নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ধার্যকৃত নির্বাচনী ব্যয়সীমা মানছেন না দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অনেক প্রার্থী। আসনপ্রতি একজন প্রার্থীর সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা খরচ করার বিধান থাকলেও অনেকে কয়েক গুণ বেশি ব্যয় করছেন। ভোটের মাঠে তারা নানাভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিচ্ছেন কালো টাকা। আওয়ামী লীগের মনোনীত ও ১৪ দলীয় জোটের সমর্থিত অনেক প্রার্থী নির্দিষ্ট তথ্য, প্রমাণসহ কতিপয় স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিরুদ্ধে কালো টাকা ছড়ানোর অভিযোগ করেছেন। তাদের অভিযোগ খতিয়ে দেখে এ পর্যন্ত কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি নির্বাচন কমিশন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগেরও এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য তৎপরতা নেই।
ইসি বলছে, প্রার্থীর জন্য ধার্যকৃত খরচ ও উৎসের বাইরে ব্যয় করলে সর্বোচ্চ সাত বছর থেকে সর্বনিম্ন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান আছে। তবে এখন পর্যন্ত অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নজির নেই। ফলে অভিযুক্তরা পার পেয়ে যাচ্ছেন বলে গুরুতর অভিযোগ ওঠেছে। একইসঙ্গে নষ্ট হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ। প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে নির্বাচনী ব্যবস্থা। এমনকি কালো টাকার মালিক না হওয়ায় বেশ কয়েকটি সংসদীয় আসনে সৎ, যোগ্য ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের প্রার্থীর জয়ী হওয়া কঠিন হয়ে ওঠেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ আজ শনিবার মত ও পথকে বলেন, ‘বাস্তবে প্রার্থীদের ব্যয়সীমা মনিটরিং করা একটু কঠিন। তবে কোনো প্রার্থী ধার্যকৃত ব্যয়সীমার অতিরিক্ত খরচ করলে তা দেখভালের জন্য মাঠে রয়েছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।’ তবে মাঠে থাকলেও দেশের কোনো সংসদীয় আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কালো ছড়ানোর জন্য এখনো পর্যন্ত কারো বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেননি কোনো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।
ইসির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনেক প্রার্থীই ব্যয়সীমার অধিক খরচ করে থাকেন। কিন্তু তার হিসাব ইসির কাছে গোপন করা হয়। ইসিকে অন্ধকারে রেখে দুর্নীতিবাজ, মাদক ব্যবসায়ী, কালো টাকার মালিকেরাই মূলত ভোটের মাঠে টাকার ছড়াছড়ি করেন। টাকার সংকটে অসৎ সম্পদের অধিকারীদের কাছে যোগ্য ও সৎ প্রার্থীদের পরাজিত হওয়ার অসংখ্য নজির আছে। তাই দেশের উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের স্বার্থে ইসিকে এ বিষয়ে এখনোই কঠোর হওয়া উচিত।
গত ১৫ নভেম্বর ভোটারপ্রতি ১০ টাকা খরচের হার নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে ইসি। ইসি সচিব জাহাংগীর আলম স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ৪৪ (খ) অনুযায়ী দলীয় অনুদানসহ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর নির্বাচনী খরচ ২৫ লাখ টাকার বেশি হবে না। নির্বাচনী ব্যয় ভোটারপ্রতি হারে নির্ধারিত হওয়ার বিধান রয়েছে। তাই ইসি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় ভোটারপ্রতি ব্যয় ১০ টাকা নির্ধারণ করল।
আরপিও অনুযায়ী, এই ব্যয় একটি নির্দিষ্ট ব্যাংক হিসাব থেকে বহন করতে হয়। কোনো প্রার্থী নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন কমিশনে জমা না দিলে তার বিরুদ্ধে মামলা করার বিধান রয়েছে।
ইসির নির্বাচন ব্যবস্থাপনা শাখার যুগ্ম-সচিব ফরহাদ আহাম্মদ খান জানান, ‘একাদশ সংসদ নির্বাচনেও ভোটারপ্রতি ১০ টাকা নির্বাচনি ব্যয় ছিল প্রার্থীদের। এবারও ভোটারপ্রতি একই ব্যয় ঠিক করা হয়েছে। ‘
মত ও পথের অনুসন্ধান বলছে, আরপিওর ৭৩ অনুচ্ছেদে বলা আছে, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কর্তৃক দাখিলকৃত বিবরণী বা সম্পূরক বিবরণীতে উল্লেখিত উৎস ভিন্ন অন্য কোনো উৎস থেকে কোনো নির্বাচনী ব্যয় বহন করলে বা ধার্যকৃত ২৫ লাখের অধিক খরচ করলে তিনি দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হবেন। তিনি অনধিক সাত বছর থেকে অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আরপিওর এ ধারার বাস্তবায়ন নেই বলে নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
ফলে ভোটে জয় পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন কালো টাকার একশ্রেণির মালিক ও স্বতন্ত্র প্রার্থী। এসব দুর্নীতিবাজ ও অসৎ প্রার্থীর কাছে থাকা কালো টাকা নির্বাচনের মাঠে ছেড়ে সাদা করছেন সংশ্লিষ্ট প্রার্থীরা। এসব অসৎ প্রার্থীর অধিকাংশই টাকা ব্যাংকেও রাখেন না।
নির্বাচনী ব্যয়সীমার বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার মত ও পথকে বলেন, ‘অনেক হেভিওয়েট ও দুর্নীতিবাজ প্রার্থী কখনোই ইসির ধার্যকৃত ব্যয়সীমা মানেন না। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য হলো, বিষয়য়টি নির্বাচন কমিশন মনিটরিং করে না। এমনকি আজ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় দুর্নীতিবাজেরা ভোটে কালো টাকার প্রভাব দেখান। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন যোগ্য প্রার্থীরা।’