অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পানিতে চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুতে দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বন্যা দেখা দেয়। পরে মধ্যাঞ্চলেও বন্যার বিস্তৃতি ঘটে। উন্নতির দিকে যাওয়ার পর অতিবৃষ্টির কারণে উত্তরাঞ্চলে ফের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। চলমান বন্যায় এ পর্যন্ত দেশের ১৭ জেলায় ৪৮ লাখ ৬৯ হাজার ৫১৬ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ মানুষগুলোর পাঁচ লাখ ৩১ হাজার ৯৪৯টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সরকারি তথ্যে বন্যায় সারাদেশে এক লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমির ফসল এবং পাঁচ হাজার ২১৪ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ২৫ জুলাই বন্যার ক্ষয়ক্ষতির তথ্য থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালেয়ের জাতীয় দুর্যোগ সাড়াদান ও সমন্বয় কেন্দ্র (এনডিআরসিসি) বন্যাদুর্গত ১৭ জেলা থেকে ক্ষয়ক্ষতির এসব তথ্য সংগ্রহ করেছে। জেলা প্রশাসক, জেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও), জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তার (ডিআরও) মাধ্যমে এসব তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বৃহস্পতিবারের তথ্য অনুযায়ী ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, ধরলা এবং তিস্তা নদ-নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে, অপরদিকে গঙ্গা-পদ্মা এবং সুরমা-কুশিয়ারা নদীতে কমছে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর ও ভারত আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এবং কাছাকাছি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চল ও বিহারের কতিপয় স্থানে আগামী ২৪ ঘণ্টায় ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।
আগামী ২৪ ঘণ্টায় কুড়িগ্রাম,গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির সামান্য অবনতি হতে পারে, অপরদিকে সিলেট, সুনামগঞ্জ জেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলার বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে বলেও বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র জানিয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী ২৮টি জেলা বন্যাকবলিত হয়। এর মধ্যে ১১ জেলার বন্যার পানি ইতোমধ্যে নেমে গেছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শাহ কামাল বলেন, ‘কোথাও ত্রাণের জন্য হাহাকার নেই। একটি ঘটনাও কোথাও নেই। প্রত্যেক জেলায় ৪০০/৫০০ টন খাদ্য মজুদ আছে, ত্রাণের হাকাকার কেন হবে? সরকারের তো কোনো অপ্রতুলতা নেই।’
বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে জানিয়ে শাহ কামাল বলেন, ‘বন্যা চলে যাওয়ার পর আমরা পুনর্বাসনে নজর দেব।’
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, কুড়িগ্রামে ৯ লাখ ৬৫ হাজার ৭৪০ জন, বগুড়ায় ২ লাখ ৩৮ হাজার ৮২৫ জন, গাইবান্ধায় ৫ লাখ ৯৭ হাজার ৪৯৭ জন, সিরাজগঞ্জে ৩ লাখ ২৯ হাজার ৪৩১ জন, শেরপুরে এক লাখ ১৪ হাজার ৫০০ জন, টাঙ্গাইলে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৭৯৮ জন, জামালপুরে ১২ লাখ ৮৩ হাজার ৭৯০ জন, ফরিদপুরে ৬০ হাজার ২৪ জন, শরিয়তপুরে ৩০ হাজার ৩৭২ জন, রাজবাড়ীতে ১৩ হাজার ৭২৫ জন, মাদারীপুরে ২৯ হাজার ৬৬৫ জন, মানিকগঞ্জে ৭১ হাজার ৬২৬ জন, মুন্সিগঞ্জে ৪ হাজার ১৯০ জন, সিলেটে ৩ লাখ ৯৭ হাজার ৯৩ জন, সুনাগঞ্জে এক লাখ ৮৫ হাজার ৮১৫ জন এবং হবিগঞ্জে ১৬ হাজার ৪২৫ জন আংশিক বা পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জাতীয় দুর্যোগ সাড়াদান ও সমন্বয় কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী আংশিক ও সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ির সংখ্যা পাঁচ লাখ ৩১ হাজার ৯৯৪টি। এর মধ্যে কুড়িগ্রামে ২ লাখ ৪০ হাজার ৫২৫টি, বগুড়ায় ৩ হাজার ৭৩টি, গাইবান্ধায় ৬১ হাজার ৩৭০টি, সিরাজগঞ্জে ৫০ হাজার ৫২৮টি, শেরপুরে ২ হাজার ২৯৫টি, টাঙ্গাইলে ২৮ হাজার ৩৯৫টি, জামালপুরে ৫২ হাজা ৮৩০টি, ফরিদপুরে ১০ হাজার ৫৭৭টি, রাজবাড়ীতে ৪০০টি, মাদারীপুরে ২৮ হাজার ৫৬৩টি, মানিকগঞ্জে ১৯ হাজার ৮৮৯টি, মুন্সিগঞ্জে ৯২০টি, সিলেটে ২২ হাজার ৯৪১টি, সুনামগঞ্জে ৭ হাজার ৭৫টি এবং হবিগঞ্জে ২ হাজার ৬২৩টি ঘরবাড়ি রয়েছে।
চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নীলফামারী, লালমনিরহাট, নেত্রকোণা, মৌলভীবাজারের বন্যার পানি নেমে গেছে বলে জানিয়েছে দুর্যোগ সাড়াদান ও সমন্বয় কেন্দ্র।
অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি
বন্যায় কুড়িগ্রামে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এক হাজার ২৮টি, ক্ষতিগ্রস্ত টিউবওয়েল ৯ হাজার ৭৩৪টি। বগুড়ায় ১৮৫টি ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ১১টি ব্রিজ বা কালভার্ট, ২ হাজার ৮২৬টি টিউবওয়েল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাঁস-মুরগি মারা গেছে ৮টি।
গাইবান্ধায় ১ দশমিক ৫ কি.মি. বাঁধ (সম্পূর্ণ) ও ৯৭ দশমিক ৫ কি.মি. আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গবাদিপশু একটি এবং ৪ হাজার ৬২০টি হাঁস-মুরগি মারা গেছে। ৩৯টি ব্রিজ ও কালভার্ট এবং এক হাজার ৫২টি ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত টিউবওয়েল ১০ হাজার ৫১৯টি।
সিরাজগঞ্জে বন্যায় মৃত হাঁস-মুরগির সংখ্যা ৩ হাজার ৮৮৫টি, গবাদিপশু মারা গেছে ৪টি, ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান (শিক্ষা/ধর্মীয়) ৭টি (সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত) ও ২৫৬টি (আংশিক), ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ ২ কি.মি. (আংশিক), ক্ষতিগ্রস্ত টিউবওয়েল ৫ হাজার ৭২১টি।
শেরপুরে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান (শিক্ষা/ধর্মীয়) একটি (সম্পূর্ণ) ও ১৪৫টি (আংশিক), ক্ষতিগ্রস্ত ব্রিজ/কালভার্ট ৫টি, ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ এক কি.মি. (সম্পূর্ণ), ৮ দশমিক ৭৫ কি.মি. (আংশিক), ক্ষতিগ্রস্ত টিউবওয়েল ৮৩৫টি।
টাঙ্গাইলে মৃত গবাদিপশুর সংখ্যা ৪টি, মৃত হাঁস-মুরগির সংখ্যা ৫ হাজার ৩০০টি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ১৬৯টি (আংশিক) ও ৮৮টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্রিজ বা কালভার্ট ১৩টি (আংশিক), ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ ১৪ কি.মি. (আংশিক), ক্ষতিগ্রস্ত টিউবওয়েল ৪ হাজার ২৩০টি।
জামালপুরে মৃত হাঁস-মুরগির সংখ্যা ৬ হাজার ৭৬০টি, ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ৬৮১টি (আংশিক) ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ১৬৫টি (আংশিক)। ক্ষতিগ্রস্ত পুল বা কালভার্ট ৩২টি (আংশিক), ক্ষতিগ্রস্ত টিউবওয়েল ১৫ হজার ৫৭টি।
ফরিদপুরে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ ৮ দশমিক ৩০ কি.মি. (আংশিক), ক্ষতিগ্রস্ত টিউবওয়েল ১৮৬টি। শরীয়তপুরে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ৮টি (আংশিক), ক্ষতিগ্রস্ত ব্রিজ ও কালভার্ট একটি, ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ শূন্য দশমিক ১৫০ কি.মি. (আংশিক)।
রাজবাড়ীতে ক্ষতিগ্রস্ত টিউবওয়েল ৩৫টি। মাদারীপুরে ক্ষতিগ্রস্ত টিউবওয়েলেএক ৫৫৬টি এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্রিজ ও কালভার্ট ২টি (সম্পূর্ণ)। মানিকগঞ্জে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ১৬টি (সম্পূর্ণ) ও ৬৫টি (আংশিক)। ক্ষতিগ্রস্ত ব্রিজ ও কালভার্ট ১৪টি, ক্ষতিগ্রস্ত টিউবওয়েল ১২২ টি।
মুন্সিগঞ্জে একটি মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা ৫ কি.মি. এবং ক্ষতিগ্রস্ত টিউবওয়েল ৭টি, ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ ৩ কি.মি. (আংশিক)।
সিলেটে বন্যায় ৯৫টি হাঁস-মুরগি ও ২৭টি ভেড়া মারা গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ৮৯টি (আংশিক), ক্ষতিগ্রস্ত ব্রিজ ও কালভার্ট ৫টি এবং ক্ষতিগ্রস্ত টিউবওয়েল এক হাজার ৫৬২টি।
সুনামগঞ্জে ৫৫৫টি শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৯৬টি ব্রিজ ও কালভার্ট, ৪ হাজার ৪২৭টি টিউবওয়েল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বন্যায়।