দেশে ‘গুম’ হওয়া ৭৬ জনের তালিকা তুলে ধরলেও বাংলাদেশ সফররত জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেটকে এ বিষয়ে তিনটি কারণ জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। ব্যাখ্যায় ‘কনভিন্স’ হয়ে কমিশনার ‘ধন্যবাদ’ দিয়ে চলে গেছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।
রোববার (১৪ আগস্ট) সচিবালয়ে মিশেল ব্যাচেলেটের সঙ্গে বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের এ কথা জানান।
আসাদুজ্জামান খান বলেন, তিনি (মিশেল) আগেই আমাদের কিছু লিখিত প্রশ্ন দিয়েছিলেন। যেগুলো নিয়ে তিনি আলাপ করতে চেয়েছিলেন। সেগুলোর সবকিছু তাকে… আমাদের ভূমিকা, আমাদের কীভাবে চলছে, আমাদের সরকারিভাবে একটি মানবাধিকার কমিশন রয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসা ছিল অনেকে মিসিং হয়ে যায়, আমাদের ধর্মীয় সম্প্রীতি নিয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন। অনেক নৃশংসতা বাংলাদেশে হয়েছে, সেগুলো নিয়ে আমরা কী করেছি?
তিনি বলেন, আমরা বলেছি আমাদের এখানে এক হাজার ২৬৫টি স্বীকৃতি দৈনিক সংবাদপত্র। সব মিলিয়ে সংবাদপত্র আছে তিন হাজার ১৫৪টি। মোট টিভি চ্যানেল আছে ৫০টি।
বাংলাদেশের গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে মতামত প্রচার করছে বলেও কমিশনারকে জানিয়েছেন বলে জানান মন্ত্রী।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্বাধীনতা পেয়ে তারা যা ইচ্ছা প্রকাশ করে থাকে, মতামত প্রকাশ করে থাকে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়েও তিনি কথা বলেছেন। আমরা বলছিলাম- এটার সবচেয়ে বড় শিকার হলেন মহিলারা, শিশুরা। খুব কম সংখ্যক ৩ শতাংশের বেশি নয় রাষ্ট্রীয়ভাবে মামলা হয়েছে। এদের নিরাপত্তার জন্যই আইনটি ছিল। আইনমন্ত্রী বলেছেন, এটাকে আরেকটু সতর্কতার সঙ্গে প্রয়োগ করতে, আমরা সেটাই করছি। এখন কেউ মামলা করলে আমরা দেখি তিনি অপরাধটা করেছে কি না- অপরাধ করলে মামলাটা নেওয়া হয়। তিনি (কমিশনার) বলেছেন, আইনমন্ত্রীর সঙ্গেও কথা বলেছি।
‘আমাদের ৭৬ জনের মিসিং বা ডিসঅ্যাপেয়ারেন্স পার্সনের তালিকা দেওয়া হয়েছিল, আমাদের বলা হয়েছিল। আমরা দেখিয়ে দিয়েছি এ ৭৬ জনের মধ্যে ১০ জন তাদের বাড়িতেই আছে। দুজন জেলখানায় আছেন। যারা ডিসঅ্যাপেয়ারেন্স হয়ে আছেন, আমরা তাকে বলেছি আমাদের দেশে তিনটি কারণে ডিসঅ্যাপেয়ার হয়, প্রথম কারণ হচ্ছে ঘৃণ্য অপরাধ যারা করে, ভিডিওর মাধ্যমে আমরা দেখিয়েছি। পুলিশকে পিটিয়েও তারা হত্যা করেছে। আমরা এটাও দেখিয়েছি কীভাবে তারা মানুষের সম্পদ ধ্বংস করেছে। যারা এগুলো করেছে তারা সীমান্তের ফাঁক-ফোকর দিয়ে বিভিন্ন দেশে চলে গিয়েছে। তারা ভারত কিংবা মিয়ানমার কিংবা অন্য কোনো জায়গায় তারা আশ্রয় নিয়েছেন। বাকিগুলো সব আমাদের সঙ্গেই আছে।’
তিনি আরও বলেন, আজকে বিচার বিভাগ স্বাধীন, কাজেই বিচার এড়ানোর জন্যই তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। সেটার একটা নমুনা আমরা তাকে দেখিয়েছি। কী ধরনের অপরাধ তারা করেছেন।
মন্ত্রী বলেন, এছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যে ঋণে জর্জরিত হয় তারা গা ঢাকা দেয়। হয়তো কয়েকদিন পরে আত্মপ্রকাশ করে। আবার যারা পারিবারিকভাবে অসুবিধায় পড়ে তারাও গা ঢাকা দেয়। এ তিন ধরণের লোকদের গা ঢাকা দিতে দেখেছি। এটাই কমিশনরাকে বলেছি। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যাদের গ্রেফতার করে তাদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে সোপর্দ করা হয়।
আসাদুজ্জামান বলেন, তারা বলেছেন, ৭৬টি যে গুমের ঘটনা এসেছে সেগুলো নিয়ে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খুঁজে দেখেছেন তাতে কোনো সত্যতা নেই। তারপর আমরা বলেছি, নারায়ণগঞ্জে ৭ খুন হয়েছিল সেখানেও র্যাবের যে সদস্য যুক্তছিল তারা আইনের মুখোমুখি হয়ে শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েছেন জজকোর্টের মাধ্যমে। কক্সবাজারেরও একটি ঘটনায় শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েছে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ৫৪ জনের (৭৬ জনের তালিকার) মধ্যে ৩২ জনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন নাশকতামূলক অভিযোগ রয়েছে এবং তারা আমাদের ওয়ান্টেড আসামি। আমাদের পুলিশও তাদের খুঁজছে। এগুলোর নামে মামলা রয়েছে। সেজন্যই তারা ডিজঅ্যাপেয়ার রয়েছে। আর কতগুলো যেগুলো আছে আমাদের আওয়ামী লীগেরও মানে আওয়ামী সমর্থক চারজন রয়েছে। এগুলো সবগুলো ডিজঅ্যাপেয়ার। আমরা মনে করি, হয় তাদের ফ্যামিলি অশান্তির জন্য কিংবা দেউলিয়ার কারণেও হতে পারে কিংবা কোনো ক্রাইম করেছে, যেটা আমরা বারবার বলি। আমাদের পুলিশ আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী তাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমরা মনে করি আমরা যে কোনো সময় তাদের খুঁজে পাবো। এটাই আমরা আজ তাদের জানিয়ে দিয়েছি অফিসিয়ালভাবে।’
তিনি আরও বলেন, আমরা এসব কথা বলার পরে ভিডিও দেখার পরে তাদের আর প্রশ্ন করার কিছু ছিল না। তারা সবাই কনভিন্স হয়ে আমাদের ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেছেন।
আলোচনায় সংখ্যালঘুর প্রসঙ্গটিও আসছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, নড়াইলের ঘটনা এবং অন্যান্য ঘটনা। আমরা বলেছি, এগুলো ফেসবুক এবং সোশ্যাল মিডিয়ারমাধ্যমে যেসব কমেন্ট করা হয়েছে, এগুলো দেখাই। বাংলাদেশের মানুষ যে যার ধর্মকে অত্যন্ত হৃদয় দিয়ে ধারণ করেন এবং সবাই সিরিয়াসলি সেটাকে ধারণ করেন। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-মুসলমান আমাদের সবাই এ দেশের মানুষ। ৯০ ভাগ মুসলমান হলেও সবাই মিলে মিশে থাকি। আমাদের ধর্মীয় সম্প্রীতি রয়েছে।
‘যেখানে এই ঘটনাগুলো ঘটেছে সেখানেই আমরা তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিয়েছি। মামলা হয়েছে এবং তাদের অ্যারেস্ট করা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ধর্মীয় ও সামাজিক নেতারা বসে ওখানে একটা শান্তির ব্যবস্থা আমরা করেছি। সবকিছু তারা অ্যাপ্রিশিয়েট করেছেন। যে অ্যাকশনগুলো আমরা নিয়েছি সেগুলো তারা প্রশংসা করেছেন।’
পার্বত্য তিন জেলায় পার্বত্য ভূমি নিষ্পত্তি কমিশনের কাজ সম্পন্ন করার প্রচেষ্টা চলছে বলেও জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নেত্রনিউজ সব সময় ভুয়া নিউজ দিয়ে থাকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে। আমরা এগুলোকে নিউজ বলে মনে করি না। আমাদের দেশের যে ঘটনা, আমাদের দেশের মিডিয়া ফ্রি। তারা যে কোনো সংবাদ সবসময়ই প্রকাশ করে থাকেন। আমরা কোনো মিডিয়ার ওপর কোনো সেন্সর করি না। কাজেই কোথাকার কোন নিউজ কী বললো আমরা সেগুলোর কোনো বাস্তবতা খুঁজে পাই না।
আরেক প্রশ্নের জবাবে আসাদুজ্জামান খান বলেন, গুম দিবস যারা করেন তারা একটা উদ্দেশ্য নিয়েই করেন। তারাও জানেন তাদের ছেলেটি কিংবা ভাইটি কিংবা তার মেয়েটি কোথায় আছেন। আমরা এটুকু বলতে চাই যে, আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যাদের নিয়ে যায় তাদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই কোর্টে সাবমিট করতে হয়। কেউ যদি ইচ্ছে করে গুম হয়ে যায়, কেউ যদি কাঁটাতারের ফাঁক দিয়ে বিদেশে চলে যায় কিংবা সমুদ্রপথে যদি চলে যায়, যেটাকে আমরা মানবপাচার বলি, সেখানে যারা চলে যায় আমাদের তো তাদের বের করতে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন হয়। কাজেই যারা এগুলো বলছেন এগুলো আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী দেখছেন। আমরা যাকেই খুঁজে পাবো তাকে আমরা প্রকাশ করে দেখাবো।
রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমান কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না, এ বিষয়ে জাতিসংঘ কী করতে পারে, সেই বিষয়ে কোনো কথা হয়েছে কি না- জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, তারা বলছেন প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। জাতিসংঘের সব সংস্থাই বলছেন, আমাদের সঙ্গে সবাই কথা হচ্ছে। মিয়ানমারের সরকারের অবস্থা ভালো না, এ মুহূর্তে সম্ভব হচ্ছে না- এটাই তারা বলে যাচ্ছেন, বলছেন।
র্যাবের কর্মকর্তাদের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে কোনো কথা হয়েছে কি না জানতে চাইলে আসাদুজ্জামান খান বলেন, এ বিষয়ে কোনো আলাপ হয়নি। আমরা ভিডিওর মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছি। তাকেও (কোনো ব্যক্তি তা বলেননি) বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছে। নিম্ন আদালতে তার বিচার হয়েছে এবং উচ্চ আদালতে এটা চলছে। পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা কারাগারে রয়েছেন বিচারের পর।