প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টির যে আভাস দেখা যাচ্ছে, তা সারা বিশ্বের পাশাপাশি বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা যায়। দেশের অর্থনীতিতে এ সংঘাতের কিছুটা প্রভাব আসতে পারে। অর্থনীতিতে সম্ভাব্য বিরূপ প্রভাব প্রশমনের লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন আগাম পদক্ষেপ নিয়েছে বলেও জানিয়েছেন সরকারপ্রধান।
আজ বুধবার জাতীয় সংসদে সরকারি দলের সংসদ সদস্য সামিল উদ্দিন আহমেদের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, বিশ্ববাজারের অস্থিতিশীলতা, বাজার ব্যবস্থাপনায় অসামঞ্জস্যতা এবং বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সূত্রে দেশের মূল্যস্ফীতি কিছুটা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ ছাড়া সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতির কারণে পণ্য সরবরাহের ‘সাপ্লাই-চেইন’ ক্ষতিগ্রস্ত হলে মূলত ইরান বা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে রপ্তানিসংশ্লিষ্ট পরিবহন খরচ বেড়ে যেতে পারে। এতে পণ্য তৈরি ও সরবরাহের ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় রপ্তানিকারকেরা কঠিন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে পারেন।
প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেন, এমন অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যের চলমান ঘটনাপ্রবাহের ওপর নজর রাখা এবং নিজ নিজ করণীয় নির্ধারণের জন্য সরকারের সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। সংঘাত দীর্ঘ হলে কোন কোন খাতে প্রভাব পড়তে পারে, তা বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।
সরকারের নেওয়া বিভিন্ন আগাম পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের যে কোনো সংঘাত বা সংঘাতের খবর জ্বালানি তেলের বাজারকে প্রভাবিত করে। এতে পণ্য পরিবহনে জাহাজের ভাড়া বাড়ে, যা আমদানি ব্যয়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। সার আমদানি ব্যয়ে প্রভাব পড়ে। এতে বিকল্প উৎস হিসেবে চীন, মরক্কো, তিউনিসিয়া, কানাডা, রাশিয়া ইত্যাদি দেশের সঙ্গে বিদ্যমান সম্পর্ক আরও জোরদার করা হবে।
প্রশ্নোত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের মূল্য স্বাভাবিক রাখতে সব ধরনের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। ভোগ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিকে অনেকাংশে সংযত করতে পেরেছে।
সরকারপ্রধান বলেন, বিশ্ববাজারের কয়েকটি পণ্য যেমন জ্বালানি তেল, ভোজ্যতেল, গম, সারসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য, ভোগ্যপণ্য ও শিল্পের কাঁচামালের মূল্য বাড়ায় দেশে আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতির চাপ অনুভূত হচ্ছে। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে শুরু হওয়া সংঘাতের ফলে সংকট ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তবে এ পরিস্থিতিতেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও জনগণের ওপর এর প্রভাব প্রশমনে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তাঁর সরকার।
টাকার বিনিময় হারের সাম্প্রতিক পতন অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা আনার জন্য শিগগিরই ‘ক্রলিং পেগ’ভিত্তিক (এ পদ্ধতিতে ডলারের দাম নির্দিষ্ট একটি সীমার মধ্যে ওঠানামা করে) মুদ্রা বিনিময় নীতি গ্রহণ করা হবে। এ ব্যবস্থা বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের অস্বাভাবিক উত্থান-পতন রোধ করবে বলে আশা করা যায়। ফলে এটি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেও সহায়ক হবে।
আরেক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, টিসিবিতে যে লোকবল আছে, সেটা দিয়ে মানুষের যে সেবা করা হচ্ছে, তা যথেষ্ট। সাধারণ মানুষের যাতে কষ্ট না হয়, সেদিকে লক্ষ রেখেই সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, হ্যাঁ, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে; যার প্রভাব আছে। বিশেষ করে যারা সীমিত আয়ের, তাদের জন্য কষ্ট হচ্ছে। তবে গ্রামে যারা নিজেরা উৎপাদন করতে পারেন বা করছেন, তাদের জন্য খুব একটা কষ্ট নেই। হাহাকারও নেই। তারপরও আমাদের সব সময় প্রচেষ্টা যে দ্রব্যমূল্য যেন নিয়ন্ত্রণে থাকে। যার জন্য যথাযথভাবে যে যে পণ্যের প্রয়োজন, সেটা দেশে যেমন উৎপাদনের পদক্ষেপ নিয়েছি, পাশাপাশি আমদানিও আমরা করে যাচ্ছি। যেটা যত টাকাই লাগুক না কেন। আমরা কিন্তু খরচ করে যাচ্ছি। যেটা আমাদের রিজার্ভেও চাপ পড়ছে। মানুষের কল্যাণটা হচ্ছে আমাদের সব থেকে বড় কথা। সেদিকে আমরা লক্ষ রাখছি।
বিরোধীদলীয় চিপ হুইপ মুজিবুল হকের এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘মানুষের সচেতনতা না এলে কী করবেন! হেলপার যদি গাড়ি চালায় বা যার লাইসেন্স নেই, সে কখন কোন গাড়িতে বসে চালাতে শুরু করে, এটা তো বোঝাও দুষ্কর। আর এভাবে গাড়ি চালাতে গিয়েই দুর্ঘটনা ঘটে। এরা নিজেও মরে যাত্রীদেরও মারে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। আমরাও গাড়ি কেনার সুযোগ দিয়েছি মানুষকে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও সুযোগ দিয়েছি। এখন আমাদের গাড়ির সংখ্যা এত বেশি, কিন্তু সেই তুলনায় ড্রাইভারের সংখ্যা খুব কম।
সরকার গাড়িচালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিচ্ছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, চালকদের দীর্ঘ সময় যাতে একটানা গাড়ি চালাতে না হয়, সে জন্য অনেকগুলো বিশ্রামাগার তৈরি করা হচ্ছে। যাদের ভারী গাড়ি চালানোর লাইসেন্স নেই, তারা যেন সেটা চালাতে না যান। এটা করতে গেলে তা হবে আত্মঘাতী। এই আত্মঘাতী ব্যবস্থা থেকে মানুষকে বিরত রাখতে হবে।
সবাই সচেতন ও সোচ্চার হলে দুর্ঘটনা কমবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারপরও বলব, দুর্ঘটনা দুর্ঘটনাই। এটা আমাদের দেশ বলে নয়, সারা বিশ্বে, অন্য দেশে যান—কী পরিমাণ মানুষ দুর্ঘটনায় মারা যায়? এটা খুবই দুঃখজনক। আমরা দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা সুনির্দিষ্ট করে দুর্ঘটনামুক্ত করার পদক্ষেপ নিয়েছি। যার জন্য অনেক এলাকায় দুর্ঘটনা হচ্ছে না। এই ড্রাইভারের ব্যাপারটা নিয়ে সমস্যা।
ব্যক্তিগত গাড়ির চালকদের বিষয়েও আন্তরিক হওয়ার পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, সবাইকে বলব, আপনারা চালকদের দিয়ে গাড়ি চালান। সে সময়মতো খেলো কি না, বিশ্রাম নিতে পারল কি না…অনেকে সেটা করেন না। আপনারা গাড়ি চালাতে বলে দেন। গাড়ি চলতেই থাকে। আপনি পার্টি খেয়ে আসেন, দাওয়াত খেয়ে আসেন, কিন্তু ড্রাইভার খেলো কি না, সে খবর রাখেন না। সে ব্যাপারে আন্তরিক হবেন।