ওমানের পর বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য বন্ধ হচ্ছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, যেসব কর্মী এর মধ্যে ভিসা পেয়েছেন বা পাবেন, তাঁদের আগামী ৩১ মের মধ্যে মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করতে হবে। এরপর বাংলাদেশ থেকে আর কোনো কর্মী মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করতে পারবেন না। কর্মীদের জন্য ভিসার আবেদনের সর্বশেষ সময় ৩১ মার্চ।
মন্ত্রণালয় ও মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে জানা যায়, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে কাজ করতে যাওয়া বেশির ভাগ শ্রমিক প্রতারণার শিকার হয়েছেন। মাসের পর মাস অপেক্ষা করেও কাজ মেলেনি। এ ছাড়া নানা ধরনের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন কর্মীরা। সেখানকার নিয়োগকর্তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ ঘোষণা করেছে দেশটির সরকার। গত ২০ মার্চ এসংক্রান্ত বাংলাদেশ সরকার বরাবর একটি চিঠি পাঠানো হয় বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। এর আগে গত ৩১ অক্টোবর একই ধরনের অভিযোগের ভিত্তিতে বন্ধ হয়েছে ওমানের শ্রমবাজার।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, ওমানের পর মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে গেলে বড় ধরনের ক্ষতির মধ্যে পড়বে জনশক্তি খাত। এই ক্ষতি থেকে উদ্ধার পেতে হলে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে।
তবে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, আলোচনার মধ্য দিয়ে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। এর মধ্যে সে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে জানান প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
কর্মীদের অশেষ ভোগান্তি
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে বাংলাদেশি কর্মীদের নতুন করে অনুমোদন না দিলেও তাঁদের দুর্ভোগ থেমে নেই। গত বছরের ডিসেম্বরে নির্মাণকাজের কর্মীর ভিসায় মালয়েশিয়া যান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম। এখনো কোনো কাজ পাননি তিনি।
সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের তিন মাস ধরে কোনো কাজ দিচ্ছে না। খাবারও ঠিকমতো দিচ্ছে না। আমাদের বাঁচান। আমাদের মতো এমন হাজার হাজার মানুষ ভুগছে। হয় আমাদের কাজ দেন, নয়তো আমাদের দেশে ফিরিয়ে নেন।’
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশটিতে দেড় থেকে দুই লাখ বাংলাদেশি কর্মী বেকার ও মানবেতর জীবন যাপন করছেন। অনেকে নিয়মিত দূতাবাসের সহায়তা চাচ্ছেন। কর্মকর্তাদের মতে, নিয়োগকারী সংস্থাগুলোর সিন্ডিকেটের কারণেই কর্মীদের জন্য এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
কর্মকর্তারা বলেন, একজন কর্মী ৮০ হাজার টাকায় মালয়েশিয়ায় আসার কথা থাকলেও সাড়ে চার লাখের কমে কেউ আসতে পারেননি। আন্দোলন করেও সিন্ডিকেট থামানো যায়নি। অনিয়মের কারণে বন্ধ হচ্ছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা যায়, আগামী ১ জুন থেকে শুধু বাংলাদেশ নয়, অন্যান্য দেশ থেকেও কোনো কর্মী মালয়েশিয়ায় কাজ করতে যেতে পারবে না।
এ বিষয় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (কর্মসংস্থান) গাজী মো, শাহেদ আনোয়ার বলেন, ‘এখন আমাদের কাছে যেসব চাহিদা অনুমোদন রয়েছে, সেসব চাহিদা অনুযায়ী সময়মতো সব কর্মী পাঠানোর কাজ করছি। এখন আমরা দুই দেশের মধ্যে একটি জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক আয়োজনের চেষ্টা করছি। যদি তারা এ বিষয় রাজি হয়, তাহলে একটা সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের চিত্র
এর আগে দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের জন্য বন্ধ হয়ে যায় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। এরপর ২০২১ সালের ১৮ ডিসেম্বরে নতুন সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে আবার চালু হয় এই শ্রমবাজার। ২০২২ সালের আগস্ট থেকে বৈধভাবে দেশটিতে বাংলাদেশি কর্মী যাওয়া শুরু করে। এর পর থেকে এটি বাংলাদেশি কর্মীদের কাছে জনপ্রিয় শ্রমবাজারে পরিণত হয়।
বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য মতে, ২০২২ সালের আগস্ট থেকে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, অর্থাৎ ১৯ মাসে বাংলাদেশ থেকে চার লাখ ২২ হাজার ৬৬ জন কর্মী মালয়েশিয়া গেছেন। এর মধ্যে ২০২২ সালের পাঁচ মাসে গেছেন ৪৯ হাজার ৯৬১ জন, ২০২৩ সালে গেছেন তিন লাখ ৫১ হাজার ৬৩৮ জন, চলতি বছর গত দুই মাসে গেছে ২০ হাজার ৪৬৭ জন।
বিএমইটির প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২২ সালে বাংলাদেশি কর্মী তালিকায় মালয়েশিয়ার অবস্থান তৃতীয়। সে বছর মূল জনশক্তির ৪.৪১ শতাংশ কর্মী মালয়েশিয়া যান। ২০২৩ ও ২০২৪ সালে বাংলাদেশি কর্মী তালিকায় মালয়েশিয়ার অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। ২০২৩ সালে মূল জনশক্তির ২৬.৯৪ শতাংশ ও ২০২৪ সালের গত দুই মাসে ১২.৬২ শতাংশ কর্মী মালয়েশিয়া গেছেন।
সিন্ডিকেটের আবর্তে শ্রমবাজার
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার সব এজেন্সির জন্য উন্মুক্ত করার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত এটি সিন্ডিকেটের আবর্তে পড়ে যায়। প্রথমে ২৫টি রিক্রুটিং এজেন্সি মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর কাজ শুরু করে। পরে নানা আলোচনা ও সমালোচনার মধ্যে ১০১টি রিত্রুদ্ধটিং এজেন্সির সিন্ডিকেট তৈরি হয়।
মালয়েশিয়ায় কর্মী নিবন্ধিত রিক্রুটিং এজেন্সি এক হাজার ৫২০টি। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মালয়েশিয়া যেতে একজন কর্মীর ৮০ হাজার টাকার বেশি খরচ হওয়ার কথা নয়। তবে সিন্ডিকেটের কারণে মালয়েশিয়া যাওয়া কর্মীদের জনপ্রতি খরচ পড়ে চার লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) একাধিক সদস্যের দাবি, দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকে এজেন্সি চূড়ান্ত করার দায়িত্ব মালয়েশিয়ার হাতে দেওয়া হয়। এতে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী সিন্ডিকেট তৈরি করে অবৈধ বাণিজ্যের সুযোগ সৃষ্টি করে।
এ বিষয় বায়রার যুগ্ম মহাসচিব টিপু সুলতান বলেন, ‘মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রথমে সরকার পাঠাত। এরপর যখন বেসরকারিভাবে পাঠানোর বিষয়টি এলো, তখন ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সি কর্মী পাঠানোর কাজ করত। পরে ১০১টি রিক্রুটিং এজেন্সি কর্মী পাঠানোর কাজ পেল। তবে আমরা চাই, সব রিক্রুটিং এজেন্সি এখানে কর্মী পাঠানোর কাজ করুক।’
তবে এই বন্ধের জন্য কেউ দায়ী নয় বলে জানান বায়রার মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধের জন্য কেউ দায়ী নয়। মালয়েশিয়ার সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, সব দেশ থেকেই তারা কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ৩১ মে’র পর তারা বিবেচনা করবে, তাদের কী পরিমাণ কর্মীর প্রয়োজন। তারপর তারা আমাদের সিদ্ধান্ত জানাবে।’
সিন্ডিকেটের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সিন্ডিকেট তো মালয়েশিয়ার সরকার তৈরি করেছে। আমরা তখন আন্দোলন করেছিলাম। মালয়েশিয়ার সরকার তখন বলেছে, কর্মীদের চাকরি দেওয়া আমাদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। ফলে তাদেরকেই এই দায়িত্ব বহন করতে হবে।’