নতুন সরকারের চ্যালেঞ্জ ও জন-আকাঙ্ক্ষা

মাসুদুজ্জামান

নতুন সরকার গঠনের অনেক আগে থেকেই সুশাসনের ক্ষেত্রে যে নৈরাজ্য দেখা দিয়েছিল, দেশের মানুষ সেসব ক্ষেত্রে পরিবর্তন আশা করছিল। সেই পরিবর্তনের কাজটি এখন নির্ভর করছে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর। সরকার গঠনের পর সরকারের উঁচু পর্যায় থেকে শোনা যাচ্ছে জন-আকাঙ্ক্ষামূলক বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের কথা। তাঁরা একে চিহ্নিত করছেন ‘চ্যালেঞ্জ’ বলে।

প্রত্যাশার কথা এই যে সরকার বিষয়গুলো নিয়ে ভাবছে এবং পরিবর্তন করার কথা বলছে। একটি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকারের কাছ থেকে মানুষ এমন কথাই শুনতে চায়। দেখতে চায়, যেসব ক্ষেত্রে পরিবর্তন দরকার, সরকার সেসব ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটাচ্ছে।

universel cardiac hospital

দ্বাদশ সংসদীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কতটা জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার গঠিত হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও এর দায় শুধু আওয়ামী লীগের ওপর বর্তায় না।

যে দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি, তাদের ওপরও বর্তায়। অর্থাৎ খোলামেলাভাবে বললে, জনপ্রতিনিধিত্বের বিষয়টি শুধু আওয়ামী লীগের ওপর নির্ভরশীল ছিল না, বিরোধী দলগুলোর—বিশেষ করে বিএনপিরও দায় ছিল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার। কিন্তু তারা এবারের সংসদীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। প্রাথমিকভাবে মনে হয়, বিএনপির এই বর্জন রাষ্ট্রশাসনের ক্ষেত্রে সুফল বয়ে আনবে না।

কারণ সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধিত্ব নির্ধারিত হয় নির্বাচনের মাধ্যমে। তাদের যে ‘এক দফা’ দাবি ছিল, সেই দাবির প্রতি অনড় না থেকে তারা যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করত, তাহলে সরকার বা নির্বাচন কমিশন নিশ্চিতভাবেই একটি পরীক্ষার মুখোমুখি হতো। সেই পরীক্ষাটি হতো যথার্থ সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন করার পরীক্ষা। নির্বাচন বর্জনের চেয়ে সেটি হতো সবচেয়ে ভালো বিকল্প। জনমানুষের কাছে নির্বাচনকেন্দ্রিক অভিযোগগুলো কতটা সঠিক, তা অনেকটাই স্পষ্ট হতো।

খুব খারাপ কিছু হলে তারা না হয় সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসত, এইতো? কিন্তু তার পরও বিরোধী সংসদ সদস্য হিসেবে তাদের উচ্চারিত কণ্ঠস্বর দেশের মানুষের কাছে পৌঁছাত। একেবারে নীরব থাকতে হতো না। অথচ এখন তাদের আবার রাজপথে সরব হতে হবে। বিএনপির সাধারণ কর্মী ও কোনো কোনো নেতা সে রকমটাই বলছেন। কিন্তু নিরঙ্কুশ প্রতিনিধিত্ব নিয়ে সুসংগঠিত একটি দল ও সরকারের বিরুদ্ধে সেটি সফল না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বরং বিএনপিকেই থাকতে হবে অস্তিত্ব রক্ষার ঝুঁকির মধ্যে। ফলে বিরোধীদের রাজনীতি যেখানে নতুন করে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, সরকার সেখানে উন্নয়নের পথেই হাঁটবে।

সরকার ও বিরোধীদের সামনে তাই দুই ধরনের চ্যালেঞ্জ অপেক্ষমাণ। দেশের শাসনপ্রক্রিয়ার বাইরে থাকার কারণে বিরোধীদের যেহেতু করণীয় কিছু থাকবে না, ফলে এই চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা তাদের করতে হবে না। যা কিছু চ্যালেঞ্জ তার মুখোমুখি হতে হবে সরকারকে। সংকটের নিরসনও করতে হবে সরকারকেই। সরকার নির্বাচন-পরবর্তী মুহূর্ত থেকেই কী কী সমস্যার সমাধান জরুরি, সেসব বিষয়ে কথা বলতে শুরু করেছে। তাদেরই একজন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। কী সেই চ্যালেঞ্জ, তা-ও তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন। চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে তাঁর কথায়, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক। বিশ্লেষকদের অভিমতও অনেকটা এ রকমই। বলা বাহুল্য, এই চ্যালেঞ্জ বা সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য সরকারকে আন্তরিকভাবে উদ্যোগী হতে হবে। এই উদ্যোগটি আবার গ্রহণ করতে হবে অভ্যন্তরীণভাবে। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সমস্যার সমাধান করা গেলে আন্তর্জাতিক চাপও কমবে। এর অর্থ হলো অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে বৈদেশিক সম্পর্কের বিষয়টি গভীরভাবে সম্পর্কিত।

সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ যেটি হবে, সেটি হচ্ছে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুশাসন, শৃঙ্খলা বিধান এবং সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখা। অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বাণিজ্য ও বাজার। এই মুহূর্তে যেটি সবচেয়ে জরুরি, সেটি হচ্ছে মুদ্রাস্ফীতির হার কমিয়ে আনা। যে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ আমাদের অর্থনীতিতে রক্তপ্রবাহের সঞ্চার করে, ঠেকাতে হবে তার পতন। সেই সঙ্গে ব্যাংকিং খাতকে রুগ্ণ অবস্থা থেকে রক্ষা করতে হবে। এ জন্য প্রথমেই দরকার হবে ঋণখেলাপির মতো বিষয়টিকে অর্থনীতির জন্য সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা। দেশ থেকে প্রচুর অর্থপাচার হয়। এটি কিভাবে রোধ করা যাবে, অর্থমন্ত্রীকে তার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। সেই সঙ্গে আমদানি-রপ্তানিকে কিভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় রাখা যায়, সাধারণ মানুষের ওপর চাপ না বাড়িয়ে কর আদায় বৃদ্ধি করা যায়, সেসব উপায়ও খুঁজতে হবে। তবে এই মুহূর্তে যেটি সবচেয়ে জরুরি, সেটি হচ্ছে মুদ্রাস্ফীতিকে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা। বাজারে সবচেয়ে বেশি সংকট চলছে দ্রব্যমূল্যের ক্ষেত্রে। আওয়ামী লিগের নির্বাচনী ইশতেহারে ২০২২-২৩ বর্ষে মূল্যস্ফীতি দেখানো হয়েছে ৯ শতাংশ। বলা হয়েছে, ২০২৩-২৪ বর্ষে তা ৭.৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের ৭১ শতাংশ মানুষ দ্রব্যমূল্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এই চ্যালেঞ্জটিও তাই হবে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ—সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতাকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা। দ্রব্যমূল্য কমে এলে সাধারণ মানুষের জীবনে স্বস্তি আসবে। সরকারের কাছে এটিই হচ্ছে সাধারণ মানুষের প্রথম চাওয়া। এই চ্যালেঞ্জটি সাফল্যের সঙ্গে মোকাবেলা করতে পারলে খুব স্বাভাবিকভাবে প্রশমিত হয়ে আসবে বিরোধী রাজনৈতিক উত্তাপ। গতি পাবে স্মার্ট বাংলাদেশের উন্নয়নের স্বপ্ন।

প্রধানমন্ত্রী নতুন অর্থমন্ত্রী নিয়োগের বিষয়ে দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছেন আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে। তিনি অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং গত পাঁচ বছর অর্থ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ফলে দেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কেমন, তিনি সেটি ভালোই জানেন। এই সংকট মোকাবেলার চ্যালেঞ্জটিও তিনি ভালোভাবেই মোকাবেলা করতে পারবেন বলে আশা করছি।

আগের মন্ত্রিসভার কয়েকজন মন্ত্রী বাদ পড়েছেন। এবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এখন পর্যন্ত কোনো পূর্ণ মন্ত্রীকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। যাঁদের মাধ্যমে অর্থনীতি ও বাজার নিয়ন্ত্রিত হবে, সেই অর্থ, বাণিজ্য ও কৃষি—তিনজন মন্ত্রীই নতুন। তাঁদের সামষ্টিক অর্থনীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনাকে বুঝে নিয়ে করণীয় ঠিক করতে হবে। এ জন্য তাঁরা যদি সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করেন, তাহলে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করাটা সহজ হবে।

অর্থনৈতিক সংকট, বিশেষ করে দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে চলে এলে রাজনৈতিক উত্তাপও অনেকটাই কমে আসবে। সাধারণ মানুষকে শুধু নতুন নির্বাচনের কথা বলে আন্দোলনে টেনে আনা যাবে বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগ যে ইশতেহার ঘোষণা করেছে, তা যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে একদিকে সুশাসন এবং অন্যদিকে উন্নয়ন—দুই-ই ঘটবে। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক উত্তাপ কমে এলে বৈশ্বিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও টানাপড়েন কমে আসবে। সুশাসনের একটা সুফল পাওয়া যাবে মানবাধিকারের ক্ষেত্রেও। মানবাধিকার নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করে থাকে। তাদের উদ্বেগ কমিয়ে আনা গেলে ভূ-রাজনীতিকেও চ্যালেঞ্জ জানানো যাবে।

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ভূ-রাজনীতির দিক থেকে বিরোধী দুই শিবিরের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। একদিকে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ, অস্ট্রেলিয়ার মতো কয়েকটি দেশ; অন্যদিকে চীন, রাশিয়া ও ভারত। শেষের তিনটি দেশ সব সময় নির্বাচন থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়ে আসছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন আর জাপানের অবস্থান মধ্যবর্তী, তবে তারাও বাংলাদেশকে সমর্থন দিচ্ছে। শেখ হাসিনার সাফল্য হচ্ছে, তিনি সবার সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে যে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা ছিল, সেটি কমিয়ে আনতে পেরেছেন। নির্বাচনের পর তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করার কথা বলেছে। বিশ্বের অন্য রাষ্ট্রগুলোও অভিনন্দিত করেছে।

সব মিলিয়ে তাই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে, বাংলাদেশ সেসব চ্যালেঞ্জ ভালোভাবেই মোকাবেলা করতে পারবে। তবে এ জন্য আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় শেখ হাসিনার সরকারকে প্রয়োজনে কঠোর হতে হবে। দেশের জনমানুষের এখন আকাঙ্ক্ষা একটাই—সুশাসন। আর এই সুশাসনের পথ ধরেই ঘটবে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন। স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে।

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক

শেয়ার করুন