কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অ্যালগরিদমের সাহায্যে সিনেমার গল্প ও স্ক্রিপ্ট পুনরায় সাজানো যায়। গল্পের মোড় ঘোরানোর মতো পরিবর্তন করতেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশেষভাবে সহায়তা করে। একই সঙ্গে গল্পের চরিত্রের এক্সপ্রেশনের সঙ্গে কম্পিউটারের মধ্যে সেগুলোর মডিফিকেশনেও বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ঘিরে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী যেমন উত্তেজনা ছড়িয়েছে, তেমনি কিছু আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। এক্ষেত্রে শিল্প খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার ও রূপান্তরের ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে।
‘দ্য হলিউড রিপোর্টার’-এর মতে, সিনেলাইটিক নামের এক স্টার্টআপের সঙ্গে চুক্তি করেছে ওয়ার্নার ব্রাদার্স নামক চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস-ভিত্তিক স্টার্টআপটির মূল কাজ হলো কোনো চলচ্চিত্র ব্যবসাসফল হবে কি না, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তা পূর্বানুমান করা। কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণের দায়িত্ব নেবে কি না, সে সিদ্ধান্তগ্রহণে চুক্তিসই পর্বেই ওয়ার্নার ব্রাদার্সকে সাহায্য করবে সিনেলাইটিকের অ্যালগরিদম। সিনেলাইটিকের ব্যবহারকারীরা সফটওয়্যারে চলচ্চিত্রের ঘরানা, বাজেট, কলাকুশলীদের নামসহ অন্যান্য বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে দেখতে পারেন কোনো উপাদানে পরিবর্তন আনলে কী হয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সাধারণত বিদ্যমান তথ্যনির্ভর। আগের চলচ্চিত্রগুলোর তথ্য ইনপুট দিয়ে প্রযুক্তিটিকে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে। চলচ্চিত্রে নির্মাণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বিনিয়োগের একটা সুবিধা হলো, কম জটিল বিশ্লেষণের কাজটি মানুষের চেয়ে প্রযুক্তি ভালো করতে পারে। ২০১৯ সালে ক্যাপ্টেন ‘মার্ভেল’ চলচ্চিত্রে স্যামুয়েল এল জ্যাকসনের বয়স প্রায় ২৫ বছর কমিয়ে আনা হয়েছিল। কারণ দর্শকরা চান তাদের অতি পরিচিত অভিনেতাই বারবার চলচ্চিত্রে থাকুক, যাতে করে ঐ আবেদন থেকে তারা বিচ্ছিন্ন না হয়ে যান।
মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদমের সাহায্যে চলচ্চিত্র নির্মাতারা এখন গল্পের জন্য ধারণা তৈরি, স্ক্রিপ্ট বিশ্লেষণ এবং এমনকি চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য ভার্চুয়াল চরিত্র এবং সেট তৈরি করতে পারেন। ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট এবং পোস্ট-প্রোডকশনের মতো কিছু প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয় করে চলচ্চিত্রনির্মাতারা ব্যয়বহুল মানবশ্রম এবং সরঞ্জামের ওপর তাদের নির্ভরতা কমাতে পারেন, যা নতুন নির্মাতাদের শিল্পে প্রবেশ করা এবং উদ্ভাবনী বিষয়বস্তু তৈরি করা সহজ করে তুলেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অনুবাদ কৌশলের সাহায্যে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাতারা অন্যান্য দেশের অংশীদারদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং সহযোগিতার পরিধি বাড়ানোর সুযোগটি নিতে পারেন। এটি সাংস্কৃতিক সংযোগ, বিনিময় এবং সৃজনশীলতার জন্য নতুন দিগন্ত উন্মুক্ত করেছে। তবে, চলচ্চিত্র শিল্পে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতার কারণে বিষয়বন্তুর মান, সৃজনশীলতা এবং মৌলিকত্ব হারাতে পারে। নির্মাতাদের জন্য চলচ্চিত্রশিল্পে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারের সম্ভ্যাব্য ঝুঁকি এবং নৈতিক বিবেচনার মিথষ্ক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ। দায়িত্বশীলভাবে ব্যবহার না করলে এটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই চলচ্চিত্রনির্মাণ প্রক্রিয়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মানব সৃজনশীলতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি। এর মানে হলো ফিল্ম প্রোডাকশনের নির্দিষ্ট কাজগুলো স্বয়ংক্রিয় করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করা। তবে চলচ্চিত্রনির্মাতাদের লেখা এবং পরিচালনার মতো সৃজনশীল কাজগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে হবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গল্পকে ভিত্তি করে সায়েন্স ফিকশন সিনেমা নির্মাণের ইতিহাস নতুন নয়। যত দিন যাচ্ছে, ততই বাড়ছে এমন নির্মাণের সংখ্যা। গল্পের ধারণা তৈরি, ভাচুর্য়াল চরিত্র এবং সেট তৈরি করতে পারেন নির্মাতারা। ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট এবং পোস্ট-প্রডাকশনের মতো কিছু প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে করে নির্মাতার ব্যয়বহুল মানবশ্রম ও সরঞ্জামের ওপর নির্ভরতা কমাতে পারেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অনুবাদ কৌশলেরও তারা সহযোগিতা নিতে পারেন। আধুনিককালে চলচ্চিত্রশিল্প সমগ্রবিশ্বে শিক্ষাবিস্তার, জাতিগঠন ও উন্নত সমাজ বিনির্মাণে শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত। যে দেশের চলচ্চিত্রশিল্প নব নব প্রযুক্তি ও যুগমানসকে যত বেশি সার্থকভাবে এবং বৈচিত্র্যের সঙ্গে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে, সেসব দেশের চলচ্চিত্রশিল্প প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা লাভেওর সমর্থ হয়েছে। একই সঙ্গে বিশ্ব চলচ্চিত্রশিল্পের ইতিহাসে স্বতন্ত্র অবস্থান করে নিতেও সক্ষম হয়েছে। বর্তমান যুগমানস আরো জটিল এবং নানামুখী বৈচিত্র্যে ভরপুর। তাই সমসাময়িকতাকে ধারণ এবং চলচ্চিত্রের পর্দায় সেই ইমেজ চিত্রায়ণ বিদ্যমান জ্ঞানকাঠামো এবং অবকাঠামোর মধ্যে অবস্থান করে সম্ভব নয়।
বিশ্বব্যাপী চলচ্চিত্রমাধ্যমে প্রতিনিয়ত প্রযুক্তিগত ও চলচ্চিত্রিক শৈলীর যেসব পরিবর্তন ঘটছে, তার সঙ্গে এ দেশের চলচ্চিত্রশিল্প সংশ্লিষ্টদের পরিচিত হতে হবে। বর্তমান সময়ে সৃজনশীল বহু ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পদচারণা লক্ষ করা যায়। ‘ডাল-ই’ এবং ‘চ্যাটজিপিটি’র মতো প্রযুক্তি পেছনে থাকা প্রতিষ্ঠানটির নাম হচ্ছে ‘ওপেন এআই’। মানবতার প্রয়োজনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগাতে নিত্যনতুন বিষয়ের নির্মাণে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিনিয়ত কাজ করছে। কিন্তু ২০২২ সালের শেষের দিকে ‘ডাল-ই ২’ প্রকাশ পাওয়ার পর জনমনে এর সম্পর্কে আগ্রহ বেড়ে যায়। ডাল-ই ২ এমন একটি অনলাইন টুল; যা ব্যবহার করে মানুষ বিভিন্ন ‘টেক্সট ইনপুট’ প্রদানের মাধ্যমে বিভিন্ন ছবি তৈরি করতে সক্ষম হবে।
যদি বিশ্বব্যাপী এআই আর্ট জেনারেটরের জনপ্রিয়তা বাড়তেই থাকে, তাহলে শিল্পীদের যথাযথভাবে সুরক্ষা প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় কপিরাইট আইনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে কপিরাইট আইন আনা উচিত। সম্প্রতি ‘আর্টিস্ট রিপ্লেসমেন্ট’ বা শিল্পী প্রতিস্থাপনের ধারণাটি ব্যাপকভাবে শোনা যাচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের যেখানেই নিয়ে যাক না কেন, প্রকৃত শিল্পীদের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদকে সব সময় সুরক্ষা দিতে হবে। চলচ্চিত্রপ্রযুক্তির বিশ্বব্যাপী যে উন্নয়ন ঘটছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পের উন্নয়ন ঘটাতে হবে।
লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
![](https://cloud.matopath.com/mop/2022/03/onnesha-ad.jpeg)