জাল ভিসায় কোটি টাকার মালিক জাকির!

নিজস্ব প্রতিবেদক

১৯৯২ সালে অফিস সহকারী হিসেবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দিয়েছিল জাকির হোসেন। এরপর পদোন্নতি পেয়ে হয়েছে প্রশাসনিক কর্মকর্তা। দায়িত্ব পালন করেছে আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন রাষ্ট্রের বাংলাদেশ দূতাবাসে। এই সুযোগে জাল ভিসার মাধ্যমে আয় করেছে কোটি কোটি টাকা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি তার।

সোমবার (১৪ মার্চ) জ্ঞাত আয়বর্হিভূত অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে জাকিরের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। দুদকের সহকারী পরিচালক আফনান জান্নাত কেয়া বাদী হয়ে সমন্বিত জেলা কার্যালয়ম ঢাকা- ১ এ এই মামলা দায়ের করেন।

universel cardiac hospital

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দুদকের জনসংযোগ শাখার পরিচালক মুহাম্মদ আরিফ সাদেক।

দুদক সূত্র জানায়, জাকির হোসেনের গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের বাসাবাটী এলাকায়। ঢাকার নন্দীপাড়ার জান্নাতবাগের ৬ নম্বর রোডের এক নম্বর প্লটে পরিবার নিয়ে থাকে সে। তার বিরুদ্ধে মোট ১৫ কোটি ৩৯ লাখ ৯৭ হাজার ৬৯৬ টাকার জ্ঞাত আয়বর্হিভূত সম্পদ অর্জনের তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। এছাড়া সে ৪১ কোটি ৩৬ লাখ ৭ হাজার ২ টাকা হস্তান্তর, রূপান্তর ও স্থানান্তর করেছে বলে তথ্য পেয়েছেন দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তারা।

দুদক সূত্র জানায়, জাকির হোসেন ১৯৯২ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অফিস সহকারী হিসেবে যোগদান করে। ১৯৯৫ সালে সে কুয়েত দূতাবাসে এবং ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রশাসনকি র্কমর্কতা হিসেবে কেনিয়ার নাইরোবিতে বাংলাদশ হাইকমিশনে কর্মরত ছিল। ২০২১-২০২২ কর বর্ষের আয়কর নথি অনুযায়ী, ধানমন্ডির ১ নম্বর সড়কের ৫ নম্বর প্লটের সি-৩ ঠিকানায় তার নামে ৫০ লাখ টাকা মূল্যমানের একটি ফ্ল্যাট, খিলগাঁওয়ের নন্দীপাড়ায় আড়াই কাঠা জমির ওপর ৭৫ লাখ টাকা মূল্যমানের একটি পাঁচ তলা বাড়িসহ মোট এক কোটি ৫১ লাখ ১০ ২০০ টাকার স্থাবর সম্পদ পাওয়া যায়। এছাড়া ১৩ কোটি ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, ৩৮ লাখ ৯৫ হাজার টাকা মূল্যমানের ১৫০০ সিসির একটি গাড়ি (টয়োটা রোস), ব্যাংকে গচ্ছিত ৭২ হাজার টাকা, নগদ প্রায় ২০ লাখ টাকার অস্থাবর সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া গেছে। স্থাবর ও অস্থাবর মিলিয়ে তার মোট ১৫ কোটি ৩৯ লাখ ৯৭ হাজার ৬৭৬ টাকার সম্পদ পাওয়া গেছে। কিন্তু এসব সম্পদের বিপরীতে সে কোনও বৈধ আয়ের উৎস দেখাতে পারেনি।

দুদক সূত্র আরও জানায়, অনুসন্ধানে জাকির হোসেনের নামে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের বাগেরহাট শাখায় গত ২০১৩ সালের ১৫ জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ১৫ জুন পর্যন্ত ৭টি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ৩১ কোটি ৭০ লাখ ৬০ হাজার ৯১৩ টাকা, সোনালী ব্যাংক ভিকারুননিসা নুন স্কুল শাখার ১টি অ্যাকাউন্টে ৪ কোটি ৩ লাখ ১০ হাজার ৯৩০ টাকা এবং ২০২০ সালের ১৪ জুন পদ্মা ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখায় ১৫টি মেয়াদি এফডিআর হিসাবে ৫ কোটি ৬২ লাখ ৩৫ হাজার ১৫৯ টাকাসহ সর্বমোট ৪১ কোটি ৩৬ লাখ ৭ হাজার ২ টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। এসব লেনদেনের বিপরীতে বৈধ উৎস সংক্রান্ত কোনও রেকর্ডপত্র পাওয়া যায়নি। ২০২১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর আদালতের নির্দেশে এসব অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধ করা হয়।

দুদকের একজন কর্মকর্তা জানান, জাকির হোসেন একজন সরকারি র্কমর্কতা হয়েও অসৎ উদ্দেশ্যে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ ও ক্ষমতার অপব্যবহারর পূর্বক ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় এবং হিসাবগুলোতে অবৈধ কার্যক্রমের মাধ্যমে উপার্জিত অপরাধলব্ধ আয়ের ৪১ কোটি ৩৬ লাখ ৭ হাজার ২ টাকা হস্তান্তর, রূপান্তর ও স্থানান্তরের মাধ্যমে অবস্থান গোপন করে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২) ও ৪(৩) ও ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে। এজন্য তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এর ২৭ (১) ও ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।

যেভাবে কোটি কোটি টাকার মালিক হলেন জাকির

দুদক ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালের ৩১ আগস্ট থেকে ২০১৯ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত জাকির হোসেন কেনিয়ার নাইরোবিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছে। এসময় সে ভিসা ইস্যু করার এখতিয়ার না থাকার পরও তৎকালীন হাইকমিশনারের অনুমোদন নিয়ে ভিসা ইস্যু করতো। নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন, তানজানিয়া, গিনি, ঘানা, মালি, কেনিয়াসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের ভ্রমণ ভিসা দেওয়ার বিনিময়ে মোটা অঙ্কের অর্থ নিতো সে। আসল ভিসার পাশাপাশি সে জাল ভিসা দেওয়ার কাজও করতো।

সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের শেষ দিকে নাইজেরিয়ার চার নাগরিক জাল ভিসা নিয়ে দেশে আসার পর বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের কাছে ধরা পড়েন। পরে ওই ঘটনার তদন্ত করতে গিয়েই পুলিশের বিশেষ শাখা জানতে পারে যে, নাইরোবিতে থাকাকালীন এবং দেশে ফিরেও জাকির হোসেন জাল ভিসার কাজ করতো। একজন আফ্রিকান নাগরিকের সহায়তায় সে কুরিয়ারের মাধ্যমে পাসপোর্ট এনে জাল ভিসা লাগিয়ে আবার সংশ্লিষ্ট দেশের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতো। এভাবেই সে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

শেয়ার করুন