ফেসবুক নিয়ন্ত্রণে বিটিআরসির বিধিমালার খসড়া ভারত থেকে ‘অনুকরণ’?

হাসান শান্তনু

ফেসবুক, ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগের অন্যান্য মাধ্যম ‘নিয়ন্ত্রণে’ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তৈরি ‘বিধিমালা’ ভারতীয় বিধিমালার ‘অনুকরণ’ বলে অভিযোগ করছেন অনেকে। তাদের ভাষ্য, বিটিআরসি দেশীয় বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এ বিষয়ে আরো আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে সুচিন্তিত বিধিমালা, বা প্রবিধান তৈরি করতে পারে। অন্য দেশের প্রবিধানের ‘অনুকরণ’ করায় তাদের ‘আপত্তি’। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ ৪৫টি সংগঠনও বিটিআরসির প্রস্তাবিত খসড়া প্রবিধানমালায় ভারতের ‘তথ্যপ্রযুক্তি বিধিমালা- ২০২১’ এর ‘প্রতিফলন’ দেখছে।

বিদেশি সংগঠনগুলোর অভিযোগ, বিটিআরসির প্রস্তাবিত প্রবিধানগুলো দিয়ে ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। এতে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে মানুষের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়ে আসতে পারে। যা নাগরিকদের গোপনীয়তা বিপন্ন করতে পারে। তা সাংবাদিক, ভিন্ন মতাবলম্বী, মানবাধিকারকর্মী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে আরো বেশি ‘ঝুঁকিতে’ ফেলবে। প্রবিধানমালা প্রত্যাহার করতে বিটিআরসিকে চিঠি পাঠিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো। গত ৮ মার্চ হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ওয়েবসাইটে ওই চিঠি প্রকাশিত হয়েছে।

বিটিআরসির প্রস্তাবিত প্রবিধানের খসড়ায় যা আছে, গত বছর এসব প্রবিধান যুক্ত হয় ভারতের ২০০০ সালের তথ্যপ্রযুক্তি আইনের আওতায়। যা দেশটিতে ‘তথ্যপ্রযুক্তি বিধিমালা- ২০২১’ নামে পরিচিত। এর আওতায় দেশটিতে ‘ভিন্নমত দমনের’ অভিযোগ আছে। দেশটির বিভিন্ন রাজ্যের রাজনৈতিক দল কেন্দ্রীয় সরকারের এ আইনের সমালোচনা করে আসছে। সামাজিকমাধ্যমে সরকারবিরোধি মন্তব্য নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় সরকার প্রবিধানের ব্যবহার করায় একে ‘অসাংবিধানিক’ উল্লেখ করে গত বছরের মে মাসে সরকারের বিরুদ্ধে দিল্লির উচ্চ আদালতে মামলা ঠুকে দেয় হোয়াটসঅ্যাপ।

বিটিআরসি প্রবিধানটির খসড়া বলছে, ইন্টারনেটভিত্তিক মাধ্যমগুলোকে বাংলাদেশে কর্মী নিয়োগ করতে হবে। তাদের সঙ্গে সশরীর যোগাযোগের ঠিকানা থাকতে হবে। অভিযোগ নেওয়া ও নির্দিষ্ট সময়ে তা নিষ্পত্তি করতে হবে। আদালত ও বিটিআরসি নির্দেশ দিলে নির্দিষ্ট আধেয় (কনটেন্ট) ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সরিয়ে নিতে হবে। প্রবিধানে নিষিদ্ধ আধেয় ব্যবহারকারী মুছে ফেললেও, তদন্তের জন্য ১৮০ দিন পর্যন্ত তা সংরক্ষণ করতে হবে।

খসড়ায় আছে, প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব, বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে হুমকির মুখে ফেলে এবং সরকারের গোপনীয়তা ভঙ্গ করে, এমন কিছু প্রচার করা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধ, জাতির জনক, জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে ও ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত লাগে, এমন কিছু প্রচারে বিরত থাকতে হবে। পর্নোগ্রাফি, গোপনীয়তা লঙ্ঘনসহ অবমাননা ও মানহানিকর আধেয় প্রচার করা যাবে না। বিটিআরসির আইনজীবী খন্দকার রেজা-ই রাকিব এ প্রসঙ্গে জানান, ‘খসড়াটি তৈরির সময় ভারত, সিঙ্গাপুর, ইংল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের নীতিমালাগুলো দেখা হয়েছে।’

‘ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া, ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন রেগুলেশন-২০২১’ শিরোনামের ১৬ পৃষ্ঠার খসড়া প্রবিধানমালা বিটিআরসির ওয়েববসাইটে দেওয়া হয় গত মাসে। এ বিষয়ে নাগরিকদের মতামত, পরামর্শ চাওয়া হয় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। এরপর খসড়া নিয়ে মূলধারার সংবাদমাধ্যমসহ সামাজিক মাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। তবে ফেসবুকসহ সব ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারের তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে যুগোপযোগী আইন প্রণয়নের কথা বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে বলছেন। অনেক দেশে নাগরিকদের স্বার্থ রক্ষায় এ ধরনের আইন, বিধিমালা আছে।

এসব মাধ্যমকে ব্যবহার করে দেশে বিভিন্ন ধরনের সাইবার অপরাধ, ধর্মীয় উস্কানি দিয়ে সংখ্যালঘুদেরকে নির্যাতন, তাদের বাড়িঘরে হামলার ঘটনা ঘটছে। রাষ্ট্র ও সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি বিশেষ ও প্রতিষ্ঠানকে লক্ষ্য করে ছড়ানো হচ্ছে অপপ্রচার, গুজব ও মিথ্যা তথ্য। ফেসবুক, ইউটিউবের মতো মাধ্যমগুলো থেকে কোনো আধেয় সরাতে তাদের ওপরই নির্ভর করতে হয় বিটিআরসিকে।

সংস্থাটির নির্দেশনার পরও অনেক সময় সংশ্লিষ্ট মাধ্যম আধেয় সরায় না। সরানোর বিষয়টি নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট মাধ্যমের নিজস্ব নীতিমালার ওপর। গত বছরের শেষ দিকে তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রীর পদ হারানো ডা. মুরাদ হাসানের অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যের ৯৪টি ভিডিও লিংক সরাতে বিটিআরসিকে বেগ পেতে হয়। বিভিন্ন সময় বলা হলেও সরকার সামাজিক মাধ্যম নিয়ন্ত্রণে সময়োপযোগী কোনো আইন প্রণয়ন করেনি। উচ্চ আদালতের নির্দেশে বিটিআরসি ওই প্রবিধানের খসড়া তৈরি করে।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের ১৪ দলের জোটের শরিক জাসদের সভাপতি, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু মনে করেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে প্রশাসন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। প্রশাসন বুঝতে পারছে না যে, এসব মাধ্যম নিয়ন্ত্রণে তারা এখনো আনাড়ি। তারা এলোপাতাড়ি পদক্ষেপ নিচ্ছে। মাধ্যমগুলো নিয়ন্ত্রণে তাদের হাতে একটা হাতিয়ার থাকতে হবে। তা হলো আইন।’

বিটিআরসিকে খসড়া প্রবিধানটি ‘প্রত্যাহার ও পুনর্বিবেচনার’ আহ্বানের কথা উল্লেখ আছে বিদেশি ৪৫টি সংগঠনের চিঠিতে। যোগাযোগ করলে সংস্থাটির চেয়ারম্যান শ্যামসুন্দর সিকদার এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘উচ্চ আদালতের নির্দেশে বিটিআরসি এ প্রবিধানমালা তৈরি করছে। এটি প্রত্যাহার করার আবেদন সমীচীন নয়। এটি প্রত্যাহারের কোনো সুযোগ নেই। কারণ, প্রবিধানমালা তৈরি করে আদালতের কাছে দিতে হবে। এটি প্রত্যাহারের এখতিয়ার শুধু হাইকোর্টেরই আছে।’

প্রবিধানের খসড়া নিয়ে আরো আলোচনা-পর্যালোচনায় আগ্রহী বিটিআরসি। শ্যামসুন্দর সিকদার এ প্রসঙ্গে মত ও পথকে বলেন, ‘প্রবিধানমালা তৈরিতে একটি কমিটি কাজ করছে। কমিটি নিশ্চয় বিদেশি সংগঠনগুলোর চিঠিটি বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখবে। কমিটি ওয়েবসাইটে খসড়া প্রবিধানমালা প্রকাশ করেছে বিভিন্ন জনের মতামত নিতে। কোনো সুচিন্তিত ও গ্রহণযোগ্য মতামত থাকলে তা বিবেচনার সুযোগ আছে।’

শেয়ার করুন