যে কারণে চীন ও ভারতের কাছে রাখাইন অনেক গুরুত্বপূর্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক

মিয়ানমারের চিন, শান, রাখাইনসহ বেশ কয়েকটি অঞ্চলে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে জান্তা বাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ চলছে। বিশেষ করে রাখাইনে বিদ্রোহী আরাকান আর্মির (এএ) প্রভাব দিন দিন বাড়ছে। প্রতিদিনই জান্তার ঘাঁটি দখলের খবর উঠে আসছে গণমাধ্যমে।

রাখাইনে আরাকান আর্মির কর্তৃত্ব যত বাড়বে, এই অঞ্চল ঘিরে ভূরাজনীতি তত বেশি জটিল হবে- এমন আশঙ্কাই করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। আরাকান আর্মির লক্ষ্য, ফেডারেল রাষ্ট্রব্যবস্থার মাধ্যমে স্বাধীনতা বা স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা। এতে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে যেমন জটিলতা তৈরি হবে, তেমনি মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশ ভারত ও চীনের ভূরাজনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নেও দেখা দেবে নানা টানাপোড়েন।

প্রতিনিয়ত যেভাবে বিদ্রোহীরা সীমান্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ঘাঁটি দখলে নিচ্ছে, তাতে এমনিতেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। কারণ মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলটি ঘিরে ভারত-চীনের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত। এই এলাকায় বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে তাদের। বিশ্লেষকদের মতে, মিয়ানমারের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় রাখাইন প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য অনেক বেশি আগ্রহের জায়গা।

মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূলে রাখাইনের অবস্থান। এর আয়তন প্রায় ৩৬ হাজার ৭৬২ কিলোমিটার। রাখাইন প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকে এতটাই সমৃদ্ধ এবং এর কৌশলগত অবস্থান এত গুরুত্বপূর্ণ যে, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সব শক্তিরই লোভনীয় দৃষ্টি রয়েছে এখানে।

এই অঞ্চলের সমুদ্রসীমাকে বঙ্গোপসাগরের সবচেয়ে সমৃদ্ধ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এখানে ‘থান শ’ নামে এক বিশাল গ্যাসক্ষেত্র আছে। ২০০৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি দাইয়ু রাখাইন উপকূলে প্রায় ৪ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুত আবিষ্কার করে।

মিয়ানমারের বঙ্গোপসাগর-তীরবর্তী প্রদেশটিতে কানেক্টিভিটি ও জ্বালানি খাতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ রয়েছে চীনের। ২০০৪ সালে রাখাইনে বিপুল জ্বালানি সম্পদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর এটি চীনের মনোযোগ আকর্ষণ করে।

২০০৮ সালে এই গ্যাস কেনার জন্য চীনের রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম করপোরেশন সিএনপিসি-কে অনুমতি দেয় মিয়ানমারের সামরিক সরকার। এরপর রাখাইন উপকূলের অফশোর গ্যাসক্ষেত্র থেকে উত্তোলিত গ্যাস সরাসরি নিজ ভূখণ্ডে সরবরাহে চীন-মিয়ানমারের গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়।

২০১৩ সালে রাখাইনের সঙ্গে প্রাকৃতিক গ্যাসের পাইপলাইন সংযোগ সম্পন্ন করে চীন। সেসময় মিয়ানমার-চীন গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে রাখাইনের কিয়াউকফু বন্দর থেকে চীনের ইউনান প্রদেশে গ্যাস পরিবহন করা হয়।

রাখাইনের আরেকটি আকাঙ্খিত প্রাকৃতিক সম্পদ হলো তেল। ২০০৮ সালে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে চীন তার গ্যাস পাইপলাইনের সমান্তরালে একটি অপরিশোধিত তেল পাইপলাইন নির্মাণের কাজও শুরু করে। দুই বছর বিলম্বের পর চীন-মিয়ানমার পাইপলাইন রাখাইনের মেড আইল্যান্ড বন্দর থেকে ইউনানের দিকে ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে তেল পরিবহন শুরু করে।

এসবের পাশাপাশি রাখাইনের পাশেই বঙ্গোপসাগরের প্রকৃতিক সম্পদ তো আছেই। রাখাইনের প্রাকৃতিক সম্পদ এই অঞ্চলে চীনের উপস্থিতি বাড়ায়। তবে আগ্রহের অন্যতম বড় কারণ হলো, এই অঞ্চলটি চীনের উচ্চাভিলাষী ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড-ওবিওআর পরিকল্পনার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। চীনের এ ধরনের উদ্যোগের লক্ষ্যই হলো বেইজিং থেকে ইউরোপ, আফ্রিকা এবং এশিয়া মহাদেশে নতুন রুট এবং বাণিজ্যিক নেটওয়ার্কের বিকাশ ঘটানো।

রাখাইনে পাইপলাইন নির্মাণের আরেকটি ভূকৌশলগত কারণ, বাণিজ্য পরিচালনায় এটি চীনের জন্য মালাক্কা প্রণালীর বিকল্প পথ হিসেব কাজ করবে। যদিও মালাক্কা প্রণালীটি চীনের জন্য আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে পৌঁছানোর সবচেয়ে ছোট পথ। যদিও এই পথে জলদস্যুর ভয় রয়েছে। কিন্তু, রাখাইনের পাইপলাইনের মাধ্যমে আবুধাবি, ইরাক, ইরান ও সৌদি আরব থেকে তেল দ্রুত ও নিরাপদে চীনে পৌঁছাতে সক্ষম।

এসব কারণে চীন-মিয়ানমার তেল ও গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পে আনুমানিক ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের পাশাপাশি বেইজিং রাখাইনের কিয়াউকফু বন্দরে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির কাজ শুরু করে ২০১৫ সালে।

চীনের দক্ষিণাঞ্চল ও বঙ্গোপসাগরের মধ্যে কানেক্টিভিটি তৈরিতে নির্মাণ হচ্ছে রেল ও সড়কপথ এবং বন্দর। মহাপরিকল্পনা বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের অংশ হিসেবে নেয়া এ প্রকল্পের আওতায় রাখাইনে বঙ্গোপসাগরের তীরে নির্মাণ করা হচ্ছে কিয়াউকফু বন্দর।

বন্দরটিকে চীনের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে রেল ও সড়কপথে। রাখাইনে সংঘাতের তীব্রতা বাড়ায় এর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন চীন। আরাকান আর্মি রাখাইনে কিয়াউকফু সমুদ্রবন্দর প্রকল্প এলাকায় নভেম্বর থেকে জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই করছে। কিয়াউকফু টাউনশিপের কাছে রামরি টাউনশিপে চলমান লড়াইও এই প্রকল্পের অগ্রগতি ব্যহত করছে।

বলা হয়, রাখাইন এমন একটি অঞ্চল যেখানে চীনের সঙ্গে ভারতের অবস্থান মুখোমুখি। রাখাইনে ভারতের আগ্রহ নতুন নয়। ২০০৪ সালে ভারতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি ‘গেইল’ এবং ভারতের তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানির একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘ওএনজিসি ভিদেশ’ চীনা কোম্পানি দাইয়ুর অংশীদার ছিল।

গ্যাস খুঁজে পাওয়ার পর ভারতীয় এই দুই কোম্পানিসহ এশিয়ার কোম্পানিগুলোর একটি কনসোর্টিয়াম এই এলাকাকে প্রাকৃতিক গ্যাস উন্নয়ন প্রকল্পে পরিণত করে। সেসময় ভারতীয় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোও মিয়ানমার-চীন গ্যাস পাইপলাইনে বিনিয়োগ করে।

২০০৫ সালে ইয়াঙ্গুনে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে ভারতের মিজোরাম, ত্রিপুরা হয়ে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত একটি গ্যাস পাইপলাইন স্থাপনের বিষয়ে আলোচনা হয়। প্রস্তাবটি নিয়ে শুরুতে বাংলাদেশের তেমন অনাগ্রহ ছিল না।

বাংলাদেশ ও ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে পাইপলাইনে গ্যাস রফতানিতে সম্মতিও দেয় মিয়ানমার। এক বিবৃতিতে জানানো হয়, আন্তর্জাতিক একটি কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে এ পাইপলাইন পরিচালিত হবে। সম্পদের পর্যাপ্ততা, নিরাপত্তা ও সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক সুবিধার ভিত্তিতে পাইপলাইনের রুট নির্ধারিত হবে।

বাংলাদেশ ও ভারত নিজ নিজ প্রয়োজন অনুযায়ী এ পাইপলাইন ব্যবহার করতে পারবে। এমনকি চাইলে এটিকে কাজে লাগিয়ে দুই দেশ নিজস্ব চাহিদার ভিত্তিতে গ্যাস আমদানি ও রফতানি করতে পারবে।

জ্বালানি সংকটের দীর্ঘস্থায়ী সমাধান হিসেবে ওই সময় উদ্যোগটিকে স্বাগত জানানো হয়। এতে তিন দেশেরই লাভবান হওয়ার সুযোগ দেখছিলেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও শেষ পর্যন্ত নানা কারণে এ পাইপলাইন স্থাপন প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি। ২০০৮ সালে যখন ত্রিপক্ষীয় পাইপলাইন প্রকল্পটি নিয়ে এক ধরনের অচলাবস্থা বিদ্যমান, সে সময় এই সুযোগ কাজে লাগাতে এগিয়ে আসে বেইজিং।

রাখাইন থেকে উত্তোলিত গ্যাস পরিবহনের জন্য দক্ষিণ কোরিয়া-ভিত্তিক দাইয়ু ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি হাইড্রোকার্বন কেনাবেচার চুক্তি করে চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম করপোরেশন। এটি আবার ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব ঠেকাতে নয়াদিল্লির শক্তিশালী এক প্রকল্প হলো কালাদান মাল্টিমোডাল প্রকল্প। ২০০৮ সালে স্বাক্ষরিত এই প্রকল্পের লক্ষ্যই হলো রাখাইনের রাজধানী সিতওয়ে বন্দরের সঙ্গে কলকাতাকে সংযুক্ত করা।

ভারত ২০১৬ সালে সিতওয়েতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির ঘোষণাও দেয়, যা শহরের দক্ষিণে চীনের কিয়াউকফু বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে কাজ করবে। তবে, চলমান সংঘাতে চীনের মতো ভারতও দুশ্চিন্তায়!

আরাকান আর্মির চিন প্রদেশের পালেতওয়া, সিতওয়ের কাছের পাউকতাওয়ে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নেয়ার খবর উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, ভারতের ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতিমালায় পালেতওয়া ও সিতওয়ের অবস্থান কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মূলত এ দুই শহরকে কেন্দ্র করে ভারতের অর্থায়নে বাস্তবায়ন হচ্ছে উচ্চাভিলাষী ওই কালাদান মাল্টি-মোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট।

প্রায় ৩ হাজার ২০০ কোটি রুপিতে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পটির লক্ষ্য হলো মিয়ানমারের সিতওয়ে বন্দরকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি বন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত করা। একই সঙ্গে কলকাতার সঙ্গে ভারতের মিজোরামের দূরত্বও অনেক কমিয়ে আনবে প্রকল্পটি।

এটি বাস্তবায়ন হলে কলকাতা থেকে রাখাইনের সিতওয়ে বন্দরে পাঠানো পণ্য কালাদান নদী হয়ে খালাস হবে চিন রাজ্যের পালেতওয়া বন্দরে। এরপর সেখান থেকে তা সড়কপথে যাবে মিজোরামে। সেক্ষেত্রে শিলিগুড়ি করিডোরের ওপর ভারতের নির্ভরতাও অনেকখানি কমে আসবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বিলিয়ন ডলারের প্রকল্পগুলোর জন্য এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা চীন ও ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

শেয়ার করুন