প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে শক্তিশালী অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার পাশাপাশি এ অঞ্চলে বিদ্যমান সামুদ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এই অঞ্চল নানাবিধ প্রতিকূলতার মুখোমুখি হচ্ছে। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের শান্তি, সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য অঞ্চলে দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা আবশ্যক।
শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানীর হোটেল হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ‘ষষ্ঠ ভারত মহাসাগর সম্মেলন (আইওসি)- ২০২৩’ উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ভারত মহাসাগর শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, এই অঞ্চলের সব দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। একটি টেকসই পদ্ধতিতে রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভূমিতে প্রত্যাবাসনে সক্রিয় বৈশ্বিক সহায়তা কামনা করেন প্রধানমন্ত্রী।
এবারের ভারত মহাসাগর সম্মেলনের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘টেকসই ভবিষ্যতের জন্য শান্তি, অংশীদারিত্ব এবং সমৃদ্ধি’। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন এ সম্মেলনের আয়োজন করছে।
সম্মেলন উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উন্নয়ন, স্থিতিশীলতা, টেকসই ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য শক্তিশালী অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা এবং সামুদ্রিক নিরাপত্তা জোরদারসহ মোট ছয়টি অগ্রাধিকার প্রস্তাব পেশ করেন।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এবং আফ্রিকার অঞ্চলগুলোতে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং কৌশলগত উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব রয়েছে। বর্তমানে বৈশ্বিক জনসংখ্যার ৬৪ শতাংশ এ অঞ্চলে বাস করে। জিডিপিতে এ অঞ্চলের অবদান ৬০ শতাংশ।
ভারত মহাসাগরকে গুরুত্ব দিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশের ‘ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল’ তৈরির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী দেশগুলোর টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সামুদ্রিক যোগাযোগ ও বাণিজ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। কিন্তু এই বিপুল সম্ভাবনা এখনও অনেকটাই অব্যবহৃত রয়ে গেছে।
সমুদ্র পথের বিপুল সম্ভবনার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, বর্তমানে, সাগর-মহাসাগরগুলোর মাধ্যমে বিশ্ব বাণিজ্যের ৯০ শতাংশ ও তেল পরিবহনের ৬০ শতাংশ পরিচালিত হচ্ছে। সমুদ্রপথে প্রকৃত বাণিজ্য বিগত ১৫ বছরে তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালানোর আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, খাদ্য, জ্বালানি এবং সার সঙ্কটের ফলে বিশ্বজুুড়ে মানুষের জীবনযাত্রা অসহনীয় হয়ে পড়েছে। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলকেও জলবায়ু পরিবর্তন, সামুদ্রিক নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবাদ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবং ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠার জন্য এ অঞ্চলের দেশগুলোকে অংশীদারিত্ব এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টার ওপর জোর দিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, শান্তির বার্তাকে সর্বাত্মকভাবে সুসংহত করতে ‘শান্তির সংস্কৃতি’ প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য বলে বাংলাদেশ মনে করে। এ কারণেই বিশ্বব্যাপী শান্তিরক্ষা ও শান্তি বিনির্মাণ প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ সবসময় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা জাতিসংঘে সর্বোচ্চ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ।
বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের অগ্রগতির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, গত এক দশকে বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৫ তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের চরম দারিদ্র্যের হার ৫.৬ শতাংশে নেমে এসেছে। আমাদের মাথাপিছু আয় গত এক দশকে তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২ হাজার ৮২৪ ডলার হয়েছে। উপরন্তু, বাংলাদেশ ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় সব মানদণ্ড পূরণ করেছে।
সরকারপ্রধান বলেন, আমরা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখি, যেখানে শক্তিশালী ভৌত অবকাঠামো আমাদের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির সহায়ক হবে। গত বছর আমরা নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু’ উদ্বোধন করেছি। সম্প্রতি আমরা রাজধানীতে প্রথম মেট্রো রেল উদ্বোধন করেছি। আমরা চট্টগ্রামে ৩.২ কিলোমিটার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের নির্মাণ কাজ শীঘ্রই শেষ করব। নদীর তলদেশ দিয়ে এ ধরনের স্থাপনা, দক্ষিণ এশিয়ায় এটিই হবে সর্বপ্রথম।
তিনি বলেন, আমাদের স্বপ্ন হলো ২০৪১ সালের মধ্যে একটি জ্ঞান-ভিত্তিক, আধুনিক, উন্নত, সমৃদ্ধ সোনার বাংলা নির্মাণ করা এবং ২১০০ সালের মধ্যে একটি সমৃদ্ধ ও জলবায়ু সহনশীল ব-দ্বীপ হিসেবে গড়ে তোলা। লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য কৌশল হিসেবে আমরা টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সবার জন্য সুযোগ তৈরি করার উপর গুরুত্বারোপ করছি।
সম্মেলনে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উন্নয়ন, স্থিতিশীলতা, টেকসই ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য শক্তিশালী অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা এবং সামুদ্রিক নিরাপত্তা জোরদারসহ ছয়টি অগ্রাধিকার প্রস্তাব পেশ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমি ষষ্ঠ ভারত মহাসাগর সম্মেলনে ছয়টি অগ্রাধিকারের বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করতে চাই। আমরা সম্প্রতি ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক প্রণয়ন করেছি।
শেখ হাসিনার উত্থাপিত ছয়টি প্রস্তাব হচ্ছে, প্রথম: ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোকে তাদের উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যত নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ‘সমুদ্র কূটনীতি’ জোরালো করতে হবে। দ্বিতীয়: এই অঞ্চলের অনেক দেশ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবের ঝুঁকিতে থাকার বিষয়টি বিবেচনা করে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং তদসংশ্লিষ্ট ক্ষয়ক্ষতি কমাতে আমাদের সহযোগিতা বাড়াতে হবে।
তৃতীয়: একটি স্থিতিশীল এবং টেকসই ভবিষ্যতের জন্য ভারত মহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস এবং সমীহের ভিত্তিতে শক্তিশালী অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে হবে। চতুর্থ: ভারত মহাসাগরে সামুদ্রিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিদ্যমান ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা, যার মধ্যে সমুদ্রে জরুরি পরিস্থিতিতে সাড়া দেওয়া, অনুসন্ধান ও উদ্ধার কাজে সহায়তা এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে নৌ ও বিমান চলাচল নিশ্চিত করা হবে।
পঞ্চম: ‘শান্তির সংস্কৃতি’ চর্চা এবং জনবান্ধব উন্নয়নের প্রসার করতে হবে। শান্তিপূর্ণ, সমতাভিত্তিক এবং অন্তর্ভূক্তিমূলক সমাজ গঠনের উদ্দেশ্যে বিশ্ব জনগোষ্ঠীর অর্ধেক-নারী সম্প্রদায়কে যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। ষষ্ঠ: উন্মুক্ত, স্বচ্ছ, নিয়মভিত্তিক বহুপাক্ষিক ব্যবস্থার প্রসার করা, যা অন্তর্ভূক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে এই অঞ্চলে এবং এর বাইরেও সমতাভিত্তিক টেকসই উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন মরিশাসের রাষ্ট্রপতি পৃথ্বীরাজসিং রূপন, মালদ্বীপের উপ-রাষ্ট্রপতি ফয়সাল নাসিম, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস. জয়শঙ্কর, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন, সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মন্ত্রী ও পররাষ্ট্র বিষয়ক সেকেন্ড মন্ত্রী ড. মালিকী ওসমান, ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট রাম মাধব প্রমুখ।