বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী আবরার আহাম্মেদ চৌধুরীকে চাপা দেয়ার আগের রাতে সু-প্রভাত বাসের চালক সিরাজুল ইসলাম, সহকারী ইব্রাহিম হোসেন ও কন্ডাক্টর ইয়াছিন আরাফাত বাসের মধ্যে ঘুমান। ঘুমানোর আগে তারা একসঙ্গে গাঁজা খান।
পরের দিন সকালে ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে ৬/৭ জন যাত্রী নিয়ে গাজীপুরার উদ্দেশে বাসটি ছেড়ে আসে। শাহজাদপুরের বাঁশতলায় পথচারী সিনথিয়া সুলতানা মুক্তাকে (২০) চাপা দেয়।
এরপরও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে প্রগতি সরণিতে জেব্রা ক্রসিং পার হওয়ার সময় আবরারকে চাপা দেয়। এ সময় বাস তার মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়। ফলে তার মাথা থেঁতলে মগজ বের হয়ে যায়। ঘটনাস্থলে মারা যায় আবরার।
বিইউপি শিক্ষার্থী আবরার আহাম্মেদ চৌধুরী নিহত হওয়ার ঘটনায় করা মামলায় সু-প্রভাত বাসের মালিক-চালকসহ চারজনের বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে পৃথক দুটি চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। চার্জশিটে এসব কথা উল্লেখ করেছেন মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক কাজী শরিফুল ইসলাম।
দৈনিক ১০৩০ টাকা জমা দিয়ে চলত বাসটি
চার্জশিটে তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন- ঘাতক বাসটির (ঢাকা মেট্রো ব-১১-৪১৩৫) যান্ত্রিক সকল বিষয় ঠিক ছিল। বাসটির মালিক ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড (ইফাত অটোস)। ইফাত বাসটি ননী গোপালের কাছে বিক্রি করে। ননী গোপালের চারটি বাস রয়েছে। এর আগে ঘাতক বাসটি একাধিক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করা হয়। কিন্তু বিআরটিএ কর্তৃক কেউ মালিকানা পরিবর্তন করেনি। বিআরটিএ ও রুট পারমিট কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাসটি ৪৫ আসনের হওয়া সত্ত্বেও ননী গোপাল পরিবর্তন করে ৪৯ আসন করেন।
বাসটি মহাখালী টু বি-বাড়িয়া রুটের হলেও ননী গোপাল সু-প্রভাত পরিবহনের সদরঘাট ভিক্টোরিয়া পার্ক টু গাজীপুর রুটের সভাপতি আলাউদ্দিন ও সেক্রেটারি আশরাফকে ম্যানেজ করে সদরঘাট ভিক্টোরিয়া পার্ক টু গাজীপুরা রুটে চালাতে থাকেন। সু-প্রভাত পরিবহনের ব্যানারে বাস চালাতে সভাপতি আলাউদ্দিন ও সেক্রেটারি আশরাফুলকে নিয়োজিত ব্যক্তি ১০৩০ টাকা করে জমা দিয়ে বাসটি চালাতো।
রাতে একসঙ্গে গাঁজা খেয়ে বাসের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকে তারা
চালক সিরাজুল ইসলাম ও কন্ডাক্টর ইয়াছিন আরাফাত প্রায় দুই বছর যাবত ননী গোপালের বাসের ডিউটিতে নিয়োজিত ছিলেন এবং বাসটিতে তারা ডিউটি করতেন। ননী গোপাল আসামি সিরাজুল ইসলামকে হালকা ড্রাইভিং লাইসেন্স সহযোগিতা করে পাইয়ে দেন।
গত ১ মার্চ সিরাজুল ইসলাম ও মোতালেব হোসেন দৈনিক তিন হাজার টাকা চুক্তিতে ননী গোপালের কাছ থেকে বাসটি বুঝে নেন। ১৮ মার্চ রাতে সিরাজুল ইসলাম মোতালেবের কাছ থেকে রাত সাড়ে ১১টার দিকে বাসটি বুঝে নেন। কিছুক্ষণ পরে ইয়াছিন ও ইব্রাহিম আসে। রাতে তারা একসঙ্গে গাঁজা খেয়ে বাসের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকে। পরের দিন তারা তিন জনে ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে সকাল ৬টার দিকে ৬/৭ জন যাত্রী নিয়ে গাজীপুরার উদ্দেশে বাসটি নিয়ে ছেড়ে আসে।
বাঁশতলার কিছুদূর আগে অন্য একটি সু-প্রভাত বাসের সঙ্গে পাল্লা দেয়
শাহজাদপুর বাঁশতলার কিছুদূর আগে বাসটি অন্য একটি সু-প্রভাত বাসের সঙ্গে পাল্লাপাল্লি করে একে অপরকে কয়েকবার আগে পিছু হয়। বাঁশতলায় ঘাতক বাসটিকে অতিক্রম করে সু-প্রভাতের অন্য একটি বাস রাস্তার ডান পাশে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠা-নামা করতে থাকে। তখন ডান পাশে জায়গা না থাকায় ঘাতক বাসটি দ্রুত বেপরোয়া গতিতে চালিয়ে যাওয়ার সময় অন্য বাসের জন্য অপেক্ষমাণ মিরপুর আইডিয়াল ল্যাবরেটরি কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী সিনথিয়া সুলতানা মুক্তাকে সজোরে ধাক্কা দিলে তিনি রাস্তার ওপরে পড়ে গড়াগড়ি খান এবং গুরুতর আহত হন। ওই ঘটনা ঘটিয়ে সিরাজুল ইসলাম বাস চালাতে থাকেন। তখন বাসের যাত্রীরা ক্ষিপ্ত হয়ে সিরাজুলকে মারধর করে বাস থেকে নামিয়ে মোড়ে কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশের কাছে দেন এবং যাত্রীরা বাস থেকে নেমে যান।
ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকা সত্ত্বেও গাড়ি চালাতে নির্দেশ দেন মালিক
তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন- বাসটি অ্যাক্সিডেন্ট করে রাস্তার মাঝখানে থাকায় কন্ডাক্টর ইয়াছিন আরাফাত তার মোবাইল থেকে ননী গোপালকে ফোন করে অ্যাক্সিডেন্টের কথা বললে তিনি ইয়াছিনকে দ্রুত চালিয়ে বিশ্বরোডে নিয়ে যেতে বলেন। ইয়াছিনের ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকা সত্ত্বেও ননী গোপাল তাকে এ নির্দেশ দেন। তার নির্দেশে বাসটি নিয়ে পালানোর সময় যমুনা ফিউচার পার্কের কাছে আবরার আহাম্মেদ চৌধুরীকে চাপা দেয়। এতে আবরারের মৃত্যু ঘটে।
বাসটি চালানোর উপযুক্ত ছিল না সিরাজুল
চার্জশিটে তদন্তকারী কর্মকর্তা উল্লেখ করেন- চালক সিরাজুল ইসলামের ড্রাইভিং লাইসেন্সটি হালকা ধরনের অর্থাৎ ৪৫/৪৯ আসনের বাস চালানোর উপযুক্ত নয়। অপরদিকে ঘাতক বাসটি সদরঘাট টু গাজীপুরা রুটের না হওয়া সত্ত্বেও বাসের মালিক ননী গোপাল সু-প্রভাত কোম্পানির সভাপতি ও সেক্রেটারিকে ম্যানেজ করে বে-আইনিভাবে সদরঘাট টু গাজীপুরা রুটে চালিয়ে আসছিলেন। বাসের ড্রাইভার, হেলপার নিয়োগ দেয়ার এখতিয়ার বাসের মালিকেরই। কিন্তু ননী গোপাল সরকার ড্রাইভার সিরাজুল ইসলামের হালকা লাইসেন্স, কন্ডাক্টর ইয়াছিনের কোনো প্রকারের ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকা সত্ত্বেও এবং হেলপার ইব্রাহিমের যোগ্যতা বুদ্ধিমত্তা যাচাই-বাছাই না করে অনুপযুক্ত ড্রাইভার, হেলপার নিয়োগ দেন।
যে ধারায় চার্জশিট দেয়া হল চারজনের বিরুদ্ধে
আবরার নিহত হওয়ার ঘটনায় বাসের কন্ডাক্টর ইয়াছিন আরাফাত ও মালিক ননী গোপাল সরকারের বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ২৭৯/৩০৪/১০৯ ধারায় চার্জশিট দেন তদন্ত কর্মকর্তা। অপরদিকে ঘটনায় জড়িত থাকার কোনো তথ্যপ্রমাণ না পাওয়ায় বাসের চালক সিরাজুল ইসলাম ও তার সহকারী ইব্রাহিম হোসেনকে অব্যাহতির আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।
এছাড়া পথচারী সিনথিয়া সুলতানা মুক্তাকে আহত করায় বাসের চালক সিরাজুল ইসলাম, তার সহকারী ইব্রাহিম হোসেন, কন্ডাক্টর ইয়াছিন আরাফাত ও মালিক ননী গোপাল সরকারের বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ২৭৯/৩৩৮-ক/১০৯ ধারায় আরেকটি চার্জশিট দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।
এ মামলায় বাসচালক সিরাজুল ইসলাম, সহকারী ইব্রাহিম হোসেন, কন্ডাক্টর ইয়াছিন আরাফাত ও মালিক ননী গোপাল সরকার কারাগারে। তারা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
আবরারের বাবা মামলার অভিযোগে যা বলেছেন
১৯ মার্চ সকাল ৭টার দিকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন প্রগতি সরণি এলাকায় সু-প্রভাত (ঢাকা-মেট্রো-ব-১১-৪১৩৫) বাসের চাপায় বিইউপির শিক্ষার্থী আবরার আহাম্মেদ চৌধুরী নিহত হন। সেদিন রাতেই আবরারের বাবা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আরিফ আহাম্মেদ চৌধুরী বাদী হয়ে গুলশান থানায় মামলা করেন। মামলায় আসামি করা হয় বাসের চালক সিরাজুল ইসলাম, হেলপার ইব্রাহিম হোসেন, কন্ডাক্টর ইয়াছিন আরাফাত ও মালিক ননী গোপাল সরকারকে। মামলার ধারা পেনাল কোডের ২৭৯/ ৩৩৮ (ক)/৩০৪/ ও ১০৯ । মামলা নং ৩০।
মামলার অভিযোগে বাদী বলেন, বাসটির চালক বেপরোয়া ও দ্রুতগতিতে বাড্ডার দিক থেকে প্রগতি সরণি রোড দিয়ে কুড়িলের দিকে যাওয়ার পথে গুলশান থানাধীন শাহজাদপুরের বাঁশতলায় পথচারী সিনথিয়া সুলতানা মুক্তাকে (২০) চাপা দিয়ে রক্তাক্ত জখম করে। আবারও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে গুলশান থানাধীন প্রগতি সরণিতে জেব্রা ক্রসিং পার হওয়ার সময় আমার ছেলে আবরারকে চাপা দেয়। এ সময় বাস তার মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়। ফলে তার মাথা থেঁতলে মগজ বের হয়ে যায়। ঘটনাস্থলে সে মারা যায়।