মোকতাদির চৌধুরী হেরে গেলে হারবে বাংলাদেশ!

হাসান শান্তনু

২০২১ সালের ঘটনা। ব্রাক্ষণবাড়িয়া- ৩ (সদর, বিজয়নগর) আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীকে ‘সন্ত্রাসী’ বলার স্পর্ধা দেখায় একাত্তরের ঘাতকপুত্র মামুনুল হক। মামুনুল উগ্র সংগঠন হেফাজতের নেতা। ধর্মান্ধ মৌলভির এমন দুঃসাহসে সরকার ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় ক্ষুব্ধ হয়। মোকতাদির একাত্তরের যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে মামুনুল ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্য দেন বলে সরকারের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন।

এর জন্য মামুনুল গ্রেপ্তার হবেন, এ তথ্য জানিয়ে আমি ওই বছরের ২ এপ্রিলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিই। অনেকে জিজ্ঞেস করেন, সরকারের একাংশের সঙ্গে হেফাজতের ‘আপসরফা’। মামুনুল কি সত্যই গ্রেপ্তার হবেন?

তাদেরকে বলেছিলাম, এটা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তনয়া, আওয়ামী লীগ ও সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার নির্দেশ। এরপর মামুনুল গ্রেপ্তার হন। একসময় শিক্ষা, সংস্কৃতি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার পাদপীঠ ছিলো ব্রাহ্মণবাড়িয়া। রাষ্ট্রপিতা বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫ সালের আগস্টে হত্যার পর থেকে বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কালো ছোবলে আক্রান্ত হয় ওই জেলা।

‘৯৬ সালে আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের আগে পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছিলো ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর কবলে। মৌলবাদের আঁতুরঘর হিসেবে কুখ্যাতি পাওয়া এ জেলাকে আগের অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যে ফিরিয়ে নেওয়ার লড়াইটা ’৯৬ সালে মোকতাদির চৌধুরীই শুরু করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে পুরনো, নিজস্ব চেহারায় ফিরিয়ে নেওয়ার সংগ্রাম শুরু করার পর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, শত্রুপক্ষের প্রবল বাধার সম্মুখীন হন তিনি। তবে পিছু হটেননি।

এ সংগ্রামের জন্য মোকতাদিরকে চারদলের জোট সরকারের আমলে চরম রোষানলে পড়তে হয়। তাঁর বিরুদ্ধে তখন মামলা দায়েরের অলিখিত প্রতিযোগিতা শুরু হয়। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব তা জানে। মোকতাদিরকে সেভাবেই মূল্যায়ন করে দল। এরই ধারাবাহিকতায় আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আস্থা রেখেছে মোকতাদির চৌধুরীর ওপর। তাঁকে দলের প্রার্থী করা হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরের সীমানা ৩ সংসদীয় আসনে।

যে কোনো জেলা সদরের সংসদীয় আসন রাজনৈতিক দলের কাছে কৌশলগতসহ নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। জেলায় ছয়টি সংসদীয় আসন থাকলেও মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে একাই লড়াই করেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোকতাদির চৌধুরী।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত ও ১৪ দলীয় জোটের সমর্থিত প্রার্থী মোকতাদির চৌধুরীর সঙ্গে এবারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সদর উপজেলা পরিষদের সদ্য পদত্যাগ করা চেয়ারম্যান ও মাদক মামলার আসামি ফিরোজুর রহমান ওলিও। তিনি সম্প্রতি ফেসবুকে নিজের মদের ব্যবসাকে ‘হালাল’ আখ্যায়িত করে সমালোচিত। জনমানুষের নায়ক মোকতাদিরকে হারাতে ওলিও জেলার চিহ্নিত সাম্প্রদায়িক, মাদক কারবারি, দাগী আসামিকে নিয়ে ‘নির্বাচনী তৎপরতা’ চালাচ্ছেন। তার সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, দলের শুভাকাঙ্ক্ষীরা কেউ নেই।

দলের মূল প্রার্থী মোকতাদির হওয়ায় নেতাকর্মী, শুভানুধ্যায়ীসহ জনস্রোত তাঁর দিকে। তবুও ভোটাররা সতর্ক। তারা মনে করছেন, মোকতাদিরের মতো প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ হেফাজতের অলিখিত প্রার্থী ফিরোজুরের কাছে হেরে গেলে হারবে অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি, হারবে বাংলাদেশ। হেরে যাবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের নৌকা প্রতীক।

কারণ, সংস্কৃতির শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাংস্কৃতিক বলয় বা পরিমণ্ডল ৩ সংসদীয় আসনের মধ্যেই। শিল্প, সংস্কৃতিতে নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানগুলো এ আসনের এলাকায় অবস্থিত। বাঙালির সংস্কৃতির বিকাশে এসব সংগঠনে যখন যেভাবে প্রয়োজন, সেভাবেই পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছেন মোকতাদির। ফিরোজুর রহমানের মতো কারো কাছে নেতৃত্ব গেলে সংগঠনগুলো মৌলবাদীদের কবলে চলে যাবে। ধ্বংস হয়ে যাবে জেলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।

সংস্কৃতি সম্পর্কে তেমন ধারণাও নেই ফিরোজুরের, যদিও এ অযোগ্যতা তার অপরাধ নয়। প্রগতিশীলতার মশাল হাতে ২০১১ সালে বিপুল ভোটে এ আসনের সংসদ সদস্য হন স্বপ্নবাজ পুরুষ, সাবেক ছাত্রনেতা মোকতাদির। জেলার অবকাঠামোগত প্রকৃত উন্নয়ন শুরু হয় ’৯৬ সালে। এর সূচনাও তাঁর হাত ধরেই। আর এর জন্যই তাঁকে বলা হয় আধুনিক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রূপকার।

দেশের অন্যতম বিখ্যাত কবি আবু হাসান শাহরিয়ার তাঁকে অভিষিক্ত করেন- ‘তিতাস জনপদে রবিউল একটি নদীর নাম।’ অন্যায়, অবিচার, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও মাদকের বিরুদ্ধে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে মোকতাদির যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। এ লড়াইয়ে বারবার তিনি বিভিন্ন বাধার মোকাবেলা করেছেন সাহসের সঙ্গে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সব শ্রেণি, পেশা, ধর্মের মানুষের কাছে সেজন্যই তিনি নন্দিত।

জেলার হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার জন্য নিয়মিত দেশ-বিদেশের বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিকদের নিয়ে নানা সাংস্কৃতিক উৎসবের আয়োজনও করছেন তিনি। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মানুষের মানবিক বোধ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর বিশেষ স্নেহাসিক্ত এ রাজনীতিবিদ। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অপশক্তির দখলে চলে যাওয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া আবার আওয়ামী লীগের শক্তিশালী দূর্গে রূপান্তরিত হয় মোকতাদিরের নেতৃত্বেই।

হাসান শান্তনু: সাংবাদিক, গণমাধ্যম গবেষক।

শেয়ার করুন