প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সফর এবং এই সফর শুরু করার ঠিক আগ মুহূর্তে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল সম্পর্কে ঘোষণা অতীব তাৎপর্যপূর্ণ।
এত দিন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে বাংলাদেশের যোগদান নিয়ে চলছিল নানা জল্পনা-কল্পনা। এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অনেক কিছু বিবেচনায় নিতে হয়। তবে ‘সব ভালো তার শেষ ভালো যার’। দেরিতে হলেও অবশেষে বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিকে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। এটি যে দেশের জন্য মঙ্গলকর, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে সোজা বলতে গেলে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি হলো সেই বিষয়, যার সংক্ষিপ্ত উপপাদ্য হচ্ছে আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইনের বিধান অনুযায়ী মহাসাগর সব দেশের চলাচলের জন্য উন্মুক্ত রাখা, অর্থাৎ কোনো বিশেষ দেশ যেন মহাসমুদ্রকে নিজ দেশে কুক্ষিগত করতে না পারে, তার নিশ্চয়তার জন্য একটি কৌশল। এর পেছনে মূল কারণ ছিল আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন লঙ্ঘন করে চীন দক্ষিণ চীন সাগরকে তার নিজ দেশের সার্বভৌমত্বের মধ্যে আনার সব পরিকল্পনা করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং দৃঢ় পদক্ষেপও নিয়েছে। মুখ্যত দক্ষিণ চীন সাগরকে সব দেশের জন্য উন্মুক্ত রাখার জন্যই ইন্দো-প্যাসিফিক ভাবনা। এটি কোনো সামরিক জোট নয়।
মহাসমুদ্রের বিষয়ে রয়েছে ১৯৮২ সালের আন্তর্জাতিক সমুদ্র কনভেনশন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৮২ সালের মধ্যে চলমান সমুদ্র আইন প্রবর্তনের জন্য জাতিসংঘের তৃতীয় সম্মেলন শেষে ওই কনভেনশন বাস্তবতা পায়। এ ছাড়া রয়েছে সমুদ্র সম্পর্কীয় প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইন, যা আন্তর্জাতিক আইনের জনক হিউগো গ্রোসিয়াসের সময় থেকেই প্রচলিত। ১৯৮২-এর কনভেনশনে বলা হয়েছে, কনভেনশনের কোনো বিধান এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হলে প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইনের বিধানও কার্যকর থাকবে। সমুদ্রের জলকে মোট পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়। যথা—১. টেরিটরিয়াল সি, ২. কন্টিজিয়াস জোন, ৩. এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন, ৪. কন্টিনেন্টাল সেলফ, ৫. মহাসাগর। উপকূল থেকে ১২ মাইল পর্যন্ত এলাকাকে টেরিটরিয়াল সি বলা হয়। এর ওপর উপকূলীয় রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব বিস্তৃত সমুদ্রের জলের অভ্যন্তরে, তলদেশে এবং আকাশেও। তবে টেরিটরিয়াল সির ওপর দিয়ে অন্য রাষ্ট্রের নৌচলাচলের অধিকার খণ্ডিত নয়, যদিও আকাশপথে অবারিত বিমান চলাচলের অধিকার নেই। বেইস লাইন থেকে ২৪ মাইলব্যাপী কন্টিজিয়াস জোন। এটা মূলত সংশ্লিষ্ট দেশের ইমিগ্রেশন, কাস্টমস আইন এবং অপরাধ দমনের অধিকারের জন্য, যাতে কেউ সেই পথে মহাসাগরে পৌঁছতে না পারে। এর আকাশে অধিকার থাকে না। এরপর রয়েছে এক্সক্লুসিভ অর্থনৈতিক জোন, যা সংশ্লিষ্ট দেশ ২০০ মাইল পর্যন্ত দাবি করতে পারে। ওই জোনে সংশ্লিষ্ট দেশের একচ্ছত্র অধিকার থাকে পানির মধ্যে, কোনো সমুদ্রের তলদেশের ওপরে অথবা তলদেশের নিচে সম্পদ, যথা—মাছ, তেল, গ্যাস আহরণের, কৃত্রিম দ্বীপ, স্ট্রাকচার প্রতিষ্ঠার এবং গবেষণা চালানোর। তবে অন্য দেশের নৌচলাচলে বা আকাশপথে বাধা দেওয়া যায় না।
এরপর রয়েছে কন্টিনেন্টাল সেলফ, বেইস লাইন থেকে ২০০ মাইলব্যাপী এটি অনেকটাই এক্সক্লুসিভ অর্থনৈতিক জোনের মতো। এটিতে সংশ্লিষ্ট দেশের অধিকার শুধু নির্জীব পদার্থ এবং সেলফিসের ওপর। কৃত্রিম দ্বীপ এবং স্থাপনাও করা যায় ওই এলাকায়। কিন্তু অন্য দেশ সাবমেরিন কেবল, পাইপলাইন এবং মেরিন গবেষণা চালাতে পারে। এক্সক্লুসিভ অর্থনৈতিক জোনের মতো কন্টিনেন্টাল সেলফেও অন্য দেশের নৌচলাচল থামানো যায় না। এক্সক্লুসিভ অর্থনৈতিক জোনের বাইরের অঞ্চলকে মহাসাগর বলা হয়। এটি মানবজাতির মিলিত সম্পদ নামে অভিহিত, যার ওপর কোনো দেশের একক অধিকার থাকতে পারে না।
প্রধানমন্ত্রীর সফর, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল এবং আমাদের স্বার্থচীনও ১৯৮২ সালের কনভেনশনভুক্ত। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট কনভেনশনটি অনুমোদন না করলেও সরকার মনে করে যে সমুদ্র সম্পর্কীয় প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইনই যথাযোগ্য এবং সেই আইনের বিধানাবলি কনভেনশন থেকে খুব ভিন্ন নয়। চীন কনভেনশনের অংশ হলেও এবং প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা বাধ্য থাকলেও অন্যায়ভাবে মহাসাগরে তার সার্বভৌমত্ব দাবি করছে এবং তা প্রয়োগের চেষ্টায় লিপ্ত। সে দেশটি এক্সক্লুসিভ অর্থনৈতিক জোন এবং কন্টিনেন্টাল সেলফও অন্য দেশের নৌচলাচলের অবারিত অধিকারে হস্তক্ষেপ করছে এবং মহাসমুদ্রে কৃত্রিম দ্বীপ সৃষ্টি করে অন্য দেশের অধিকার ক্ষুণ্ন করছে।
প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফর এবং সে দেশের সঙ্গে সাতটি সমঝোতা ও একটি চুক্তি আমাদের অর্থনীতির জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এর ফলে চীনা ঋণের ফাঁদ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। অতীতে জাপানের সঙ্গেই আমাদের ব্যবসা বেশি ছিল। এখন চীন সেই অবস্থা দখল করেছে। চীনা ঋণ যে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশকে পথে বসিয়েছে, তার প্রমাণের অভাব নেই।
চীনা ঋণের ফাঁদ সম্পর্কে সর্বশেষ সতর্কবাণী উচ্চরণ করেছেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। লন্ডনভিত্তিক প্রভাবশালী দৈনিক টেলিগ্রাফ পত্রিকার ১৬ এপ্রিল সংখ্যায় এক দীর্ঘ নিবন্ধে ক্যামেরন বিশ্বের দরিদ্র এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে চীনা ঋণের খপ্পর থেকে রক্ষা করার জন্য বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) এবং স্বল্প পরিচিত মাল্টিলেটারাল ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকগুলোকে (এমডিবি) ব্যাপক সংস্কারের অনুরোধ করেন।
ক্যামেরন লিখেছেন যে চীন ২০১৭ সাল থেকে বিশ্বের বৃহত্তম ঋণদাতায় পরিণত হয়েছে অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী সব ঋণ প্রদানকারী সংস্থা, যথা—বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, এমডিবি প্রভৃতিকে পেছনে ফেলে। তিনি উল্লেখ করেছেন যে চীন অবকাঠামো নির্মাণের জন্য অকাতরে ঋণ দিচ্ছে এই বলে যে চীনা ঋণের সঙ্গে শর্তাবলি কম, কিন্তু চীন যেভাবে ঋণ দিচ্ছে তা শোধ করার ক্ষমতা ঋণগ্রহীতা দেশগুলোর নেই বিধায় দেশগুলো বিপদে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। ক্যামেরন লিখেছেন, “আমরা যদি সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করতে না পারি এই বলে যে ‘আমরা আছি’, তাহলে তাদের চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্প থেকে দূরে রাখা যাবে না।” এসব উল্লেখ করে ক্যামেরন বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং এমডি ব্যাংকগুলোকে বলেছেন সংস্কার সাধনের জন্য, যাতে তারা চীনের খপ্পর থেকে অনুন্নত দেশগুলোকে রক্ষা করতে পারে।
তাঁর ভাষ্য মতে, সাম্প্রতিক সময়ে এসব দেশে ইনভেস্টমেন্টের প্রয়োজনীয়তা বহুগুণে বেড়ে গেছে কভিডের আক্রমণ, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বিশ্বের আবহাওয়ায় পরিবর্তনের কারণে। দরিদ্র দেশগুলো যে দারুণ আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে তার সমাধান সহজ নয়। তিনি লিখেছেন, এ সংকট রোধকল্পে প্রতিবছর এক ট্রিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করতে হবে সবুজ জ্বালানি এবং রক্ষণীয় উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যবহারের জন্য। ডেভিড ক্যামেরনই যে চীনের ঋণের ফাঁদ এবং সে দেশের বিতর্কিত বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের বিরুদ্ধে লিখেছেন তা নয়। ২০১৭ সাল থেকেই বিশ্বের বহু প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের শীর্ষ কর্মকর্তা এবং রাষ্ট্রনায়ক এ বিষয়ে সতর্কতা দিয়ে আসছেন।
জাপান আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু। মুক্তিযুদ্ধকালে জাপানের জনগণ এবং সরকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেই ছিল। জাপানে বসবাসরত বেশ কিছু বাঙালি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেছে। অন্যদিকে ৭১-এ চীনের ভূমিকা কারো অজানা নেই। চীনের বিরোধিতার কারণেই বহু বছর আমরা জাতিসংঘের সদস্য হতে পারিনি। বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় চীন আমাদের স্বীকৃতি পর্যন্ত দেয়নি। চীন আমাদের ঋণ দিচ্ছে বটে, কিন্তু সেই কাজে চীনের বিরাট স্বার্থ রয়েছে। চীনের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক ভারসাম্যে রয়েছে বিস্তর তফাত।
জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের মৈত্রীর সম্পর্কের সূচনা বঙ্গবন্ধুর জাপান সফরের মাধ্যমে। তার পর থেকে জাপান এককভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে আবির্ভূত হয়। বঙ্গবন্ধু সেতুর মতো বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে জাপানি সহযোগিতায়। মেট্রো রেল-পাতাল রেলের প্রকল্প বাস্তবায়নে এগিয়ে এসেছে বিশ্বের শীর্ষ পর্যায়ের অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তি সামর্থ্যের অধিকারী দেশটি। আমরা আশা করব, প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক জাপান সফরের মাধ্যমে দুই দেশের আস্থার সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছবে। কিভাবে ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিনিক্স পাখির মতো উড়াল দিতে হয় সেই কৃতিত্বের অধিকারী জাপান। এ ক্ষেত্রে তাদের সাফল্য আমাদের জন্যও অনুকরণীয়।
লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি