নুয়ান তুষারা—বাংলাদেশ দলের ব্যাটসম্যানরা এ নামটি নিশ্চয়ই মনে রাখতে চাইবেন না। ২৯ বছর বয়সী এই লঙ্কান পেসার মানেই স্লিঙ্গি অ্যাকশনের দুঃস্বপ্ন। তুষারা মানেই ফুল লেংথ ও লেট আউটসুইং। তুষারা মানেই ইয়র্কার। তুষারা মানেই ভাঙা স্টাম্পের নাচন।
আজ সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে ম্যাচ শেষে হয়তো এই দৃশ্যগুলোই বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের চোখে ভাসছে। অথচ লঙ্কানদের প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টি সিরিজে হারানোর আশা নিয়ে আজ খেলতে নেমেছিল বাংলাদেশ দল। কিন্তু লঙ্কানদের করা ৭ উইকেটে ১৭৪ রানে আটকানোর পর রান তাড়ায় যা হলো তা এককথায় অবিশ্বাস্য।
আর অবিশ্বাস্য কীর্তির নায়ক একজনই—নুয়ান তুষারা। মাত্র ৭টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলা এই লঙ্কান পেসার আজকের ম্যাচে সুযোগ পেয়েছেন মাতিসা পাতিরানার চোটে। সেই ‘বিকল্প’ পেসার আজ তৃতীয় ওভারে বোলিংয়ে এসে করলেন হ্যাটট্রিকসহ মেডেন! সেই এক ওভারেই ভেঙে যায় বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ের মেরুদণ্ড। তিনি শেষ পর্যন্ত ৪ ওভারে ২০ রান দিয়ে নিয়েছেন ৫ উইকেট। তার অবিশ্বাস্য বোলিং পারফরম্যান্সের পরও বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত সব উইকেট হারিয়ে করেছে ১৪৬ রান।
হারের ব্যবধানটা কমে ২৮ রানের হওয়ায় ধন্যবাদ পাবেন রিশাদ হোসেন। আটে নেমে তিনি খেললেন ৩০ বলে ৫৩ রানের ঝোড়ো এক ইনিংস। বাংলাদেশকে ১০০-এর নিচে অলআউট হওয়া থেকে রক্ষা করেছে তার সেই ইনিংস। এই জয়ে লঙ্কানরা টি-টোয়েন্টি সিরিজ জিতে নিল ২-১ ব্যবধানে।
রান তাড়ার শুরুতেই লিটন দাসের উইকেট হারিয়ে বসে বাংলাদেশ। চোটের কারণে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসের বদলি হিসেবে বোলিংয়ে আসা ধনাঞ্জয়া ডি সিলভার করা প্রথম বলেই লেগের দিকে খেলতে গিয়ে ক্যাচ তোলেন লিটন (৭)। এরপরই ‘তুষারা-শো’র শুরু । ইনিংসের তৃতীয় ওভারে তার ছয়টি বল ছিল এমন—ডট, বোল্ড (নাজমুল হোসেন), বোল্ড (তাওহিদ হৃদয়), এলবিডব্লু (মাহমুদউল্লাহ), ডট, ডট।
বাংলাদেশের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে ষষ্ঠ বোলার হিসেবে হ্যাটট্রিক করলেন তুষারা। ২০০৭ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে ব্রেট লির হ্যাটট্রিক ছিল আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির ইতিহাসেই প্রথম। এরপর বাংলাদেশের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক পেয়েছেন লাসিথ মালিঙ্গা, দীপক চাহার, নাথান এলিস ও করিম জানাত। সর্বশেষ সে তালিকায় যুক্ত হলেন তুষারা। যার অ্যাকশনও মালিঙ্গার মতোই।
এ তো গেল তুষারার প্রথম ওভারের কথা। পরের ওভারে এসে স্টাম্প ওড়ালেন সৌম্য সরকারের। এক ওভার আগেই সতীর্থদের বোল্ড হওয়ার দৃশ্য নন স্ট্রাইকে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন সৌম্য। কী সামলাতে হবে তা জেনেও কিছু করতে পারেননি এই বাঁহাতি। টপ অর্ডারের একমাত্র তিনিই আউট হওয়ার আগে দুই অঙ্কের (১০ বলে ১১ রান) ঘরে যেতে পেরেছেন। স্পেলের প্রথম ২ ওভার শেষে তুষারার বোলিং বিশ্লেষণ ছিল এমন—২ ওভারে ২ রানে ৪ উইকেট, ডট বল ১০টি। বাংলাদেশের রান তখন ৪ উইকেটে ২৫ রান।
ম্যাচের গল্পটা সেখানেই শেষ। ছুটির দিনে খেলা দেখতে আসা দর্শকেরা একটু একটু করে মাঠ ছাড়তে শুরু করেন তখন থেকেই। যারা শেষ পর্যন্ত মাঠে ছিলেন, তাদের বিনোদন দিয়েছে রিশাদের ছক্কা-বৃষ্টি। শেখ মেহেদী হাসানকে (২০ বলে ১৯) নিয়ে লড়ছিলেন তিনি। থিতু হওয়ার পর নিজের পাওয়ার হিটিং সামর্থ্য দেখালেন রিশাদ। টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের এক ইনিংসে সর্বোচ্চ ৭ ছক্কায় রেকর্ড গড়ে করলেন ৩০ বলে ৫৩ রান। তার ১৭৩ স্ট্রাইক রেটের ইনিংসে ছিল না কোনো চার। তাসকিনের ২১ বলে ৩১ রানও বাংলাদেশের রানটাকে ১৪৬-এ নিতে সাহায্য করেছে।
লঙ্কানদের ইনিংসটি এগিয়েছে অদ্ভুত গতিতে। তাদের পাওয়ার প্লে ও ডেথ ওভারের ব্যাটিং ভালো হয়নি। কিন্তু মাঝের ওভারে রান এসেছে তরতরিয়ে। সে দায়টা অবশ্য বাংলাদেশ দলের বোলার ও ফিল্ডারদেরই। তবে শরীফুল ইসলাম ও তাসকিন আহমেদের বোলিং তাদের পাওয়ার প্লেতে হাত খুলতে দেয়নি। উল্টো উইকেট হারিয়ে আভিস্কা ফার্নান্ডোর জায়গায় সুযোগ পাওয়া ধনাঞ্জয়া ডি সিলভার উইকেট হারিয়েছে শ্রীলঙ্কা। শরীফুলের বলে টানা তিন বলে এলবিডব্লুর আবেদন থেকে রক্ষা পেলেও তাসকিনের বলে চতুর্থ ওভারে মিড উইকেটে ক্যাচ তোলেন ধনাঞ্জয়া (১২ বলে ৮ রান)।
পাওয়ারপ্লেতে লঙ্কানদের ১টি উইকেটই নিতে পেরেছে বাংলাদেশ। তবে রান দিয়েছে মাত্র ৪১, আরেকটু আঁটসাঁট বোলিং করলে সংখ্যাটা আরও কম হতে পারত। প্রথম ছয় ওভারেই বাংলাদেশের অতিরিক্ত রান ৮। লঙ্কানদের রানের চাকা থমকে ছিল ইনিংসের নবম ওভার পর্যন্ত। মোস্তাফিজুর রহমানের দশম ওভারে ১৮ রান নিয়ে খোলস থেকে বেরিয়ে আসেন কুশল মেন্ডিস। পরের চার ওভারে দ্রুত রান তুলেছেন তিনি। ১০ থেকে ১৫তম ওভারে শ্রীলঙ্কা রান নিয়েছে ৬২।
সে সময়ই ব্যক্তিগত ৫০ রানে জীবন পেয়ে মেন্ডিস তার রানটাকে বাড়িয়ে নিচ্ছিলেন শতকের কাছাকাছি। তাসকিন তার শেষ স্পেলে ফিরে এসে মেন্ডিসকে থামান। ৫৫ বলে ৬টি চার ও ৬টি ছক্কায় ৮৬ রানে থামে মেন্ডিসের ইনিংস। এই লঙ্কান তারকার বিদায়ে ডেথ ওভারের রানটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে বাংলাদেশ। ইনিংসের শেষ ওভারে মোস্তাফিজ এসেছে ১৪ রান দিলেও শেষ ৫ ওভারে শ্রীলঙ্কা যোগ করেছে মাত্র ৩৫ রান।