সরকার আরো সতর্ক হোক। ২০২০ সাল প্রায় আগত। সরকারের সব কর্মকাণ্ড যখন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী (মুজিব বর্ষ) উদ্যাপনের জন্য নিয়োজিত, তখন গুহায় লুকানো পরাজিত চক্র আবার মাথা তুলেছে সরকারের অপ্রস্তুতির সুযোগে দংশন করার জন্য। এবার হঠাৎ দ্রব্যমূল্য—বিশেষ করে পেঁয়াজের ঘাটতি ও দাম বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে মন্ত্রীদের অনভিজ্ঞতা ও অলসতাও কাজ করেছে কি না জানি না।
পলাশীর যুদ্ধের সময় হঠাৎ একদিন বৃষ্টি হয়েছিল। মীরজাফর এসে নবাবকে জানালেন, সৈন্যরা যুদ্ধক্লান্ত। তারা এক দিন যুদ্ধবিরতি চায়। শত্রুপক্ষ ইংরেজরাও এক দিন যুদ্ধবিরতি চায়। তা ছাড়া বৃষ্টির পানিতে কামানের গোলাবারুদ ভিজে গেছে। এক দিন লাগবে তা শুকাতে। নবাব সিরাজ এক দিনের যুদ্ধবিরতিতে সম্মতি দেন। মহাকবি নবীনচন্দ্র সেনের ‘পলাশী’ কাব্যগ্রন্থে এই যুদ্ধবিরতির বিবরণ দেওয়া হয়েছে। মীরজাফর সৈন্যদের বলছেন—
‘শোনো শোনো যোদ্ধৃগণ
নবাবের অনুমতি কাল হবে রণ।’
যুদ্ধক্লান্ত নবাবের সৈন্যরা যুদ্ধবিরতির খবর পেয়ে আনন্দিত মনে অনেক আমোদ-ফূর্তির পর শিবিরে ঘুমাতে গেছে। ঠিক এই সময় মীরজাফরের ইঙ্গিত পেয়ে ক্লাইভের সৈন্যরা ঘুমন্ত নবাবের সৈন্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। নবাবের অনুগত সেনাপতি মোহনলাল ও মীর মদন মুষ্টিমেয় সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ করে নিহত হন। বাকি জেগে উঠা সৈন্যরা মীরজাফরের হুকুমে আর যুদ্ধ করেনি। এভাবে ৫৬ হাজার সৈন্য থাকা সত্ত্বেও নবাব সিরাজ তথাকথিত পরাজয় বরণ করেন।
নবাবের এই অসতর্কতার দাম দিতে হয়েছে সারা বাংলাদেশকে দুই শ বছরের পরাধীনতার জোয়াল কাঁধে নিয়ে। বর্তমানেও একই অশনিসংকেত যেন দেখছি বাংলাদেশের আকাশে। এবার সরকার অসতর্ক নয় চক্রান্তকারীদের কার্যকলাপ সম্পর্কে। কিন্তু মুজিব বর্ষ পালনের মহাযজ্ঞের দিকে এখন তাদের সব দৃষ্টি নিবদ্ধ। এই সুযোগ নিতে চাচ্ছে ষড়যন্ত্রকারীরা।
দেশের রাজনীতিতে এখন একটা lull period বা নিষ্কর্মা সময় চলছে। বিরোধী শিবিরে কোনো তৎপরতাই নেই। বিএনপি-জামায়াত শিবিরে তো নেই-ই। গণতন্ত্রের সোল এজেন্ট ড. কামাল হোসেনের ভাঙা শিবিরেও নেই। আন্দোলন করার ক্ষমতা তাঁদের এখন নেই এ কথা সত্য। কিন্তু দু-একটি নন ইস্যুকে ইস্যু করে রাস্তায় দু-একটি ছোটখাটো মিছিল করে নিজেদের অস্তিত্বের জানানও তাঁরা দিচ্ছেন না। এর অর্থ কি সরকারকে দেখানো আমরা একেবারেই নিষ্ক্রিয়। তোমাদের যা খুশি করো অথবা পলাশীতে নবাবের সৈন্যদের মতো ঘুমাও।
বর্তমান সরকার যে ঘুমোচ্ছে তা নয়। কিন্তু তাদের সব কর্মতৎপরতা এখন মুজিব বর্ষ উদ্যাপনে কেন্দ্রীভূত। ঠিক এই সময়টাই বেছে নিয়েছে পরাজিত শত্রুপক্ষ। আমার বিশ্বাস, এই শত্রুপক্ষ তাদের অনুগত পুরনো ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটগুলোর সাহায্য নিয়ে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি এবং দাম বাড়িয়ে জন-অসন্তোষ তৈরি করে সরকারের পতন ঘটাতে চায়। স্বাভাবিক পথে অর্থাৎ নির্বাচনের মাধ্যমে এই সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটানো যাবে না বলেই এই সময়ে এই চক্রান্ত। বিএনপির বহুরূপী নেতা ব্যারিস্টার মওদুদের কানে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা একেবারে তাৎপর্যহীন কথা নয়।
১৯৭৪ সালে ঠিক এই পরিস্থিতি ঘটানো হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু যখন তাঁর প্রথম বিপ্লব স্বাধীনতার যুদ্ধে জয়ী হওয়ার পর তাঁর অর্থনৈতিক মুক্তির যুদ্ধ শুরু করতে যাচ্ছেন, পুরনো আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ভেঙে তাঁর গণমুখী শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করতে যাচ্ছেন, তখনই অসতর্ক নয় ও অপ্রস্তুত সরকারের ওপর আঘাত হানা হয়। বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযুদ্ধের অংশীদার দলগুলো তখন সম্পূর্ণ ব্যস্ত ছিল নতুন শাসনকাঠামো গড়ে তোলার কাজে। নতুন শাসনকাঠামো তখনো আঘাত সহ্য করার মতো শক্ত হয়নি। ঠিক এই সময় ঘটানো হয় ১৫ই আগস্টের নারকীয় হত্যাকাণ্ড।
এই চক্রান্তকারীরা জানত নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ মুজিবকে ক্ষমতা থেকে হটানো যাবে না। ১৯৭২ সালের সাধারণ নির্বাচনে এই শিক্ষা তারা লাভ করে। ফলে তারা ঢাকার পুরনো মোগলটুলী, মৌলভীবাজার, শ্যামবাজারের মুসলিম লীগপন্থী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটগুলোর সাহায্য গ্রহণ করে। এটা আমার কথা নয়, ১৯৭৫ সালের বাংলাদেশ-সংক্রান্ত মার্কিন দলিলপত্র থেকেই এসব বিবরণ এখন বেরিয়ে আসছে। এদের গোপন বৈঠক বসত কখনো আহসান মঞ্জিল ও নবাববাড়ির অন্য কোনো দালানে। কখনো গভীর রাতে আগামসি লেনে খন্দকার মোশতাকের বাসায়। এসব বৈঠকে মাঝেমধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বোস্টার সাহেবেরও আনাগোনা ছিল। সম্প্রতি মৃত্যুর আগে এসব কথা স্বীকার করে গেছেন বোস্টার।
চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ যে ছিল মেন মেইড ফেমিন—মানুষের সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ এবং মুজিব সরকারকে উচ্ছেদের লক্ষ্যে কৃত্রিম খাদ্য সংকট সৃষ্টি করে লক্ষাধিক মানুষকে অনাহারে মারা হয়—এ কথাটা মৃত্যুশয্যায় শুয়ে বোস্টার স্বীকার করে গেছেন মার্কিন সাংবাদিক লিকত্সুজের কাছে। সে সময়েও এই দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির সাহায্যকারী ছিল কিছু খাদ্য ব্যবসায়ী। বিদেশ থেকে আসা রিলিফদ্রব্য পর্যন্ত নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে অভাবী মানুষের হাতে না পৌঁছায়। কেন, ‘ম্যানসেরু মিয়ার’ তখনকার রহস্যকাহিনি আমরা কি এরই মধ্যেই ভুলে গেছি?
এবার ব্যারিস্টার মওদুদের মুখে চুয়াত্তরের পদধ্বনির কথা শুনেই আমার মনে হয়েছে, তাঁরা আবার একটি চুয়াত্তর ঘটানোর ষড়যন্ত্র আঁটছেন। এবার হয়তো বিদেশি সংযোগ এই ষড়যন্ত্রে নেই। কিন্তু ‘দেশের পুরনো ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটগুলো যে আছে তাতে আমার সন্দেহ নেই। পেঁয়াজ সংকট সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এই সংকট সৃষ্টির চক্রান্তকারী কারা, তিনি তার খোঁজ নেবেন। সত্যি যদি তিনি খোঁজ নেন, তাহলে দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিকভাবে কেন বেড়েছে, কারা চক্রান্ত করে বাড়িয়েছে, তার সন্ধান পাবেন।
পেঁয়াজ সমস্যায় অবশ্য সরকারের গাফিলতিও রয়েছে। আমরা ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির ওপর নির্ভরশীল। এবার ভারতেই পেঁয়াজ সংকট দেখা দেওয়ায় তারা বাংলাদেশসহ সর্বত্র পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। এ কথাটা সরকারের আগেই জানা ছিল। এ সম্পর্কে তাদের আগেই সতর্ক হয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত ছিল। তারা সম্ভবত সমস্যাটিকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেনি। যখন গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছে, তখন বহু দেরি হয়ে গেছে।
অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এর সুযোগ নিয়েছে। বাজারে পেঁয়াজের ঘাটতি দেখা দিতেই তারা তাদের পেঁয়াজের স্টক গুদামে লুকিয়ে ফেলেছে। না লুকিয়ে ফেললে পরে কয়েক টন পচা পেঁয়াজের সন্ধান মিলত না। পেঁয়াজের ঘাটতি দেখা দিতেই মওদুদ সাহেবদের পেঁয়াজ বিজনেস সিন্ডিকেটগুলো ইশারা পেয়ে অন্যান্য দ্রব্যেরও দাম বাড়াতে শুরু করে, এমনকি চাল-ডালেরও। এ সময় নতুন ধান বাজারে উঠার আগে দাম একটু বাড়েই। অসাধু ব্যবসায়ীরা শুধু ব্যাবসায়িক অতি লাভের জন্য নয়, অসাধু রাজনীতিকদের ইশারায়ও এ কাজটি করেছে। এ কথা বিশ্বাস করতাম না যদি লবণ নিয়েও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির জন্য বাজারে গুজব প্রচার করা না হতো। সরকার অবশ্য এই গুজব সময় থাকতে বন্ধ করতে পেরেছে।
বর্তমান সরকার একটানা ১১ বছর ক্ষমতায় থেকেও পুরনো ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটগুলো ভাঙতে পারেনি; বরং তোয়াজ করে দলে টানার চেষ্টা করেছে। তাতে কোনো লাভ হয়নি। এরা পুরনো অভ্যাসেরই দাসত্ব করছে এবং সুযোগ পেলেই সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রে সাহায্য জোগায়। ২০০৪ সালে আমি কলকাতায় গিয়েছিলাম। স্টেটসম্যানের সম্পাদক তখন ছিলেন মানস ঘোষ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় এসে তাঁকে তাড়িয়েছেন। সে কথা এখানে থাক। মানস ঘোষের কক্ষে বসে আছি। কলকাতার এক ব্যবসায়ী এলেন মানস বাবুর সঙ্গে দেখা করতে।
কী উদ্দেশ্যে তিনি এসেছিলেন তা জানি না। আমার সঙ্গে পরিচয় হতেই বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা উঠতেই তিনি বললেন, বাবু, হাসিনা সরকার যে ক্ষমতায় এসে ক্ষমতায় বেশি দিন থাকতে পারে না (তখন বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায়) তার কারণ কি জানেন? পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশে তাদের বড় ব্যবসায়ীদের এজেন্ট হিসেবে কিছু বাঙালি ব্যবসায়ী গ্রুপ তৈরি করে গেছে। এরা আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না, শেখ হাসিনাকে পছন্দ করে না। শেখ হাসিনা যদি এদের শিং ভেঙে না দেন, তাহলে ক্ষমতায় যেতে পারবেন না। ক্ষমতায় গেলেও থাকা মুশকিল হবে। আমরা তো এদের সঙ্গেই ব্যবসা-বাণিজ্য করি। তাই সব খবর রাখি।
কলকাতার ব্যবসায়ীর এ কথাগুলো আমার মনে ছিল। তাই ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে আসতেই ২০১০ সালে আমার এক কলামে লিখেছিলাম, মনে হয় হাসিনা সরকার বঙ্গবন্ধুর সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের (মিশ্র) অর্থনীতিতে আর ফিরে যেতে পারবে না। কারণ বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরাট বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। তবে হাসিনা সরকার যদি বাজার অর্থনীতির দাবি মেনে দেশ চালাতে চায়, তাহলে পুরনো কায়েমি স্বার্থের ভিত ভাঙার জন্য পুরনো ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটগুলো ভাঙতে হবে, নয়তো নতুন ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট তৈরি করে দুই গ্রুপের মধ্যে ব্যাবসায়িক প্রতিযোগিতা লাগিয়ে দিয়ে একটি সিন্ডিকেটের মনোপলি থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে। না হলে এরাই অর্থনীতির রাশ নিয়ন্ত্রণ করবে। তাদের স্বার্থের অনুকূলে বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ে খেলা করবে।
সরকার আমার সাবধানবাণীতে কান দেয়নি। তারা অশুভ রাজনৈতিক সিন্ডিকেট, ছাত্ররাজনীতিতে অশুভ সিন্ডিকেটগুলো ভাঙার বদলে পোষণ করেছে। তারই পরিণতি ক্যাসিনো কাণ্ড, বুয়েট হত্যা, পুরনো ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটও সরকার ভাঙেনি। নতুন সিন্ডিকেটও গড়ে তোলেনি, পুরনো সিন্ডিকেটগুলোই সরকারের এক শ্রেণির মন্ত্রী ও আমলাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ফুলেফেঁপে উঠে এতই প্রভাবশালী হয়েছে, এখন তারা শুধু অর্থনীতি নয়, রাজনীতিও নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। দেশে বিরোধী দলের কোনো কর্মকাণ্ড নেই দেখে সরকার উত্ফুল্ল হতে পারে; কিন্তু কিছু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বিরোধী দলের হয়ে সরকারের বিপদ ঘটানোর জন্য কিভাবে বাজার চক্রান্ত (Market conspiracy) শুরু করতে পারে তা সম্ভবত এখন বুঝতে পেরেছে।
সরকার এই চক্রান্ত সম্পর্কে অবহিত আছে এবং সতর্কও আছে তা জানি; কিন্তু চক্রান্ত ব্যর্থ করার প্রস্তুতি তাদের আছে কি?
লন্ডন, ২৪ নভেম্বর, রবিবার, ২০১৯
- আরও পড়ুন >> গান্ধীর দর্শন এবং শেখ মুজিবের রাজনীতি