হিজড়া শব্দটি কারও কাছে আতঙ্কের নাম, আবার কারও কাছে তা নিছক ঠাট্টা-মশকরার। অথচ তারা জলজ্যান্ত মানুষ। মূলত ভ্রান্ত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাদের সমাজের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়। অনেক দেশেই হিজড়াদের পুরুষ বা মহিলা না বলে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে অভিহিত করা হয়। এ ছাড়া হিজড়াদের ট্রান্সজেন্ডার, খোজা, হার্মাফ্রোডাইট, শিখণ্ডী, বৃহন্নলা ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়।
হিজড়া বলতেই অধিকাংশ মানুষের চোখে ভেসে ওঠে পুরুষালি আচরণের নারীর পোশাক পরিহিত এক দল লোক। তাদের চালচলন, কথাবার্তা অন্যান্য নারী বা পুরুষ থেকে ভিন্ন। দেখা যায়, বাস, ট্রেন, স্টেশন, রাস্তার আনাচে-কানাচে তারা বিভিন্নভাবে মানুষের কাছে টাকা নিয়ে থাকে। কেউ টাকা দিতে অসম্মতি জানালে, অনেক সময় তাদের সঙ্গে অশালীন আচরণ করতেও দেখা যায় হিজড়াদের। তাদের টাকা উপার্জন করার অন্যতম মাধ্যম হলো সদ্যোজাত সন্তানের জন্য কোনো দম্পতির কাছ থেকে চাঁদা আদায়। তারা তাদের সোর্সের মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে যখন জানতে পারে, কোনো পরিবারে সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে, তারা সে বাসায় গিয়ে উপস্থিত হয় এবং মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে বসে। দেখা যায়, অনেক পরিবারের সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও টাকা দিতে বাধ্য হয়। নইলে তারা শিশুকে নিয়ে নানাভাবে ভয় দেখিয়ে থাকে।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের জরিপমতে, বাংলাদেশে হিজড়ার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। তবে একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপ বলে, এ সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি। ২০১৩ সালের নভেম্বরে সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় সরকার। ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি হিজড়াদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করা হয়। তবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি সত্ত্বেও হিজড়াদের সঠিক কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা নেই। তাই তারা চাঁদাবাজিকেই উপার্জনের পথ ভাবতে বাধ্য হয়। প্রতিটি মানুষেরই খাদ্যের চাহিদা রয়েছে। সে খাদ্য পেতে নানা প্রতিকূলতার মুখে পড়তে হলে ওই ব্যক্তি ভিন্ন পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়।
যে কোনো কাজে নিজেকে উপস্থাপন করতে গেলেও হিজড়াদের নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। এ ছাড়া স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাও তাদের কাছে দুর্লভ। সরকার এ জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূল স্রোতধারায় এনে দেশের সার্বিক উন্নয়নে তাদের সম্পৃক্তকরণে সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের আওতায় ২০১২-১৩ অর্থবছরে ‘হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি’ বাস্তবায়ন শুরু করেছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে ৬৪টি জেলায় হিজড়াদের নিয়ে এ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রতি বছরই এ কার্যক্রমের আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে এ কর্মসূচির ভাতা ও শিক্ষা উপবৃত্তির নগদ সহায়তায় জিটুপি পদ্ধতিতে উপকারভোগীর মোবাইল ফোনের হিসাবে পাঠানো হচ্ছে। তবে এই সুবিধা সবাই ভোগ করতে পারছে না। দেখা যাচ্ছে, কিছু লোক জালিয়াতির মাধ্যমে হিজড়াদের এ কর্মসূচির সুফলে ভাগ বসাচ্ছে।
হিজড়াদের মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করতে এখন পর্যন্ত যে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো গ্রহণ করা হয়েছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তার কৌশলগুলো ত্রুটিপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হলো সরকার বা দাতা সংস্থাগুলো এই প্রকল্পগুলোতে উপকারভোগী জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে না। বাংলাদেশ সরকারের উচিত বিষয়টির প্রতি আশু দৃষ্টি দেওয়া; হিজড়াদের মৌলিক অধিকার পূরণে সর্বাত্মক চেষ্টা করা। যদি তারা সরকার কর্তৃক সব সুবিধা সঠিকভাবে পায়, তবে সাধারণ মানুষের কাছে তারা এতটা হেয় প্রতিপন্ন হবে না এবং সাধারণ মানুষও তাদের দ্বারা হয়রানির শিকার হবে না।
লেখক : শিক্ষার্থী, সরকারি আনন্দমোহন কলেজ, ময়মনসিংহ