রোহিঙ্গা ইস্যুতে কারও সঙ্গে নিজেকে লড়াই জড়াতে চান না এবং এই সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান চান বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আমি কারও সঙ্গে লড়াইয়ে জড়াতে চাই না। আমি এই পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ একটি সমাধান চাই। কারণ, তারা (মিয়ানমার) আমার নিকটতম প্রতিবেশী।’
৩০ সেপ্টেম্বর (সোমবার) ওয়াশিংটন পোস্টের সাপ্তাহিক সাময়িকী টুডে’স ওয়ার্ল্ডভিউকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।
টুডে’স ওয়ার্ল্ডভিউয়ের বৈদেশিক নীতিবিষয়ক সাংবাদিক ঈশান থারুর লিখিত ‘রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের বোঝা হয়ে থাকতে পারে না : বলেন প্রধানমন্ত্রী’ শিরোনামে এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়।
প্রতিবেদনটিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, ‘কিন্তু যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মনে করে, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞায় কাজ হবে, তাহলে তো খুবই চমৎকার। তবে, আমি এই পরামর্শ দিতে পারি না।’
এতে আরও বলা হয়, শেখ হাসিনা জানান, তিনি এই ইস্যুটি নিয়ে মিয়ানমারের কার্যত বেসামরিক নেতা নোবেল বিজয়ী অং সান সু চির সঙ্গেও আলোচনা করেছেন।
‘তিনি (সু চি) এই পরিস্থিতির জন্য দেশটির সামরিক বাহিনীকে দায়ী করেন। তিনি আমাকে বলেছেন যে, সেনাবাহিনী তার কথা খুব একটা শোনে না।’
প্রতিবেদনে বলা হয, ভারতে ২০১৬ সালে আয়োজিত আন্তর্জাতিক শীর্ষ সম্মেলনকালে তাদের মধ্যে ওই বৈঠকটি হয়। এরপর থেকে সুকি দেশটির সামরিক বাহিনীর সিদ্ধান্তকেই সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন এবং এমনকি তিনি জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীটিকে বুঝাতে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটিও উচ্চারণ করেন না।
শেখ হাসিনা ওই সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘এখন আমি দেখতে পাচ্ছি যে তিনি (সু চি) তার অবস্থান থেকে সরে এসেছেন।’
সাম্প্রতিক একটি নিবন্ধের বরাত দিয়ে রিপোর্টে বলা হয়, ইউএন কমিশনের একটি প্রতিবেদন সতর্ক করে দিয়েছে, ২০১৭ সালে রাখাইন রাজ্যে যে ধরনের সহিংতার কারণে রোহিঙ্গারা দেশত্যাগে বাধ্য হয় এখনও সেখানে একই অবস্থা বিরাজ করছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘মিয়ানমার সরকারের একটি অংশের ওই গণহত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার জোরালো প্রমাণ মিলেছে। সেখানে আবারও গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার বড় ধরনের ঝুঁকি রয়েছে। মিয়ানমার সরকার গণহত্যা ঠেকাতে, গণহত্যার সুষ্ঠু তদন্ত করতে ও গণহত্যার অপরাধীদের শাস্তি দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
মিয়ানমারে নিযুক্ত জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহি লি এ মাসের গোড়ার দিকে সাংবাদিকদের বলেন, ‘সহিংসতা দমনে মিয়ানমার কিছুই করেনি। রাখাইনে এখনো যেসব রোহিঙ্গা আছেন, তারা ২০১৭ সালের আগস্টে সহিংসতার সময়কার মতোই ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছেন।’
নিবন্ধটিতে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের ছোট একটি দলের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে দেশটির সঙ্গে চুক্তি হলেও শরণার্থীদের অধিকাংশ রাখাইনে ফিরে যেতে ভয় পাচ্ছেন।
রোহিঙ্গাদের পক্ষে মানবাধিকার আইনজীবীদের বরাত দিয়ে নিবন্ধে বলা হয়, শরণার্থীরা মিয়ানমারে তাদের জন্য বিপজ্জনক ও অনিশ্চিত রাজ্যটিতে ফিরে যেতে ভয় পাচ্ছেন। সেখানে তারা সামরিক বাহিনী ও সরকারপন্থীদের দ্বারা সহিংস হামলার আশঙ্কা করছেন, যারা তাদের গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছিল এবং তাদের প্রিয়জনকে হত্যা ও ধর্ষণ করেছিল।
নিবন্ধে বলা হয়, নাগরিকত্ব আইনটি ১৯৮২ সালে কার্যকর হয়। এই আইনটির আওতায় রোহিঙ্গাদের অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘুদের সমান অধিকার ও নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়। মিয়ানমার কর্মকর্তারা রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ হিসেবে অভিহিত করে এবং তারা ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যে বসবাসরত সাধারণ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর বর্বরোচিত অভিযানকে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী অভিযান বলে আখ্যায়িত করে।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের দূরাবস্থার প্রতি সহানুভূতিশীল।
তিনি শুক্রবার ম্যানহাটনে একটি হোটেলে টুডেস ওয়ার্ল্ডভিউকে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর সংঘটিত সহিংসতার বিষয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্য এটা একটা বড় বোঝা, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তাদের ওপর যা ঘটেছে তা এক ধরনের গণহত্যা।’ তিনি পত্রিকাটিকে জানান, ‘হত্যা, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণসহ অনেক কিছু ঘটেছে। নিরাপত্তার জন্য তারা তাদের দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে।’
শেখ হাসিনাকে উদ্ধৃত করে পত্রিকার নিবন্ধে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের পরিস্থিতিও ভয়াবহ।’ তিনি পত্রিকাকে আরও বলেন, ‘আজকের দেশের এই বোঝা আঞ্চলিক সংকটে রূপ নিতে পারে। ক্রমবর্ধমান হতাশাগ্রস্ত ও কর্মহীন শরণার্থীরা মৌলবাদ ও উগ্রবাদের দিকে ঝুকে যেতে পারে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দীর্ঘদিন অবস্থান করলে খুব সহজেই তারা ধর্মান্তরিত হতে পারে অথবা ‘জঙ্গি গ্রুপগুলোতে’ যোগ দিতে পারে। তার সরকার গত সপ্তাহে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ এবং সেখানে টহলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গাদের এখন থাকার জন্য স্বাগত জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, ‘তারা আমাদের মাটিতে আছে। আর কিবা আমরা করতে পারি।’
সম্ভাব্য অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা এবং আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা যা ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র দেশটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওপর আরোপ করেছে এসবসহ মিয়ানমারকে চাপে ফেলতে আর কী করা যায়- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তার প্রত্যাশা- আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তার প্রতিবেশীর ওপর আরও চাপ প্রয়োগ করতে পারে। শেখ হাসিনা বলেন, মিয়ানমারের সমস্যা হচ্ছে তারা অন্য কারও কথা শোনে না। নিবন্ধে বলা হয়, শেখ হাসিনা এনজিও ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে বলেন, তার সরকার শরণার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে কাজ করছে।
তরুণী ও যুবতী নারীরা অবৈধ মানব পাচারের শিকার হচ্ছে- এমন রিপোর্টের প্রসঙ্গও তিনি উল্লেখ করেন।
নিবন্ধে বলা হয়, গত সপ্তাহে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের মঞ্চ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তৃতায় বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই সামাজিক অবস্থার অসমর্থতা বুঝতে হবে। তিনি আরও বলেন, তার দেশ ‘মিয়ানমারের নিজেদের সৃষ্ট সংকট’ মোকাবিলা করছে।
এতে আরও বলা হয়, প্রায় দুই বছর আগে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন জাতিগত নিধন অভিযানের শিকার হয়ে সীমান্তের ওপার থেকে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারী এবং তারা সেখানকার নাগরিক নয়- মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের এমন বক্তব্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একেবারেই গ্রহণ করেনি।
নিবন্ধে প্রতিবেদক কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপন করেন, যেমন- যে দেশে তাদের রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত হবে না এবং সহিংসতার হুমকি থেকে যাবে সেখানে তাদের প্রত্যাবাসন সম্পূর্ণ করা সম্ভব কি-না? অথবা ক্যাম্পের অবরুদ্ধ অবস্থায় তারা থেকে যাবে।
নিবন্ধে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, অন্যরা প্রভাবিত হয়নি এবং মিয়ানমার বুঝতে চাচ্ছে যে, তারা সেখানে সন্ত্রাসীদের মোকাবিলা করছে। মাহাথির বলেন, এ কারণে আমরা হতাশ। কারণ আমরা জানি যে, সেখানে আসলে গণহত্যা চলছে।