চলমান ফিলিস্তিন-ইসরায়েল রক্তক্ষয়ী সংঘাতকে কেন্দ্র করে অনলাইনে অনেক অপতথ্য ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস গত শনিবার ইসরায়েলে নজিরবিহীন হামলা চালায়। জবাবে পাল্টা হামলা শুরু করে ইসরায়েলও। খবর দ্য গার্ডিয়ান ও আল জাজিরার।
দুই পক্ষের রক্তক্ষয়ী সংঘাতে ইতিমধ্যে হাজারো মানুষ নিহত হয়েছেন। ইসরায়েলে নিহতের সংখ্যা ১ হাজার ২০০। গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২০০–তে।
চলমান সংঘাত নিয়ে অপতথ্যের পাশাপাশি ভুল তথ্যের বন্যা বইছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে, যা বিশ্বজুড়ে উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলছে। এখানে অপতথ্য বলতে ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা তথ্য ছড়ানোকে বোঝানো হচ্ছে। আর ভুল তথ্য বলতে অনিচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা তথ্য ছড়ানোকে বোঝানো হচ্ছে।
ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতকে কেন্দ্র করে অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া অপতথ্যের নমুনা তুলে ধরছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।
যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান এমন কিছু অপতথ্যের নমুনা উপস্থাপন করেছে। যেমন—অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওটিতে দেখা যায়, কালো টি-শার্ট পরা এক তরুণ রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন। তার ভিডিও ধারণ করা হচ্ছে। ভিডিও ধারণের বিষয়ে কাউকে নির্দেশনা দিতে শোনা যায়। সেখানে কিছু ইসরায়েলি লোকজন দেখা যায়। তাদের মধ্যে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর উর্দিধারী ব্যক্তিও আছেন।
ভিডিওটি এক্সে (সাবেক টুইটার) প্রায় ২০ লাখবার দেখা হয়েছে। একটি ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্ট থেকে ভিডিওটি এক্সে পোস্ট করা হয়। পোস্টের ক্যাপশনে লেখা হয়, ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, প্রাণহানির ভুয়া ফুটেজ তৈরির চেষ্টা করছে ইসরায়েল।
প্রকৃতপক্ষে ভিডিওটি একটি ফিলিস্তিনি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নেপথ্য শটের। ভিডিওটি প্রথমে টিকটকে পোস্ট করা হয়। তবে টিকটকে এখন আর মূল পোস্টটি নেই। কিন্তু ভিডিওটি এক্সে ছড়িয়ে পড়ছে।
এক্সের পোস্টদাতা পরে স্বীকার করেছেন, ভিডিওটি প্রেক্ষাপটের (ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত) বাইরের হয়ে থাকতে পারে।
টিকটকে প্রথম পোস্ট হওয়া আরেকটি ভিডিওতে ইসরায়েলের কয়েকজন জেনারেলকে হামাস যোদ্ধারা আটক করেছেন বলে দাবি করা হয়। ভিডিওটি প্রায় ২০ লাখবার দেখা হয়। তবে ভিডিওটি এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না।
প্রকৃতপক্ষে এই ভিডিও গত সপ্তাহে আজারবাইজানের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ করা হয়। ভিডিওতে নাগোর্নো-কারাবাখ সরকারের সাবেক নেতাদের গ্রেপ্তারের বিষয়টি দেখানো হয়েছিল।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ইসরায়েলকে চার বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেওয়াসংক্রান্ত একটি নথি (ডকুমেন্ট) গত সপ্তাহে এক্সে প্রকাশিত হয়। এটি চার লাখবার দেখা হয়। তবে এটি ছিল একটি ভুয়া নথি। মার্কিন প্রেসিডেন্টের গত জুলাইয়ের একটি নথির সম্পাদিত সংস্করণ ছিল এটি। এতে ইউক্রেনকে ৪০০ মিলিয়ন ডলার সাহায্যের ঘোষণা ছিল।
এক্সে অপতথ্য ছড়ানোর জন্য রাশিয়ার হাত থাকার অভিযোগ আছে। এখন চলমান ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতকে তারা পুঁজি করছে বলে মনে করা হয়।
আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, হামাসের কাছে অস্ত্র বিক্রি করার জন্য ইউক্রেনকে ধন্যবাদ দিচ্ছে ফিলিস্তিনি সংগঠনটি। রাশিয়ার ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভাগনারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে ভিডিওটি পোস্ট করা হয়েছিল। ভিডিওটি তিন লাখের বেশিবার দেখা হয়েছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনের ইন্সপেক্টর জেনারেল জানান, ইউক্রেনকে দেওয়া অস্ত্র ও অন্যান্য সহায়তা তৃতীয় কোনো পক্ষের কাছে যাওয়ার প্রমাণ নেই।
আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, ইয়ান মাইলস চেওং নামের এক কট্টর ডানপন্থী ভাষ্যকার তার এক্সে একটি ভিডিও পোস্ট করেন। তিনি দাবি করেন, ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, হামাসের যোদ্ধারা ইসরায়েলি নাগরিকদের হত্যা করছেন। তবে পরে এক্সের কমিউনিটি নোটে বলা হয়, ভিডিওতে থাকা ব্যক্তিরা ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য, হামাসের সদস্য নন। কিন্তু ভিডিওটি এখনো এক্সে শেয়ার হচ্ছে। লাখ লাখ দর্শক তা দেখেছেন।
দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, চলমান ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত-সম্পর্কিত ভুয়া খবর নিয়ে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের কেন্দ্রে আছেন এক্সের মালিক ইলন মাস্ক। তার এই প্ল্যাটফর্মে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, বিদ্বেষ ছড়ানোর গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। তবে এই অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেছেন। গত মঙ্গলবার ইউরোপীয় কমিশন মাস্ককে একটি চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে তার এক্সে এই সংঘাত-সম্পর্কিত অপতথ্য ছড়ানোর বিষয়ে তাকে সতর্ক করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রযুক্তিগত জবাবদিহি বিভাগের উপপরিচালক প্যাট দা ব্রুন বলেন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের অধীনে মেটা, এক্সের মতো কোম্পানিগুলোর সুস্পষ্ট দায়িত্ব রয়েছে। আর সংকট-সংঘাতকালে এই দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়।