‘চোখ মেললে কিংবা কান পাতলে নিত্যই শিশু, নারী, বল-ভরসাহীন মানুষ তথা সমগ্র মানবতার ওপর নির্মম আচরণের সংবাদ, নিয়ত মার খাচ্ছে সমাজের ধারণা। কোথায় যাচ্ছি আমরা?’
‘পহেলা বৈশাখ তুই বুক বেঁধে আশার আঁচলে/নতুন দিনের স্বপ্ন মগ্ন হোস বিদ্যুৎ বিভায়।’ কবি রফিক আজাদের এই কবিতার মতোই বাংলার ঘরে ঘরে আজ উৎসবের আমেজ।
রমনার বটমূলের বৈশাখী বার্তায় সেই উৎসবের আমেজ ছাড়িয়েও অত্যাচার-অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অবিচল থাকার ডাক এসেছে।
আর সবাই নিজেকে বিশুদ্ধ করার চেষ্টা করার আহ্বানের কথা জানিয়েছেন ছায়ানটের সভাপতি সনজীদা খাতুন। তিনি বলেন, আর আমরা যেন নীতিবিহীন অন্যায় অত্যাচারের নীরব দর্শকমাত্র হয়ে না থাকি।
সনজীদা খাতুনের ভাষায়, প্রতিবাদে প্রতিকার সন্ধানে হতে পারি অবিচল- নববর্ষ এমন বার্তাই সঞ্চার করুক আমাদের অন্তরে। শুভ হোক নববর্ষ।
নিপীড়নের প্রতিবাদ করতে গিয়ে আগুনে ঝলসে হত্যার শিকার নুসরতের জন্য দেশ যেন ক্ষোভে ফুঁসছে। ঠিক সেই সময় নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর কর্মসূচিতে সব সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে শুভবোধের জাগরণের এই আহ্বান এল।
আজ রোববার বিভিন্ন আয়োজন ও আঙ্গিকে দেশে বর্ষবরণ চলছে। সংগীতায়ন ছায়ানট রাজধানীর রমনা বটমূলে ১৪২৬ বঙ্গাব্দকে বরণ করেছে সম্মেলক কণ্ঠের সংগীতে। সেই সঙ্গে এক মিনিট নীরবতায় শপথ নিয়েছে সবাই, সব অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে তারা।
‘অত্যাচার অনাচার নিপাত যাক, জয় হোক সত্যে ও সুন্দরের’
অর্থনৈতিক নানা সূচকে দেশের উন্নতি হলেও সামাজিক বৈষম্য-অনাচার আমাদের পিছু ছাড়ছে না। গত সপ্তাহে নিজের প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদ করায় তাকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। সারা দেশে সেই ঘটনার প্রতিবাদ চলছে।
সেই বাস্তবতার কথা স্মরণ করে ছায়ানট সভাপতি সনজীদা খাতুন বলেন, চোখ মেললে কিংবা কান পাতলে নিত্যই শিশু, নারী, বল-ভরসাহীন মানুষ তথা সমগ্র মানবতার ওপর নির্মম আচরণের সংবাদ, নিয়ত মার খাচ্ছে সমাজের ধারণা। কোথায় যাচ্ছি?
তিনি বলেন, নিষ্কলুষ শিশু সন্তান কোনো সমাজবাসীর অত্যাচারের শিকার হয় কী করে? সমাজ কি পিতামাতা, ভাই বোন, সন্তানসন্ততির গৃহ আর প্রতিবেশী নিয়ে গঠিত শান্তি নিবাস নয়?
তার মতে, স্বার্থান্বেষী অমানুষদের আত্মসুখ সন্ধানের ফলে নির্যাতনের হাত থেকে পরিত্রাণ পায় না পরিবার। সমাজের কঁচিকাঁচা থেকে শুরু করে কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী, সমাজের কোনো মানুষ। কিছু মানুষ কি পাষণ্ড হয়ে উঠল!
তিনি বলেন, নববর্ষ যদি ভ্রাতৃত্ববোধ-মানবতাবোধের উন্মেষ না ঘটাতে পারে, তবে নতুন দিন কী বার্তা নিয়ে আসে?
এ অন্যায়ের প্রতিবাদে এবার ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান সনজীদা খাতুন। এরপর সবাইকে দাঁড়িয়ে এক মিনিটি নীরবতা পালনের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা সবাই উঠে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করব, আমাদের ক্ষোভ জানাব, প্রতিবাদ জানাব, দেশে অনাচারের বিরুদ্ধে।
তিনি বলেন, নুসরাত জাহান, তনু, সাগর-রুনি, মিতু… যে সমস্ত বিষয়ে আমরা আজ পর্যন্ত কোনো খবর পেলাম না বিচারের, সেসব বিষয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে এবং বিগত প্রাণগুলোর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা এক মিনিট নীরবে দাঁড়িয়ে থাকব।
এই নীরব প্রতিবাদের শেষে ছায়ানট সভাপতি বলেন, অত্যাচার অনাচার নিপাত যাক, জয় হোক সত্যের সুন্দরের।
প্রভাতী আয়োজনের গানগুলো কাজী নজরুল ইসলাম, অতুলপ্রসাদ সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, লালন শাহ, মুকুন্দ দাস, অজয় ভট্টাচার্য, শাহ আবদুল করিম, কুটি মনসুর, সলিল চৌধুরী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা থেকে নির্বাচন করা হয়েছে।
সংগীত পরিবেশনা পর্বে ছায়ানটের বড়দের দল সম্মেলক কণ্ঠে পরিবেশন করে ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী’, রবীন্দ্রসংগীত ‘সকল কলুষ তামস হর, জয় হোক তব জয়’, ‘আনো আনো অমৃত বারি’, ‘নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়’, ‘কোন মেস্তরি নাও বানাইল’, ‘ও মোদের দেশবাসীরে আয়রে’।
ছোটদের দল সম্মেলন কণ্ঠে পরিবেশন করে ‘আপনি অবশ হলি’, ‘ভাইয়ের দোরে ভাই কেঁদে যায়’, ‘তুমি বাহির থেকে’, ‘এমন মানব জনম আর কি হবে’। পরে ছোট ও বড়দের দল মিলে পরিবেশন করে ‘সংঘ শরণ তীর্থযাত্রা’, ‘আয়রে বাঙ্গালি আয় সেজে আয়’।
এছাড়া বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, শিশু একাডেমি, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, কেন্দ্রীয় কচিকাঁচার মেলা, বেণুকা ললিতকলা কেন্দ্রসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে।
রাজধানীর পাঁচতারকা হোটেল সোনারগাঁও, র্যাডিসন, ওয়েস্টিন, ঢাকা রিজেন্সি, খাজানাসহ হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলোর উদ্যোগেও উদযাপিত হবে নতুন বছরের উৎসব। পহেলা বৈশাখ উদযাপন করবে ঢাকা ক্লাব, গুলশান ক্লাব, উত্তরা ক্লাবও।
তবে গত তিন বছরের ধারাবাহিকতায় নিরাপত্তাজনিত কারণে এবারও বিকাল ৫টার মধ্যে বর্ষবরণের সব অনুষ্ঠান শেষ করার নির্দেশনা দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অন্যদিকে পুরো জাতি মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির মৃত্যুর শোকে শোকাহত।
এদিকে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ানের (র্যাব) ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক (ডিজি) কর্নেল জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, বর্ষবরণে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাজধানীর উৎসবস্থলগুলো সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় থাকবে এবং তা সার্বক্ষণিক মনিটরিং করবে র্যাব।
তিনি বলেন, যে কোনো ধরনের নাশকতা ঠেকাতে প্রস্তুত র্যাব। শুক্রবার দুপুরে রমনা বটমূলে পহেলা বৈশাখ অনুষ্ঠানকে ঘিরে র্যাবের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ শেষে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খানসহ র্যাবের বিভিন্ন ব্যাটালিয়নের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
পহেলা বৈশাখ ঘিরে কোনো ধরনের হুমকি আছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে কর্নেল জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কোনো হুমকি নেই। রাজধানীতে র্যাবের পাঁচটি ব্যাটালিয়নের অধিকাংশ কর্মকর্তাই নববর্ষের নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকবেন।
তিনি বলেন, রমনা বটমূলসহ গুরুত্বপূর্ণ সব ভেন্যুতে ডগ স্কোয়াডসহ বোম্ব ডিস্পোজাল ইউনিট সুইপিং করবে। এছাড়া টহল টিম, মোটরসাইকেল পেট্রোল ও অবজারভেশন পোস্ট থাকবে।
বড় ভেন্যুগুলো মনিটরিং করার জন্য আমরা নিয়ন্ত্রণকক্ষ স্থাপন করেছি। বড় ভেন্যুতে মোবাইল কোর্টসহ মেডিকেল টিম থাকবে, যাতে দেশের মানুষ নির্বিঘ্নে নববর্ষ উদযাপন করতে পারে।