একসময় নিজের ক্যাটারিং কোম্পানির মাধ্যমে ক্রেমলিনে খাবার সরবরাহ করতেন ইয়েভজেনি প্রিগোশিন। এ কারণে ‘পুতিনের পাচক’ হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। পরবর্তী সময়ে ভাড়াটে সেনা সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তার বাহিনীর ভাড়াটে যোদ্ধারা রাশিয়ার হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে লড়েছেন। রুশ সেনাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই চালিয়েছেন।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এই প্রিগোশিনই আজ শনিবার রুশ সামরিক নেতৃত্বকে উৎখাতের ঘোষণা দিয়েছেন। এরই মধ্যে রাশিয়ার রোস্তভ-অন-দন শহরে ঢুকে সেনা সদর দপ্তর নিয়ন্ত্রণে নেওয়ারও দাবি করেছেন তিনি। খবর এনডিটিভি, এনপিআর, আল–জাজিরা ও বিবিসির।
ইউক্রেনে রাশিয়ার চলমান যুদ্ধে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি ইয়েভজেনি প্রিগোশিন। রাশিয়ার হয়ে লড়াই করা প্রিগোশিন হঠাৎই যে রুশ সামরিক নেতৃত্বের মুখোমুখি দাঁড়ালেন, তা কিন্তু নয়। ইউক্রেনে লড়াই চালাতে গিয়ে অনেকবারই রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছিলেন ভাগনারপ্রধান। রুশ সামরিক নেতাদের সঙ্গে তার বৈরিতা দিন দিন বাড়ছিল। তবে এখন তা খোলাখুলি দ্বন্দ্বে রূপ নিয়েছে।
গত জানুয়ারি মাসে ইউক্রেনের সোলেদার শহরের দখল নেওয়ার পর এককভাবে এর পুরো কৃতিত্ব দাবি করেছিলেন প্রিগোশিন। তাঁর অভিযোগ, ভাগনারের অর্জনকে নিজেদের বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে রুশ সেনাবাহিনী। এরপর তিনি অভিযোগ করতে থাকেন, রুশ বাহিনী তাদের পর্যাপ্ত অস্ত্র সরবরাহ করছে না।
অস্ত্র সরবরাহ না পেলে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিজের সেনাদের সরিয়ে নেওয়ারও হুঁশিয়ারি দেন তিনি। আর তখন থেকেই মূলত রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই শোইগু ও সেনাপ্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভের সঙ্গে প্রিগোশিনের সম্পর্ক তিক্ত হতে থাকে।
ভাগনার গ্রুপের প্রধান বেশ কয়েকবার রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি অভিযোগ করেন, ইউক্রেনে লড়াই চালাতে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ভাগনারকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা করছে না। ভাগনার গ্রুপের সফলতায় ঈর্ষান্বিত হয়ে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে বলেও অভিযোগ করেন প্রিগোশিন।
সম্প্রতি রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গে শোইগুর দেওয়া একটি আদেশের জেরে তিক্ততা আরও বেশি তীব্র হয়ে ওঠে। শোইগু নির্দেশ দেন, সব স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও বাহিনীকে ১ জুলাইয়ের মধ্যে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে। মন্ত্রণালয়ের এ প্রস্তাবে সমর্থন জানান পুতিন। তবে এতে নাখোশ হন ভাগনারপ্রধান।
এ পটভূমিতে গত শুক্রবার ক্রেমলিনকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানান প্রিগোশিন। এদিন নিজের টেলিগ্রাম চ্যানেলে বেশ কিছু অডিও ও ভিডিও বার্তা প্রকাশ করেন তিনি। ভাগনারের একটি ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা এবং ইউক্রেন যুদ্ধে হাজারো রুশ সেনা নিহত হওয়ার জন্য রাশিয়ার সামরিক নেতাদের দায়ী করেন তিনি।
ভাগনারপ্রধান অভিযোগ করেন, রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গে শোইগু ভাগনারকে ধ্বংস করে দিতে একটি অভিযানের তদারকি করছেন। তবে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় প্রিগোশিনের অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
প্রিগোশিনের পোস্ট করা একটি ভিডিও বার্তায় অভিযোগ করা হয়, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দেশটির নাগরিকদের এবং পুতিনকে ধোঁকা দিচ্ছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার শুরু করা অভিযানের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন ভাগনারপ্রধান।
রাশিয়ার কৌঁসুলিরা ভাগনারপ্রধানের বিরুদ্ধে একটি ফৌজদারি তদন্ত শুরু করেছে। ‘সশস্ত্র বিদ্রোহ’ নিষিদ্ধ করে প্রণীত আইনের আওতায় এ মামলা করা হয়েছে। রাশিয়ার নিরাপত্তা সংস্থা এফএসবি বলেছে, তারা প্রিগোশিনকে আটক করতে চাইছে। প্রিগোশিনের নির্দেশ না মানতে ভাগনারের যোদ্ধাদের প্রতিও আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।
এর মধ্যেই আজ পৃথক অডিও বার্তায় প্রিগোশিন বলেন, তিনি ও তার বাহিনীর যোদ্ধারা ইউক্রেনের সীমানা পেরিয়ে রাশিয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন এবং দক্ষিণাঞ্চলীয় রোস্তভ-অন-দন শহরে ঢুকছেন। প্রিগোশিন বলেন, আমরা এখানে (ভাগনার গ্রুপ) ২৫ হাজার মানুষ আছি। দেশে এসব অরাজকতা কেন হচ্ছে, তা আমরা খুঁজে বের করব। যারা আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে চান, তাদের সবার উদ্দেশ্যে বলছি, আমাদের এসব বিশৃঙ্খলা দূর করতে হবে।
প্রিগোশিন আরও হুমকি দিয়েছেন, যারা তাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে, তাদের সবাইকে তারা শেষ করে দেবেন। তবে তিনি বলেছেন, এটি কোনো সামরিক অভ্যুত্থান নয়, এটি ন্যায়বিচার পাওয়ার দাবিতে যাত্রা।
দীর্ঘদিন ধরে পুতিনও ভাগনারপ্রধানের এসব হুংকার সহ্য করে আসছেন। ইউক্রেনে গুরুত্বপূর্ণ কিছু এলাকায় যুদ্ধের জন্য তিনি ভাগনার বাহিনীর যোদ্ধাদের ওপর নির্ভর করে আসছেন। তবে আজ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে পুতিন সব বাহিনীকে সংহতি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। ভাষণে রুশ প্রেসিডেন্ট বলেন, যা কিছু ঘটছে, তা ‘বিশ্বাসঘাতকতা’। এটি ‘দেশের জনগণের পিঠে ছুরি চালানোর শামিল’।
রুশ প্রেসিডেন্ট বলেন, সংকট মোকাবিলায় সব ধরনের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তবে টেলিভিশনে প্রচারিত সংক্ষিপ্ত ওই ভাষণে একবারও প্রিগোশিনের নাম উচ্চারণ করেননি পুতিন। তিনি শুধু ভাগনার গ্রুপের নাম উল্লেখ করেছেন এবং রাশিয়ার জন্য লড়াই করায় বাহিনীর যোদ্ধাদের প্রশংসা করেছেন।