আজ ঐতিহাসিক মুজিবনগর সরকার গঠন দিবস। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল; এই দিনে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে রাষ্ট্রপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় গঠিত হয় এই সরকার।
২৫ মার্চের পর তৎকালীন পূর্ব বাংলায় প্রতিদিনই ঘটতে থাকে অভাবিত ঘটনা। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী অপারেশন সার্চলাইটের পরে উন্মত্ত হয়ে ওঠে বাঙালি জাতিকে চিরতরে ধ্বংস করার জন্য। ‘একটি বুলেট একটি বাঙালি’- এমনটাই ছিল পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর মনোভাব। অপ্রত্যাশিত সেই দম আটকানো পরিবেশে বাঙালি মুক্তির উপায় খুঁজতে থাকে। মুক্তির লক্ষ্যে তারাও সংঘটিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন পাকিস্তানের কারাগারে। দেশে চলছে মুক্তিযুদ্ধ। কিভাবে ওই মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটবে তা ছিল অনেকটাই অনিশ্চিত পথ যাত্রা। যেই বঙ্গবন্ধুর ডাকে সর্বস্তরের বাঙালি রাজপথে নেমে লড়াই করবে সেই বঙ্গবন্ধু তখন বাঙালির মাঝে নেই। দিশেহারা বাঙালির সামনে তখন আবির্ভূত হন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সহচর। তারা বুদ্ধির বলে দিশেহারা বাঙালি জাতিকে একসূত্রে গাঁথার লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন করেন।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে বাঙালিদের মধ্যে নতুন প্রাণ সঞ্চারিত হয়। এরপর ১৩ এপ্রিল ৬ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভার সদস্যদের নাম এবং মন্ত্রীদের মাঝে দফতর বণ্টন করা হয়। ১৪ এপ্রিল কর্নেল এমএজি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। সরকার গঠনের পর দেখা দেয় শপথ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা। এরই ধারাবাহিকতায় ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের সীমান্ত লাগোয়া বৈদ্যনাথতলার এক বিশাল ছায়াঘেরা আমবাগানে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণের আয়োজন করা হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে প্রবাসী বিপ্লবী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং মন্ত্রী হিসেবে এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান প্রমুখ শপথ নেন।
এই শপথ শুধু একটি অস্থায়ী সরকারের শপথ অনুষ্ঠান ছিল না- এই অগ্নিশপথের মধ্যে নিহিত ছিল পরাধীন পূর্ব বাংলাকে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও স্বাধীন করার প্রেরণা। বলতে দ্বিধা নেই মুজিবনগর সরকার গঠিত ও তাদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের ফলে দেশে-বিদেশে বাঙালিদের পক্ষে জনমত সুদৃঢ় হয়। তখন বাংলাদেশবিরোধী চক্র ছাড়া পৃথিবীর সকল শান্তি ও স্বাধীনতাকামী মানুষই বাংলাদেশকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়। মুজিবনগরের সরকারের যারা সম্মানিত সদস্য ছিলেন তাদের মধ্যে দুই-একজন বাদে সকলেই বাংলাদেশের অস্তিত্বে আস্থাবান ছিলেন। তারা একটি স্বাধীন স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার জন্য শেষ পর্যন্ত বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে গেছেন। তৎকালীন মুজিবনগর সরকারের যারা প্রাণ ভোমরা ছিলেন- দুই-একজন বাদে তারা প্রত্যেকেই দেশপ্রেমিক ছিলেন। ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনকের বিশ্বস্ত সহচর। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর এরাও অন্ধকার কারাপ্রকোষ্ঠে নির্মমভাবে নিহত হন।
মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানায় অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে গঠিত হলেও এদের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় ভারতের মাটি থেকে। কলকাতা ৮ নম্বর থিয়েটার রোডের বাড়িতে এই সরকারের অফিস স্থাপন করা হয়। সেখান থেকেই পরিচালিত হয় মুজিবনগর সরকারের চোখ ধাঁধানো কর্মকাণ্ড। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি ঘটনাই মুজিবনগর সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করত। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া থেকে শুরু করে বহির্বিশ্বের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করাসহ এমন কোনো কাজ নেই যা তারা করেনি। এমনকি যুদ্ধ-আক্রান্ত বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে যুদ্ধ পরিচালনার কৌশলও নির্ধারণ করে মুজিবনগর সরকার। দেশ ও দেশের মানুষের জন্য মুজিবনগর সরকারের রয়েছে অনন্য অবদান।
মুজিবনগর সরকারের দূরদর্শিতার কারণেই রাশিয়া (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন) ১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্থানের সর্মথনপুষ্ট যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রস্তাবে ভেটো প্রয়োগ করে। যুক্তরাষ্ট্র এ প্রস্তাবে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি (গৃহযুদ্ধ), সশস্ত্র বাহিনী প্রত্যাহার এবং পাক-ভারত সীমান্তে পর্যবেক্ষক মোতায়নের প্রস্তাব করে। ঠিক একইভাবে ৬ ডিসেম্বর, ৮ ডিসেম্বর, ১৩ ডিসেম্বর ভেটো প্রয়োগ করে। আর ১০ ডিসেম্বর “Independent Republic Of Bangladesh”কে সমর্থন করেন এবং বাংলাদেশের মানুষের উপর সামরিক জান্তার আক্রমণ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতারকে Out-Law বলে স্পষ্ট বিবৃতি দেয়। ৫ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘকে ব্যবহার করে− পাকিস্তানের পক্ষে সামরিক শক্তি প্রয়োগের হুমকি দেয়। কিন্তু রাশিয়ার বিরোধিতায় ব্যর্থ হয়ে একতরফা শক্তি প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত নেয় যুক্তরাষ্ট্র।
৯ ডিসেম্বর তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের দিকে রওনা হতে নির্দেশ দেন। ১০ ডিসেম্বর সপ্তম নৌবহরের ১০টি জাহাজ নিয়ে ‘টাস্কফোর্স ৭৪’ গঠন করা হয়। ১০ ডিসেম্বর এই নৌবহর মালাক্কা প্রণালীতে অবস্থান নেয়।
ভারত মহাসাগরে শুভেচ্ছা সফরে একটি মাইনসুইপার জাহাজ, একটি ডেস্ট্রয়ার, একটি ব্যাটল ট্যাংক ক্যারিয়ার জাহাজ ও একটি সাবমেরিন রেখেছিল। এছাড়া ৫ ডিসেম্বর আরও একটি মাইনসুইপার জাহাজ ও একটি ডেস্ট্রয়ার ভারত মহাসাগরে পৌছায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ৬টি জাহাজকেই বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি থাকার নির্দেশ দেয়। ৭ ডিসেম্বর ভ্লাদিভস্তক থেকে ১টি নিউক্লিয়ার বোমাবাহী মিসাইলসহ ব্যাটলক্রুজার, ও একটি নিউক্লিয়ার সাবমেরিন রওনা দেয়।
১০ ডিসেম্বর সপ্তম নৌবহরের বঙ্গোপসাগরে অফিসিয়াল যাত্রা শুরুর পর ১৩ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন সপ্তম নৌবহরকে ঠেকাতে ঘোষণা দেয়। তারা আগের জাহাজগুলোর সাথে আরেকটি অ্যান্টি-ক্যারিয়ার টাস্কফোর্স পাঠাচ্ছে- যাতে আছে আরও একটি নিউক্লিয়ার বোমাবাহী মিসাইলসহ ব্যাটলক্রুজার, একটি নিউক্লিয়ার গাইডেড মিসাইল সাবমেরিন, একটি নিউক্লিয়ার অ্যাটাক সাবমেরিন এবং একটি ডেস্ট্রয়ার।
সপ্তম নৌবহর ১৪ ডিসেম্বর মালাক্কা প্রণালী অতিক্রম করে, বঙ্গোপসাগর-এ প্রবেশ করে। ১৫ ডিসেম্বর সপ্তম নৌবহরের বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধজাহাজ নিয়োগ করে। এই দিন ২০টি সোভিয়েত রণতরী ভারত মহাসাগরে অবস্থান নেয়। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে অংশ নেয়া থেকে নিজেদের বিরত রাখার সিদ্ধান্ত নেয় এবং সপ্তম নৌবহর ফিরিয়ে নেয়।
আজকের বাংলাদেশ মূলত ত্রিশ লক্ষ শহিদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত। কিন্তু এই অর্জনের পেছনে ছিল মুজিবনগর সরকারের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও জাতীয় চারনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামানের অসামান্য আত্মত্যাগ। মুজিবনগর সরকার সেদিন সব রকমের প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে যেভাবে বাংলার মাটিকে শত্রু মুক্ত করে এবং স্বাধীনতা এনে দেয় তা এক বিস্ময়কর মহা-উপাখ্যানই বটে।