গণতন্ত্রের তত্ত্বকথা যে আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ ভাষণ থেকেই শুরু হয়েছিল, তা নয়। জনগণের ইচ্ছামাফিক শাসনকাজ পরিচালনার কথা প্রাচীন কালেও প্রচলিত ছিল। ভারতবর্ষে আলেকজান্ডারের প্রস্থানের পরপরই সেখানে মৌর্য বংশীয় রাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার সময় বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ তাত্ত্বিক বলে স্বীকৃত কৌটিল্য সেই রাজতন্ত্রের যুগেও তাঁর বই ‘অর্থশাস্ত্রে’ গণমানুষের ইচ্ছায় রাজ্য পরিচালনার কথা উল্লেখ করে শুদ্ধাচার এবং রাজনৈতিক শিষ্টাচারের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছিলেন। গণতান্ত্রিক মতবাদের জনক নামে পরিচিত ক্লেইসথোনমও বলেছিলেন, শুদ্ধাচার ও শিষ্টাচার হচ্ছে সুশাসনের বিকল্পহীন উপাদান। প্রাচীন গ্রিসে সক্রেটিস বলেছেন, গ্রহণযোগ্য যুক্তি এবং সুতর্কের ওপরই সুশাসন নির্ভরশীল। প্লেটো তাঁর বিখ্যাত ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে দার্শনিক রাজার (ফিলোসফার কিং) যে বর্ণনা দিয়েছেন, সেখানেও বলা হয়েছে দার্শনিক রাজার সবচেয়ে বড় গুণ হতে হবে অকাট্য যুক্তি। মধ্যযুগের রাজনৈতিক দার্শনিক ম্যাকিয়াভেলি তাঁর পুস্তক ‘প্রিন্স’-এ উল্লেখ করেছেন যে একজন প্রতারক তার প্রতারণামূলক ভাষ্যের সাহায্যে বহুজনকে প্রতারিত করতে পারলেও তা ক্ষণস্থায়ী হতে বাধ্য।
সুতরাং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় প্রতারণাসুলভ পদ্ধতি বর্জন করে শুদ্ধাচার যে অপরিহার্য, সে কথা যুগে যুগে সব তাত্ত্বিকই ব্যক্ত করেছেন। শিষ্টাচার, শুদ্ধাচার ও সত্যাচার নিশ্চিতভাবে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এর পরও আমরা বিভিন্ন দেশে এমন বহু প্রতারক রাজনীতিক দেখতে পাই, যাঁরা ম্যাকিয়াভেলির প্রথম কথাটি, অর্থাৎ প্রতারণামূলক ভাষ্য দিয়ে বিশাল জনগোষ্ঠীকে প্রতারিত করে তাদের আনুগত্য লাভ করা সম্ভব বলে ধরে নিয়ে নিজেদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চেষ্টায় লিপ্ত। কিন্তু তাঁরা যে তাঁদের কূটকৌশল অবলম্বন করে বেশিদিন টিকতে পারেননি, ইতিহাস সে সাক্ষ্যই দেয়।
বাংলাদেশেও এক ধরনের রাজনীতিক রয়েছেন, যাঁরা যেকোনো মূল্যে ক্ষমতা গ্রহণকেই শ্রেয় মনে করে সত্যবাদিতা, তথা শিষ্টাচারকে জলাঞ্জলি দিতে দ্বিধান্বিত নন, ইংরেজি ভাষায় যাদের ‘ডেমোগগ’ বলা হয়। এই শ্রেণির রাজনীতিক আগে যেমন ছিলেন, এখনো তেমনি রয়েছেন। তাঁরা গণতন্ত্র এবং উন্নয়ন উভয়েরই শত্রু। ম্যাকিয়াভেলির ভাষায়, সংখ্যাধিক্য মানুষের সরলতাই হচ্ছে এসব শিষ্টাচারবর্জিত রাজনীতিকের মূলধন।
প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই দেখতে পাই এসব ডেমোগগ কিভাবে জলজ্যান্ত সত্যকে টুঁটি চেপে হত্যা করে মিথ্যার বেসাতি সাজিয়ে জনমনে মিথ্যা ছড়ানোর কাজে ব্যস্ত। উদ্দেশ্য তাদের একটাই, প্রতারণার ওপর ভর করে ক্ষমতা দখল। বাংলাদেশে কয়েক বছর ধরে এই মহলটি ‘রাতের ভোট’ নামে একটি কথা ছড়িয়ে জনগণকে এমন ধারণা নিতে বাধ্য করছে যে বিগত নির্বাচনে কে বা কারা রাতের অন্ধকারে ভোটের বাক্স পূর্ণ করে দিয়েছে। দুঃখজনক কথা হলো, যাঁরা এমনটি দাবি করছেন, তাঁদের কেউই সে দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ দেখাতে পারছেন না। সক্রেটিসের ভাষায়, এদের বেলায় যুক্তি ও সুতর্কের পরাজয় ঘটছে। ২০১৩ সালে ৫ মে ঢাকা শহরে সারা দিন বিপুল জ্বালাও-পোড়াও শেষ করে ধর্মান্ধ কিছু রাজনীতিক যখন রাতের বেলায় ছেলের বয়সী বহু মাদরাসাছাত্রকে নিয়ে শাপলা চত্বরে জমায়েত হয়ে পরদিন ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়ে অসাংবিধানিক পন্থায় নির্বাচিত সরকার উত্খাতের ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছিলেন, তখন আমাদের দক্ষ পুলিশ, র্যাব, বিজিবির সদস্যরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিনা রক্তপাতে ষড়যন্ত্রকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার পর রাজনৈতিক প্রতারকরা বলতে শুরু করল শাপলা চত্বরে জমায়েতদের ছত্রভঙ্গ করতে বহু লোককে হত্যা করা হয়েছে। শুধু দেশের মানুষকেই প্রতারিত করার জন্য এ ধরনের উলঙ্গ মিথ্যার আশ্রয় নেননি, বিদেশি মানবাধিকারকর্মীদেরও প্রতারিত করার মানসেই তাঁরা সেদিন দৃশ্যত মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছিলেন।
সাম্প্রতিককালে খালেদা জিয়াকে নিয়েও চলছে বিরতিহীন মিথ্যাচার। সত্যের অপলাপ যে রাজনৈতিক শিষ্টাচারের জন্য ধ্বংসাত্মক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। খালেদা জিয়া একজন দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি। সরকার মানবতার বিরল উদাহরণ সৃষ্টি করে তাঁকে জেলখানার পরিবর্তে নিজের ভাড়া করা বাসভবনে থাকার সুযোগ করে দিয়েছে। এর পরও বলা হচ্ছে, তাঁকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে, যে দাবি দৃশ্যতই মিথ্যা। বহু অসত্য কথা বলা হচ্ছে তাঁর স্বাস্থ্যের অবস্থা নিয়ে। আইনের অপব্যাখ্যা করা হচ্ছে প্রতিদিন। বেশ কিছুকাল আগে স্বয়ং খালেদা জিয়া, যিনি একাধিকবার দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তাঁর বাড়ির পাশে তাঁরই নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত জনৈক মহিলা পুলিশ সদস্যকে বলেছিলেন, ‘এই গোপালি, আমি গোপালগঞ্জের নাম বদল করে দেব।’ একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখে এ ধরনের নিম্নমানের অশ্রাব্য বক্তব্য প্রমাণ করে রাজনৈতিক শিষ্টাচার বলে কোনো কিছু তাঁরা কখনো শেখার চেষ্টা করেননি।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মূলকথা হচ্ছে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল। এ ব্যবস্থায় বল প্রয়োগের কোনো অবকাশ নেই। অথচ কয়েক মাস ধরে যুক্তিতর্কের মাধ্যমে জনগণের মন জয় করার বদলে কিছু রাজনীতিক কথা বলছেন সন্ত্রাস ও অস্ত্রের ভাষায়। রাজনীতির শিষ্টাচারের প্রতি ন্যূনতম সম্মান প্রদর্শন না করে প্রতিদিনই প্রকাশ্যে বলে বেড়াচ্ছেন, কিভাবে তাঁরা বল প্রয়োগের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটাবেন। সরকারের নীতির সমালোচনার বদলে রাজনীতিকদের ওপর ব্যক্তি আক্রমণই তাঁদের মধ্যে প্রাধান্য পাচ্ছে। এতে একটি রাজনৈতিক দলের কয়েকজন সাবেক মহিলা সংসদ সদস্যের জুড়ি নেই। তাঁদের অনেকেই সংসদ সদস্য থাকাকালে সংসদে দাঁড়িয়েই এমন সব অকথ্য ভাষা ব্যবহার করতেন, যা লজ্জাকর। তাঁদের এ ধরনের কথাবার্তা এখনো থামেনি। টেলিভিশন টক শোতে এবং ইউটিউবের মাধ্যমে তাঁদের এ ধরনের নোংরা ভাষ্য চলছে অবিরাম। যুক্তিতে পরাজিত হলেই তাঁরা ব্যক্তি আক্রমণ শুরু করে শিষ্টাচার নামের তত্ত্বকে পদদলিত করেন। পাঠ্যপুস্তক বিষয়ে একটি ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দলের নেতা শিক্ষামন্ত্রীকে যে ভাষায় কটাক্ষ করেছেন, তার উদাহরণ শিষ্টাচার লঙ্ঘনের ইতিহাসে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ ধরনের রাজনৈতিক দলের বাংলাদেশে রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই।
কত নগ্নভাবে শিষ্টাচার লঙ্ঘন করা যায়, সত্যকে গলা টিপে হত্যা করা যায়, তার চরমতম দৃষ্টান্ত দেখা গেছে পদ্মা সেতু নির্মাণের সময়। তখন খালেদা জিয়ার অবস্থানে থাকা রাজনৈতিক নেত্রীও একজন অর্বাচীনের মতো বলেছিলেন, তিনি পদ্মা সেতুতে উঠবেন না। কারণ এটি ভেঙে পড়বে। শুধু খালেদা জিয়াই নন, একই ধরনের মন্তব্য করেছিলেন তাঁর দলের মহাসচিব মির্জা আলমগীরসহ অন্যরাও। সরকার সর্বোচ্চ কৃতিত্বের সঙ্গে করোনার টিকা এনে সেটি সর্বসাধারণের মধ্যে প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিলে এসব ডেমোগগ ‘এগুলো গঙ্গার জল’ বলে জনগণকে টিকা গ্রহণে নিরুৎসাহ করার চেষ্টায় মেতে উঠেছিলেন। পদ্মা সেতু এবং করোনার টিকায় তাঁদের শিষ্টাচারবিবর্জিত কথাগুলোর ব্যাপারে অবশ্য ম্যাকিয়াভেলির তত্ত্ব তাঁরা কাজে লাগাতে পারেননি। কেননা তাঁরা নিজেরাই যখন পদ্মা সেতু ব্যবহার শুরু করলেন এবং ‘গঙ্গার জল’ বলে প্রতারণামূলকভাবে উল্লেখ করা সেই টিকাই তাঁদের শরীরে প্রবেশ করালেন, তখন তাঁদের প্রতারণাসুলভ অভিসন্ধির কথা জনগণের বুঝতে বাকি থাকেনি।
দেশের রাজনীতি দেশের মানুষ নির্ধারণ করবে, সমস্যা থাকলে তারাই সমাধানের পথ বের করবে—এটাই রাজনৈতিক শিষ্টাচারের দাবি। এ দাবির চরম বিপর্যয় ঘটিয়ে কিছু রাজনৈতিক নেতা স্বর্গ-নরক এক করে ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন দূতাবাসে যেভাবে দৌড়ঝাঁপ দিয়ে বিদেশিদের নিমন্ত্রণ করছে বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে, তা মীরজাফর কর্তৃক ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানিকে বাংলার নবাবিতে তাঁকে বসানোর জন্য আহ্বান করার কথাই মনে করিয়ে দেয়। শুধু তা-ই নয়, দূতাবাসে গিয়েও তাঁরা শিষ্টাচারবহির্ভূত বহু উদ্ভট কথা বলে বেড়াচ্ছেন।
রাজনৈতিক শিষ্টাচারের একটি মৌলিক উপাদান হচ্ছে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদের লোকদের প্রতি প্রয়োজনীয় সম্মান প্রদর্শন। বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে একটি দল নির্বাচনে জয়ী হলে পরাজিত দল জয়ী দলকে অভিনন্দন জানায়, এমনকি নির্বাচনে তাদের আপত্তির দাবি থাকলেও। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেই সংস্কৃতি আমাদের দেশে খুবই বিরল। পরাজিত দল বিজয়ী দলকে অভিনন্দন জানানো দূরের কথা, তাদের বিরুদ্ধে যে ভাষা ব্যবহার করে, তাতে সবারই লজ্জা পাওয়ার কথা। কয়েক বছর আগে খালেদা জিয়ার ছেলে কোকোর প্রয়াণ ঘটলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজনৈতিক শিষ্টাচারের প্রতি সম্মান দেখিয়ে খালেদা জিয়ার বাড়ি গেলেও তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বাড়িতে প্রবেশ করতে না দিয়ে যে শিষ্টাচারবিরোধী কাজটি করেছেন, তা জাতির জন্য অশনিসংকেত।
রাজনীতির অঙ্গনে বিপরীত ভাবধারার লোকদের গঠনমূলকভাবে সমালোচনা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ। শালীন ভাষা প্রয়োগ করেও অত্যন্ত তির্যকভাবে সমালোচনা করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশে এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সমালোচনায় চলে খিস্তিখেউর। বর্তমানে সংসদে যে দলটি স্বীকৃতভাবে বিরোধী দল, সে দলের নেতারা এবং অন্য সদস্যরাও অনেক সময় তীব্র ভাষায় সরকারের সমালোচনা করে থাকেন। কিন্তু তাঁরা সাধারণত শালীনতার মাত্রা অতিক্রম করেন না। সব রাজনীতিক এই ফর্মুলা অনুসরণ করলে রাজনীতিতে শিষ্টাচার প্রচলিত হতে পারে, গণতন্ত্রের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে যা খুবই প্রয়োজন। প্লেটোর ভাষায়, দার্শনিক রাজা আজকের বাস্তবতায় প্রযোজ্য না হলেও এমন রাজনৈতিক নেতাকর্মী অবশ্যই প্রয়োজন, যাঁরা শিষ্টাচারের মাত্রা দিয়ে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করবেন। সেটি জনগণেরও প্রত্যাশা।
লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি