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সীমাবদ্ধতা ও সিনেটরদের ক্ষমতা বোঝাতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট আইজেনআওয়ার একবার বলেছিলেন, Had I been the president and a senator concurrently, I could have done much better for America. But alas! I’m only the president.
যা হোক, আমেরিকা চাপ কমিয়ে দিলে, সেটা যদি শেখ হাসিনা পজিটিভলি না নেন, তাহলে তা খুব খারাপ হবে। যারা শেখ হাসিনাকে আবারও ক্ষমতায় দেখতে চান, তাদের অবশ্যই চাইতে হবে তার গায়ে ভোটাধিকার হরণকারীর তকমা যেন পার্মানেন্টলি বসে না যায়। একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই পারে বিশ্ব দরবারে শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল করতে। হারা-জেতা সেটা পরের কথা।’
মাহবুব কামালের এই বক্তব্যের সঙ্গে আমারও খুব একটা দ্বিমত নেই। তবে আমি এটাও বলতে চাই যে বিএনপি যদি জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী হয়, তাহলে নির্বাচন থেকে দূরে থাকবে না। কেবল বিরোধিতা ও সমালোচনা কখনো রাজনীতির সুস্থ ধারা হতে পারে না। আওয়ামী লীগকে যারা গণতন্ত্র শেখাতে অতিউৎসাহী দেখা যায়, তাদের উচিত বিএনপিকেও এই পাঠটা দান করা। বিএনপির অবস্থান যে গণতন্ত্র থেকে অনেক দূরে এটা বুঝতে না চাইলে গণতন্ত্রেরই ক্ষতি।
লেখক : রাজনীতিক, লেখক ও মহাপরিচালক, বিএফডিআর।