মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেছেন, ‘আমারই নির্বাচনী এলাকার মানুষ, আমরা যখন পরিবেশ নিয়ে কথা বলতে গেলাম, অত্যন্ত স্নেহের পাত্র আমার, মেয়র তাপস; ছোটবেলা থেকে দেখেছি, কারণ, একই পাড়ায় থেকেছে। আমরা সবাই যখন পরিবেশ নিয়ে কথা বলতে গেলাম, তিনি বললেন যে যদি বেশি কথা বলে ধোলাইখালে নিয়ে চুবাব।’
সোমবার রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের ‘বাংলাদেশের উন্নয়ন আখ্যান ও সমান্তরাল বাস্তবতা: পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ভাবনা’ শিরোনামের একটি প্রকাশনার অনুষ্ঠানে বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল মনে করেন, চুবানোর সংস্কৃতি কিন্তু শেখ ফজলে নূর তাপসের একার মধ্যে নেই। অনেকের মধ্যেই আছে।
এমন কথা আরও অনেক জায়গায় শুনেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন কথা বলতে গেলে যদি চুবানোর ধমক খেতে হয়, আসলে কোন রাজনীতিকের কাছে যাব?
সুলতানা কামাল বলেন, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ করতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকা প্রয়োজন। রাজনৈতিক সদিচ্ছা আসবে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে। কিন্তু রাজনীতিবিদেরা কোথায়? তাঁদের খুঁজে পাওয়া যায় না। যাঁরা জনপ্রতিনিধি হবেন, তাঁদের সঙ্গে জনসাধারণের সংযোগ না থাকলে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হবে না। তাঁদের জনগণের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিতে হবে।
দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়েও কথা বলেন সুলতানা কামাল। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যব্যবস্থার নাকি এত উন্নতি হয়েছে যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রশংসা করেছে। কিন্তু যাঁরই অসুখ হচ্ছে এবং একটু সামর্থ্য আছে, দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন। তাহলে কাদের জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি হলো এবং কী এমন উন্নতি হলো যে বাইরে চলে যেতে হয়, সে প্রশ্ন রাখেন তিনি।
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের সাম্প্রতিক বক্তব্য প্রসঙ্গে সুলতানা কামাল বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ সৈনিক পরিচয় হিসেবে সেভাবে প্রমাণ করতে পেরেছেন বলেই তিনি উপাচার্য হতে পেরেছেন। কিন্তু তিনি কী করে ‘তালেবানি সংস্কৃতি’তে বিশ্বাস করেন?
মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের মানুষেরা কোথায়? এ প্রশ্ন তুলে সুলতানা কামাল বলেন, যারা নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের দাবি করছে, তাদের নাগরিক হিসেবে চ্যালেঞ্জ করতে হবে নিজেদের তা প্রমাণ করতে। যেগুলো বলে, সেগুলোর বাস্তবায়ন দেখতে চাই।
ভালো মানুষ যদি চুপ করে থাকেন, তাহলে দুর্বৃত্ত অনেক বেশি শক্তিশালী হয় বলে মনে করিয়ে দেন তিনি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও অনুষ্ঠানের সভাপতি অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, একটি রাষ্ট্রের ব্যর্থতার দুটি দিক আছে। একটি হচ্ছে গণতান্ত্রিক ব্যর্থতা, যেখানে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার থাকে না। আরেকটি হচ্ছে ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থার অভাব।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে স্বাধীনতার পাশাপাশি ন্যায়ভিত্তিক সমাজও প্রতিষ্ঠা করতে হবে উল্লেখ করে রেহমান সোবহান বলেন, এই আলোচনায় যেসব সমস্যা চিহ্নিত হয়েছে, সেগুলো সমাধাযোগ্য। কিন্তু এখানে বিষয় হচ্ছে, এগুলো কতটা প্রাধান্য পাচ্ছে। এ ছাড়া বাস্তবায়নের সদিচ্ছা একটি বিষয়। দুর্নীতি, সুশাসনের মতো অনেক কিছু এখানে জড়িত।
সুশীল সমাজেরও কিছু দায়িত্ব আছে উল্লেখ করে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, কোনো এলাকায় যখন বাল্যবিবাহ বেড়ে যায়, তখন সেখানে সুশীল সমাজেরও দায়িত্ব পালন করতে হয়। কারণ, তাদেরও এটা দেখার দায়িত্ব যে এই সব মেয়ে শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে কি না। এ ছাড়া সরকারের ওপরও চাপ প্রয়োগ করার দায়িত্ব এই নাগরিক সমাজের।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ও সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, বাংলাদেশে উন্নতি হয়েছে, কিন্তু তার ভাগীদার সবাই সমান নন। বৈষম্য বাড়ছে, যা শিক্ষা–স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলছে। দেশে ১০ শতাংশ মানুষের হাতে ৪১ শতাংশ সম্পদ। এখন অত্যন্ত বিত্তবানদের রাজনৈতিক ক্ষমতারও উদ্ভব ঘটছে, যা আগে ছিল না।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য চারটি মূল সমস্যার কথা তুলে ধরেন—ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ না বাড়া, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে কম বরাদ্দ, প্রত্যাশা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় না হওয়া এবং সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় বাড়ালেও প্রাপ্যরা তা সঠিকভাবে পাচ্ছেন না। তিনি আরও বলেন, যতটা না সরকারের নীতিতে সমস্যা ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি সমস্যা ছিল সরকারের সেই নীতি বাস্তবায়নে যথেষ্ট পরিমাণ সম্পদ না দিতে পারায়। এ ছাড়া সরকার মুখে যেটা বলেছে, সেটা যদি কাজে দেখাতে পারত, তাহলে সমস্যা দেখা যেত না।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, গণতান্ত্রিক জবাবদিহির যে জায়গা দরকার, সেটা ছিল না। যার কারণে প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি তার কাজ করেননি। যদি আগামী দিনে বাংলাদেশকে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ করতে হয়, তাহলে দেশে এই মুহূর্তে সুষম অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পথে যেতে হলে গণতান্ত্রিক উত্তরণ প্রয়োজন।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন কথাসাহিত্যিক ও বাংলা একাডেমির সভাপতি সেলিনা হোসেন, বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ, সাবেক বিচারপতি মো. আবদুল মতিন, নাগরিক প্ল্যাটফর্মের সদস্য ও সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং নাগরিক প্ল্যাটফর্মের সদস্য সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর।