বিএনপির ধানের শীষের ছায়াতলে এখন জামায়াত ও ঐক্যফ্রন্ট। জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে না এমন ঘোষণা দিয়ে ড. কামালের নেতৃত্বে বিএনপিসহ ছোট ছোট কয়েকটি দলের সমন্বয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যাত্রা শুরু করলেও এখন যুদ্ধাপরাধী এই দলের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই নির্বাচন করবে ঐক্যফ্রন্ট। ফ্রন্টের প্রধান দল বিএনপির নির্বাচনী প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে প্রার্থিতার বিষয়ে ঐক্যফ্রন্ট আরো আগেই সিদ্ধান্ত নিলেও জামায়াতের বিষয়টি নিয়ে লুকোচুরি খেলছিল। তবে শেষ মুহূর্তের নাটকীয়তায় ধানের শীষ প্রতীকেই মনোনয়নপত্র দাখিল করেন জামায়াত প্রার্থীরা।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সভাপতি নজরুল ইসলাম খান বলেন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী ও যুদ্ধাপরাধে নেতৃত্ব দেয়া দল জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের ধানের শীষের মনোনয়ন দেয়ায় কোনো সমস্যা নেই। তিনি বলেন, আমি আপনাদের আশ্বস্ত করছি, কোনো যুদ্ধাপরাধীকে আমরা ধানের শীষ প্রতীক দেব না। তবে কেউ যুদ্ধাপরাধ না করে থাকলে তাকে দিতে অসুবিধা কী। জামায়াতের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাও আছেন।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যাত্রা শুরু করে গত ১৩ অক্টোবর। এর আগে জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে কোনো বৃহত্তর ঐক্যে যাবেন না বলে সাফ জানিয়েছিলেন গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন। তিনি বলেছিলেন, জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে কোনো বৃহত্তর ঐক্যে যাব না। সারা জীবনে যা করিনি, শেষ জীবনে এসে তা করতে যাব কেন? তার এই কথার সঙ্গে তাল মিলিয়েছিলেন জোটের অন্যতম শরিক মাহমুদুর রহমান মান্না, কাদের সিদ্দিকী, আ স ম রবসহ প্রগতিশীল রাজনীতিকরা। এমনকি ঐক্য গড়ার লক্ষ্য সফল করতে ঐক্যফ্রন্টের প্রতিটি সভা ও সমাবেশে জোর দিয়েই বিএনপির নেতারা বলেছেন, ঐক্যে জামায়াত নেই। ঐক্যের আলোচনায় মধ্যস্থতা করা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর একটি কৌশলে অবশেষে জামায়াতকে ছাড়ার প্রশ্ন ছাড়াই বিএনপির সঙ্গে জোটে আবদ্ধ হন ড. কামাল হোসেন।
জাফরুল্লাহর কৌশলটি ছিল বিএনপি ঐক্যবদ্ধ থাকবে জামায়াতের সঙ্গে। আর জাতীয় ঐক্য হবে বিএনপির সঙ্গে। ফলে এখানে জামায়াত কোনো বিষয় নয়। কৌশল মোতাবেকই শেষ পর্যন্ত ঐক্য হলেও জামায়াত ইস্যুতে সবচেয়ে বেশি সরব থাকা যুক্তফ্রন্টের অন্যতম দল বিকল্পধারা চেয়ারম্যান এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও তার ছেলে মাহী বি. চৌধুরী ঐক্যফ্রন্ট্র থেকে ছিটকে পড়েন। তবে ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর জামায়াত ইস্যুতে ড. কামালকে ধীরে ধীরে ম্যানেজ করেন বিএনপির নেতারা। শেষ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত ও ঐক্যফ্রন্ট মিলিতভাবে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে জোটগত ভাবেই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে।
বিএনপি নেতারা বলছেন, জামায়াতকে ধানের শীষ প্রতীক দেয়া হয়েছে জোটগতভাবে নির্বাচন করার জন্য। জামায়াত ২০ দলীয় জোটে আছে, যে জোটের নেতৃত্বে আছে বিএনপি। এ ছাড়া, প্রতীকে একাকার হয়ে যাওয়ার বিষয়টি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও জামায়াতের সঙ্গে আন্দোলন করেছে, তাদের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেছে। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক কৌশলের কারণেই বিষয়টিকে সামনে আনা হচ্ছে।
এ বিষয়ে জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, জামায়াতের সঙ্গে ঐক্য হয়নি। জামায়াতকে বাদ দিয়েই আমাদের ঐক্য হয়েছে। তবে জামায়াত-বিএনপির জোটসঙ্গী। তাদের নিয়ে বিএনপি কী করবে নির্বাচনের নমিনেশন দেবে কিনা বা কোন প্রতীক দেবে সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। এটা নিয়ে তর্কে যাব না।
সূত্র জানায়, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের একাধিক শরিকের আপত্তির মুখেও বিএনপি তার জোটসঙ্গী জামায়াতকে ধানের শীষে নির্বাচনের সুযোগ করে দিয়েছে। গত ৩ মাস ধরে ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের সঙ্গে জামায়াতকে সঙ্গে রেখেই নির্বাচনের বিষয়ে ঠাণ্ডা মাথায় যুদ্ধ করেছেন বিএনপির নেতারা। এমনকি ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে জামায়াত নির্বাচন করতে চাইলে সেখানে ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের সঙ্গে আপত্তি তোলেন বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতাও। পরে দলের দফায় দফায় বৈঠক শেষে এ বিষয়টি সুরাহা হয়।
এ বিষয়ে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, আমাদের ২৫ জন প্রার্থীকে ধানের শীষে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। আরো ৪-৫টি আসন নিয়ে আলোচনা অব্যাহত আছে। তবে নির্বাচনী প্রতীক ধানের শীষই থাকছে। জামায়াতে ইসলামীর নেতা এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, জোটের প্রার্থী হিসেবেই জামায়াতের প্রার্থীরা ধানের শীষে নির্বাচন করবেন। এতে ঐক্যফ্রন্টের কোনো সমস্যা হবে বলে আমরা মনে করি না।
কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান তালুকদার (বীর প্রতীক) বলেন, আমরা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট করেছি বিএনপি এবং আরো কয়েকটি দলের সঙ্গে। বিএনপি তাদের শরিক দলের সঙ্গে কী করবে, এটা তাদের ব্যাপার। আর এখনতো জামায়াত নামে কোনো দল নির্বাচন করতে পারবে না। এই দলটিকে কোনো না কোনো মার্কা নিয়ে নির্বাচন করতে হবে। তারা যে দলের মার্কা নিয়ে নির্বাচন করবে, তখন তারা সেই দলের সদস্যও হয়ে গেল।
অন্যদিকে ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গেও ধানের শীষে প্রতীকে নির্বাচন করার বিষয়ে একমত হলেও আসন ভাগাভাগির বিষয়টি সুরাহা করতে পারেনি বিএনপি। ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে বিএনপির আসন বণ্টনে ৩টি আসন নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকার ওই ৩ আসনের মধ্যে ২টি আসনে বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী রয়েছেন। কিন্তু আসন দুটি ছাড় দিতে নারাজ ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শরিক গণফোরাম। যদিও ঢাকার ১টি আসন গণফোরামের সাধারণ সম্পাদকের জন্য ছাড় দিতে রাজি বিএনপি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের শরিকদের ৬০টির মতো আসন ছাড় দিতে পারে বিএনপি। এর মধ্যে ২০ দলীয় জোটে জামায়াতকে ২৫ ও অন্য শরিকদের ১৫টি আসন ছাড় দিয়েছে বিএনপি। আর বাকি ২০টি আসন গণফোরাম, জেএসডি ও নাগরিক ঐক্যকে দিতে চায় বিএনপি। যদিও একসময় ঐক্যফ্রন্টের তিন শরিক দল বিএনপির কাছে ১৫ আসন দাবি করেছিল। কিন্তু সেই দাবি থেকে সরে এলেও মূলত গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসীন মন্টুর চাওয়া তিন আসন নিয়েই জটিলতা তৈরি হয়েছে। মোস্তফা মহসীন মন্টু ঢাকা-১, ঢাকা-২ ও ঢাকা-৭ আসন থেকে নির্বাচন করতে আগ্রহী।
এই তিন আসনে বিএনপিকে ছাড় দিতে একেবারেই নারাজ গণফেরাম। কিন্তু ঢাকা-১ ও ২ আসনে নিজেদের ২ হেভিয়েট প্রার্থী থাকায় বেকায়দায় পড়েছে বিএনপি। এ দুই আসনে যথাক্রমে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান ও স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বিএনপির প্রার্থী। মোস্তফা মহসীন মন্টুকে ঢাকা-৭ আসন ছেড়ে দিতে রাজি হলেও তাতে সন্তুষ্ট নয় গণফোরাম। ফলে দফায় দফায় বৈঠকের পরও বিষয়টির সুরাহা করতে পারছেন ঐক্যফ্রন্ট নেতারা। ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকের পরও আসন ভাগাভাগির ফয়সালা হচ্ছে না। ফলে মনোনয়ন প্রত্যাহারের আগের দিন পর্যন্ত গড়াতে পারে আসন বণ্টন নিয়ে দরকষাকষি।
গণফোরামের নেতারা বলছেন, আসন বণ্টনের বিষয়ে বিএনপিকে আরো উদার হতে হবে। জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির বিষয়ে বড় ভ‚মিকা রেখেছেন ড. কামাল হোসেন ও মোস্তফা মহসীন মন্টু। ড. কামাল হোসেনের কারণেই বিএনপির নেতাকর্মীরা এখন থলে থেকে বের হতে পারছেন। সুতরাং দলের সাধারণ সম্পাদক মন্টুকে বিএনপির ছাড় দেয়া উচিত। জানা গেছে, আসন ভাগাভাগি চ‚ড়ান্ত না হওয়ায় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দলগুলোকে নিজেদের মতো করে মনোনয়ন জমা দিতে বলে বিএনপি। ফলে নিজেদের মতো করে মনোনয়ন জমা দেন শরিক দলগুলোর প্রার্থীরা।
বাংলাদেশ