ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের হামলাকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যে, এমনকি এ অঞ্চলের বাইরে উত্তেজনা বেড়েই চলেছে। এবার তাতে যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা। পাকিস্তানের ভূখণ্ডে ইরানের হামলার পর আজ বৃহস্পতিবার পাল্টা হামলা চালিয়েছে ইসলামাবাদ। নজিরবিহীন এ ঘটনার পর তেহরানে পাকিস্তানি দূতকে তলব করা হয়েছে। খবর এএফপির।
ইরান ও পাকিস্তান—দুই দেশের মধ্যে প্রায় ৯০০ কিলোমিটারের সীমান্ত রয়েছে। সীমান্তে পাকিস্তানের দিকে রয়েছে বেলুচিস্তান প্রদেশ। অপর পাশে রয়েছে ইরানের সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশ। পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা ঘটেছে এ অঞ্চলে সীমান্তের দুই পাশে।
ইরানের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আইআরএনএ জানিয়েছে, আজ সিস্তান-বেলুচিস্তানে পাকিস্তানের হামলায় ৯ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে তিন নারী ও চার শিশু রয়েছে। এর আগে গত মঙ্গলবার পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে প্রথম হামলা চালায় তেহরান। তাতে অন্তত দুই শিশু নিহত হয়।
পাকিস্তানের বেলুচিস্তান ও ইরানের সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশে বিচ্ছিন্নতাবাদী নানা গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে। নিজ নিজ ভূখণ্ডে এসব গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করছে দুই দেশই। মঙ্গলবার ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন দিয়ে হামলার পর তেহরানের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা পাকিস্তানি ভূখণ্ডে সশস্ত্র গোষ্ঠী জইশ আল-আদলের ‘সন্ত্রাসীদের’ ওপর হামলা চালিয়েছে। এই গোষ্ঠীর সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক রয়েছে। পাকিস্তানের কোনো নাগরিককে লক্ষ্যবস্তু করা হয়নি।
একদিন পর ইরানের সিস্তান-বেলুচিস্তানে হামলা চালানোর পর পারমাণবিক শক্তিধর পাকিস্তানের ভাষ্যও একই। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বিএলএফ ‘সন্ত্রাসীদের’ বিভিন্ন আস্তানায় হামলা চালিয়েছে তারা। ড্রোন ও রকেট ব্যবহার করে এ হামলা চালানো হয়। পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও স্বার্থের কথা মাথায় রেখে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
পাকিস্তানের হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ইরান। হামলার প্রতিবাদ জানাতে এবং পাকিস্তান সরকারের কাছে এর ব্যাখ্যা চাইতে তেহরানে দেশটির চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সকে তলব করা হয়েছে। এর আগে ইরানের হামলার প্রতিবাদে পাকিস্তান ইসলামাবাদ থেকে দেশটির রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার এবং তেহরান থেকে নিজেদের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে। এদিকে ইরানের হামলার প্রতিবাদে আজ ইসলামাবাদে বিক্ষোভ হয়েছে।
ইসলাবাদ ও তেহরানের পাল্টাপাল্টি হামলার আগে থেকেই মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে নিজেদের সামরিক তৎপরতার জানান দিচ্ছিল ইরান। সম্প্রতি সিরিয়ায় জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করে দেশটি। তারা হামলা চালিয়েছে ইরাকেও। তেহরানের ভাষ্য, ইরাকে হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল ইসরায়েলের গুপ্তচরদের একটি ঘাঁটি। এ ছাড়া গাজা সংঘাত ঘিরে সক্রিয় রয়েছে ইরানপন্থী বিভিন্ন গোষ্ঠী।
ইরানের এ কর্মকাণ্ডের মধ্যেই দেশটির সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে এগিয়ে আসার ইঙ্গিত দিয়েছে প্রতিবেশী দেশগুলো। চলতি সপ্তাহে সুইজারল্যান্ডের দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদোলাহিয়ানের সঙ্গে দেখা করেছেন পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান আনোয়ার-উল-হক কাকার। তবে ইসলামাবাদ জানিয়েছে, ইরানের হামলার পর দাভোস সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কাকার।
পাল্টা হামলার পর ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জলিল আব্বাস জিলানি। এর পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের সাবেক প্রতিরক্ষাসচিব লেফটেন্যান্ট জেনারেল আসিফ ইয়াসিনের ধারণা, দুই দেশ এখানেই হামলার ইতি টানবে। তবে বিশ্লেষকদের অনেকের আশঙ্কা, পাল্টাপাল্টি হামলা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট অব পিসের দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তাবিষয়ক গবেষক আসফান্দির মির রয়টার্সকে বলেন, পাকিস্তানে হামলার মাধ্যমে ইরান কী চায়, তা স্পষ্ট নয়। মোটাদাগে এ অঞ্চলে ইরানের চরিত্র বিশ্লেষণ করে বলা যায়, এই উত্তেজনা বাড়তে পারে। তেহরানের জন্য উদ্বেগের বিষয়টা হবে যে পাকিস্তান সীমা অতিক্রম করে তাদের ভূখণ্ডে হামলা চালিয়েছে। এটি এমন একটি সীমা, যা ইরানের শত্রুদেশ যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েলও অতিক্রম করতে সতর্ক থাকবে।
আজকের হামলার মধ্য দিয়ে গত শতকের আশির দশকের পর ইরানের ভূখণ্ডে প্রথমবারের মতো বিদেশি কোনো শক্তি আঘাত হানল। ওই সময়ে ইরানে হামলা চালিয়েছিলেন ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন। এর জেরে আট বছর ধরে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল।
পাল্টাপাল্টি হামলায় উত্তেজনা বৃদ্ধির মধ্যে পাকিস্তান ও ইরানকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে বিভিন্ন দেশ। পরিস্থিতি সামাল দিতে দুই দেশের মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দিয়েছে চীন। তেহরান ও ইসলামাবাদ—দুই পক্ষের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বেইজিংয়ের।
ইরান ও পাকিস্তানকে ‘সর্বোচ্চ সংযত’ থাকার আহ্বান জানিয়েছে রাশিয়াও। আজ রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কোনো সার্বভৌম দেশের সীমান্তের বাইরে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের ভিত্তিতে করা উচিত।
রাশিয়ার মতো ভাষ্য তুরস্কেরও। দুই পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়ে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদা বলেছেন, আমি আজ (বৃহস্পতিবার) সকালে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। তারা তাদের পদক্ষেপের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন। দুই পক্ষই বলেছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে।