মাটিদূষণ : মানবসভ্যতার বিপর্যয় অনিবার্য

এ এইচ এম ফিরোজ আলী

প্রতীকী ছবি

মাটির তৈরি মানুষের জীবন ও মরণ মাটিতেই। মাটি প্রকৃতির মহামূল্যবান সম্পদ। মাটি-বায়ু-পানি একটি অন্যটির পরিপূরক। মাটি ছাড়া খাদ্য উত্পাদন হয় না, মাটি থেকেই জীব খাদ্য সংগ্রহ করে। মাটি-মৃত্তিকা-ভূমি সমার্থক। ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের নরম অংশ হচ্ছে, ‘মাটি’। প্রাকৃতিক ও রাসায়নিক পরিবর্তনের মাধ্যমে পাথর থেকে মাটির উদ্ভব। ভূমি ক্ষয়, প্রাকৃতিক ও রাসায়নিক কারণে মাটির পরিবর্তন হয়। প্রাচীনকালের মাটি এখন পাওয়া যায় না। ভূতত্ত্ববিদদের মতে, কঠিন শিলা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে মাটিতে পরিণত হয়। শিলার সঙ্গে জৈব পদার্থ মিশ্রিত হয়ে মাটির সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশের মাটি ‘সোনার চেয়েও খাঁটি’। এই মাটি দূষিত হলে পরিবেশ ও মানবসভ্যতা দূষিত হয়।

মাটিরও শ্রেণি আছে। এঁটেল মাটি, বেলে (বালু) মাটি, দোঁআশ মাটি, পলিমাটি। এঁটেল মাটিতে বালু অপেক্ষা পলি ও কাদা বেশি থাকে। এই মাটি পানিতে গলে আটা বা ময়দার মতো জটলা লেগে থাকে। বেলে মাটিতে বালুর পরিমাণ বেশি থাকে, যে কারণে পানি ধরে রাখতে পারে না। সাধারণত নদী বা সমুদ্রের চরে এই মাটি থাকে। দোঁআশ মাটি বালু ও কাদা মিশিত থাকে। বন্যা ও বৃষ্টির কারণে পাহাড়-পর্বত-নদীর তীরভূমি ধসে পানির সঙ্গে ভেসে আসা মলিন মাটি, বন্যার পানি স্থির হলে জমিতে যে নরম মাটি দেখা যায়, এটাই পলিমাটি। পলিমাটি জমির উর্বরাশক্তি বাড়ায়। কাদা ও পলিমাটি প্রায় এক রকম—নরম, দানা ছোট ও মিহি। এই মাটিতে বাতাস তেমন ঢুকতে পারে না, ফলে ফসল কম হয়। কিন্তু ধান উত্পাদন হয় বেশি। মানুষসহ সব প্রাণী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল। উদ্ভিদ খাদ্য বা পুষ্টির জন্য মাটির ওপর নির্ভরশীল। উদ্ভিদের মাটি ছাড়া খাদ্য সংগ্রহের বিকল্প নেই। মাটির নিচে বসবাসকারী পৃথিবীর এক-চর্তুথাংশ জীববৈচিত্র্যও মাটি থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে থাকে। পৃথিবীতে আকাশ ও জলের চেয়ে স্থলভাগের মাটিতে সব প্রাণীর বাস।

মাটি জড় পদার্থ হলেও প্রাণ ও জীবন আছে। মাটির জীবন-যৌবন আমাদের মতোই। মাটির ক্ষতি মানে মানবসভ্যতার ক্ষতি। মাটিতে খনিজ পদার্থ ৪৫ ভাগ, জৈব ৫ ভাগ, বায়ু ২৫ ভাগ, পানি ২৫ ভাগ থাকলে এই মাটি সুস্থ ও জীবন্ত মাটি। এই পরিমাণের ব্যত্যয় ঘটলে মাটি অসুস্থ, রোগাক্রান্ত হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের মাটিও ভালো নেই। মাটিদূষণ মানে মাটির মৃত্যু। ফসলি জমিতে আবশ্যিক জৈব পদার্থ কমে গেলে মাটি নিথর হয়ে যায়। মাটি দূষিত হলে পানি ও বায়ু দূষিত হয় এবং শেষ পরিণতি পরিবেশের ভয়াবহ বিপর্যয়।

মাটিদূষণ সব দেশে এক রকম হয় না। বাংলাদেশে মাটিদূষণের অনেক কারণ। পরিবেশবিদেরা মাটিদূষণ নিয়ে খুবই চিন্তিত এবং শঙ্কিত। আমাদের দেশে পানি ও বায়ুদূষণ নিয়ে রিতিমতো হইচই হচ্ছে। কিন্তু মাটিদূষণ নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। গণমাধ্যমও একেবারে নীরব। মাটি যে দূষিত হয়, এ দেশের ৮০ ভাগ মানুষের কোনো ধারণা নেই। কৃষকের কথা বলাই বাহুল্য। মাটিদূষণের প্রধান ও অন্যতম কারণ জমির উপরিভাগের মাটি ‘টপ সয়েল’ কেটে নিয়ে ইট তৈরি করে মাটিকে চরমভাবে দূষিত করা হয়েছে। এসব জমিতে কয়েক যুগ পরেও কোনো ফসল হয় না। বর্তমানে বাসাবাড়ি ও রাস্তা নির্মাণে ভূমির উপরিভাগ কেটে নেওয়া হচ্ছে। মাটিদূষণের বর্তমানে প্রধান কারণ হচ্ছে পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার। ইতিমধ্যে মাটির নিচে কয়েক ফুট পলিথিন ও প্লাস্টিকের স্তর জমে আছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, পলিথিন ও প্লাস্টিক সমুদ্র ভরাট করে দিচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে খাল-বিল, নদী-পুকুর খননে অনেক গভীরেও তরতাজা পলিথিন পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া ইলেকট্রিক বর্জ্য, শিল্পের বর্জ্য, অ্যাসিড বৃষ্টি, মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার, কীটনাশক, ময়লা-আবর্জনা, কয়লা, সিসা, হাঁস-মোরগের বিষ্ঠা, মলমূত্র, লবণাক্ত পানি, পেট্রোলিয়াম, ভারী ধাতু মাটিদূষণের বড় হাতিয়ার। ফসলি জমিতে যেসব রোগে ফসল নষ্ট হয়, তা মাটিদূষণের কারণেই। মাটিতে একধরনের অসংক্রামক রোগও ফসলকে আক্রমণ করে।

জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—শিল্প, খনি, কৃষিকাজে দুর্বল ব্যবস্থপনা মাটিকে বিষিয়েছে। মাটিদূষণ নিয়ে অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেরও কোনো সচেতনতা নেই। মাটিতে রাসায়নিক উপাদানের পরিমাণ ও পুষ্টিগুণ কমেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মাটির যত্ন না নেওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এতে খাদ্য উত্পাদনে দীর্ঘমেয়াদি বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে, সারা দেশের মাটিতে প্রয়োজনের তুলনায় নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সালফার, দস্তার ঘাটতি রয়েছে। অঞ্চলভেদে ক্যালশিয়াম, ম্যাগনেশিয়ামের অনেক অভাব রয়েছে। এশিয়া প্যাসিফিকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের মাটিতে জৈব পদার্থের উপস্থিতি দুই ভাগের নিচে। যেখানে পাঁচ ভাগ জৈব পদার্থ মাটির জন্য উত্তম এবং কমপক্ষে দুই ভাগ থাকা আবশ্যক। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন ও দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জরিপে আমাদের দেশের মাটিতে ১১টি ভারী ধাতুসহ সহনীয় মাত্রার চেয়ে ৩৮ গুণ বেশি কোভাল্ট, ১১২ গুণ বেশি ক্রোমিয়াম খুঁজে পেয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় ১০ লাখ লেড (সিসা) ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, শিল্প কারখানা, খনি, কৃত্রিম সার, নর্দমার ময়লা, বর্জ্য, পানিতে আর্সেনিক, লৌহ, দস্তা, টিন, ম্যাগনেশিয়াম মাত্রাতিরিক্তভাবে মাটিতে মিশে যাওয়ায় মাটি চরমভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে। অনুজীব, উদ্ভিদ ও প্রাণীকূলের জন্য মাটিদূষণ খুবই ক্ষতিকর। তারা আরো বলেছেন, বর্তমানে পলিথিন ও প্লাস্টিকের কারণে বাংলাদেশে ৩৯ থেকে ৪২ ভাগ এলাকায় মাটির উর্বরতা কমেছে বলে উল্লেখ করা হয়। ধান চাষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান গন্ধক ও দস্তার পরিমাণ দেশের ৪০ ভাগ এলাকায় কম।

মাটির প্রধান শত্রু পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকলেও উত্পাদন, বিপণন, ও ব্যবহার থেমে নেই। ঢাকায় প্রতিদিন ২ কোটি পলিথিন এবং সারা দেশে প্রতিদিন ২৪ হাজার টন পলিথিন ও প্লাস্টিকের বর্জ্য জমা হচ্ছে। এসব বর্জ্য, বৃষ্টি ও বন্যার পানিতে ভেসে গিয়ে নদী-সমুদ্র-খাল-বিল-জলাশয় ও জমিতে মাটির সঙ্গে মিশে নিচে জমা হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, পলিথিন ও প্লাস্টিক যতভাবেই প্রক্রিয়া করা হয় না কেন, তা সহজে পচে না বা নষ্ট হয় না। মাটির নিচে পলিথিন পচতে ৪০০-৫০০ বছর লাগে। পলিথিন ও প্লাস্টিক মাটির নিচের কয়েক ফুট গভীর পর্যন্ত মাটিদূষণের জন্য দায়ী। আমাদের সমাজব্যবস্থাও এমন যে, পান থেকে চুন খসলেই একান্নবর্তী পরিবারগুলো ভেঙে হাওরের মধ্যে বাড়ি-দালান তৈরি করে ময়লা-আবর্জনা. মলমূত্র, বর্জ্য দিয়ে হাজার হাজার একর জমি নষ্ট করছে। গাছপালার ছায়ায় মাটিতে নাইট্রোজেন কমে গেলে মাটি দূষিত হয়ে পড়ে।

২০২০ সালে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যবহারের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতার চিত্র ফুটে ওঠে। ২০০২ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর পলিথিন শপিং ব্যাগ উত্পাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রি ও মজুত নিষিদ্ধ করে দেয়। এ আইনের ২৫ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিনসামগ্রী উত্পাদন করেন, তাহলে ১০ বছরের জেল, ১০ লাখ টাকা জরিমানা। বাজারজাত করলে ছয় মাসের জেল ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান থাকলেও আইন বইয়ের পাতায় ঘুমিয়ে আছে। পলিথিন ও প্লাস্টিক শুধু মাটি ধ্বংস করে না, গরম খাবারও রাখলে বিষফেলন তৈরি হয় এবং এই বিষফেলন থাইরয়েড হরমোনকে বাধা দেয়। এতে লিভার, কিডনি বিকল হয়ে যায়। বিষফেলন রক্তের মাধ্যমে গর্ভবতী নারীর ভ্রূণে গেলে ভ্রূণ বা বাচ্চা নষ্ট হয়ে যায়। অনেক নারী বন্ধ্যা হন এবং কেউ কেউ বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম দেন। পলিথিন বা প্লাস্টিকের পণ্য দিয়ে ফ্রিজে যে কোনো খাবার রাখলে সেই খাবার খেলে সমান ক্ষতি হয়। কৃষক জমিতে সার ও কীটনাশক ব্যবহার এবং মাটিতে কাজ করলে দূষিত মাটি নখে ঢুকে যায় এবং শ্বাসনালি দিয়ে বিষাক্ত গ্যাস প্রবেশ করে ক্যানসার, আলসার, ডায়াবেটিস, চর্মরোগ, চোখের রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। বর্তমানে ডায়াবেটিস ও ক্যানসারে দেশের হাসপাতালগুলোতে রোগী সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। এসব মাটিদূষণের কারণেই হচ্ছে বলে বিজ্ঞমহলের ধারণা। বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী সাময়িকী ফোর্বস তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, পৃথিবীতে খুব দ্রুত মাটির গুণ নষ্ট হওয়ার সংবাদ মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য দুঃসংবাদ। মাটির উর্বরতা নষ্ট হলে কার্বণ ধারণের ক্ষমতা হ্রাস ও মাটির জীববৈচিত্র্য কমে যাওয়ায় বাস্তুতন্ত্রে তৈরি হচ্ছে বিশৃঙ্খলা। বর্তমানে স্বাস্থ্যকর মাটির আকাল পড়েছে বিশ্ব জুড়ে।

পৃথিবীর অনেক দেশে মাটিদূষণ রোধে গণসচেতনতা সৃষ্টি হলেও আমরা বেমালুম ভুলে গেছি। এ দেশের মাটি ও মানুষ রক্ষায় এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন জরুরি। (১) ভূমি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দেশের উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন সভা-সমাবেশ-সেমিনারের মাধ্যমে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। (২) পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যবহার চিরতরে বন্ধ ও আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। (৩) কাগজ, পাটের চট ও কুটিরশিল্পের মাধ্যমে বাঁশ-বেতের তৈরি পণ্য ব্যবহার বাড়াতে হবে। (৪) কৃষকদের সচেতনতায় প্রশিক্ষণ ও মাত্রাতিরিক্ত সার, কীটনাশক ব্যবহারের পরিবর্তে জৈব সার ব্যবহারে উত্সাহী করা। কৃষিজমিতে বাড়িঘর তৈরি না করতে আইন প্রণয়ন করা। (৫) যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা না ফেলে নির্দিষ্ট গর্তে ফেলে মাটিদূষণ রোধের অভ্যাস সব নাগরিকের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে।

লেখক : কলামিস্ট ও সমাজ বিশ্লেষক

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে