৭ জানুয়ারির নির্বাচন থেকে বিরোধী দল সরে দাঁড়ানোর ফলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানা চতুর্থবারের মতো ১৭ কোটি মানুষের দেশটির নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত। আর শেখ হাসিনার বিজয় মানেই প্রেসিডেন্ট বাইডেনের পরাজয়, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রস্থলে ‘গণতন্ত্র’ স্থাপনের জন্য বাংলাদেশকে তাঁর প্রচেষ্টার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছেন।
৭৬ বছর বয়সী শেখ হাসিনা বর্তমানে বিশ্বের যে কোনো নির্বাচিত নারী নেতার চেয়ে বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় আছেন। তিনি কট্টরপন্থীদের দমন করেছেন, সেনাবাহিনীর ওপর বেসামরিক আধিপত্য নিশ্চিত করেছেন এবং দেশকে চরম দারিদ্র্য থেকে বের করে এনেছেন—তাঁর সরকারের এ ধরনের অর্জনের মতো অনেক উন্নয়নশীল দেশের নেতারাও দাবি করতে পারেন না।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের সঙ্গে ফারাক দেখাতে বাইডেন প্রশাসন শেখ হাসিনার সরকারকে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণগ্রেপ্তার করে বিরোধী দলগুলোকে ভয় দেখানোর জন্য শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশে মার্কিন ব্যর্থতা দেখা যাচ্ছে—কারণ দেশটি তাত্ত্বিকভাবে বাইডেনের মূল্যবোধকেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতির জন্য একটি আদর্শ পরীক্ষার ক্ষেত্র ছিল। বিশ্বের অষ্টম সর্বাধিক জনবহুল দেশটি যুক্তিযুক্তভাবে যথেষ্ট বড় কিন্তু ওয়াশিংটনের জন্য কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক স্বার্থকে গণতন্ত্রের প্রচারের ঊর্ধ্বে রাখার জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ নয়।
যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে পোশাক রপ্তানির ওপর বাংলাদেশের অর্থনীতির নির্ভরতা (২০২২ সালে যা ছিল ৩২ বিলিয়ন ডলার) ওয়াশিংটনকে পদক্ষেপ নেওয়ার একটি উপায় করে দিয়েছিল। কিন্তু হোয়াইট হাউস সেই সুবিধাটি ব্যবহার না করে হয়তো অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী ছিল যে—শেখ হাসিনাকে আরও ভালো আচরণের মাধ্যমে ‘লজ্জা’ দেওয়া সম্ভব। এ ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুটি উচ্চপর্যায়ের গণতান্ত্রিক সম্মেলন থেকে বাংলাদেশকে বাদ দিয়েছিলেন বাইডেন। যদিও ওই সম্মেলনগুলোতে যুক্তিযুক্তভাবে খারাপ রেকর্ড থাকা কয়েকটি দেশকে তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
২০২১ সালে ট্রেজারি বিভাগ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বাংলাদেশের অপরাধ ও সন্ত্রাসবিরোধী ইউনিট র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। গত বছর ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের নির্বাচন সম্পর্কে তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন এবং স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করে—এমন ব্যক্তিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল।
হোয়াইট হাউসের জানা উচিত ছিল, কড়া কথা এবং আধা পদক্ষেপ বাংলাদেশের ওপর খুব কম প্রভাব ফেলবে। কিছু হলেই আওয়ামী লীগের পুরোনো গল্পের চক্রে পড়তে হয়েছে যে, দলটি ১৯৭১ সালে ইসলামাবাদকে মার্কিন সমর্থনের পরও পাকিস্তান থেকে দেশকে স্বাধীন করেছে। শেখ হাসিনা দক্ষভাবে আমেরিকান চাপকে মোকাবিলা করেছেন সমর্থক দেশগুলোর একটি অসম্ভাব্য জোট তৈরি করে—রাশিয়া, চীন এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভারত, যেখানে তাঁকে একটি অস্থির দেশে স্থিতিশীলতার ধারক হিসেবে দেখা হয়।
বাংলাদেশকে বৃহত্তর উদারনীতির দিকে ঠেলে দেওয়ার যে কোনো গুরুতর প্রচেষ্টা নয়া দিল্লিকে শুরু থেকেই টেবিলে আনতে বাধ্য করবে। এর বদলে বাইডেন প্রশাসন ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের একটি বড় অংশকে বিচ্ছিন্ন করেছে, যারা বাংলাদেশের ওপর আমেরিকান চাপকে বিপজ্জনক হিসেবে দেখেন। বাংলাদেশে চীনা প্রভাব রোধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়াদিল্লির সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে এমন আশা করেন তাঁরা।
ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে, শেখ হাসিনার সরকারের দুর্বলতা যা-ই হোক না কেন, তাঁর বিকল্পটি আরও খারাপ। শেষবার ক্ষমতায় থাকার সময় বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিষয়ে নীরব ছিল বিএনপি এবং ভারতকে লক্ষ্যবস্তু করা বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে আশ্রয় দিয়েছিল। বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে ইসলামপন্থী দল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোটবদ্ধ, যে দলটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে অকথ্য নৃশংসতার জন্য দায়ী ছিল। ভারতীয়রা আরেকবার বিএনপির সরকারের ঝুঁকি নিতে রাজি নয়।