চলতি বছরের জুন পর্যন্ত শিল্প খাতে ঋণ বিতরণ কমেছে ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এক বছরে কমার হার ৩৫ শতাংশ। তবে এ খাতে যে খেলাপি ঋণ আছে, তা কিছুটা কমেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকের শিল্প খাতের ঋণ বিতরণেও আঘাত হেনেছে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস। অর্থনীতির অন্য সূচকগুলোর মতোই শিল্পঋণ বিতরণ, আদায় এবং শ্রেণীকরণের অঙ্ক এখন নিম্নমুখী। বিশ্লেষকদের মতে, কয়েক বছর থেকে কমে আসছে বেসরকারি খাতের ঋণ বিতরণ। নতুন করে বিনিয়োগ করতে চাচ্ছেন না কেউ। তবে করোনা ভাইরাসের কারণে এর পরিমাণ তলানিতে ঠেকেছে। শিল্প খাতে ঋণ বিতরণ কমে যাওয়া এরই একটি প্রভাব।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মত ও পথকে বলেন, স্বল্প মেয়াদে আমানত নিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ দেয়া ঝুঁকি। এছাড়া খারাপ গ্রাহকের কারণে ভালো গ্রাহকরা বঞ্চিত হচ্ছেন। কারণ একটা শ্রেণি আছে, যারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা আর ফেরত দিচ্ছে না। হচ্ছে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। তাদের কারণে ব্যাংকাররা এখন ঋণ দেয়ার আগে অনেক সতর্কতা অবলম্বন করছেন। ফলে ঋণ দেয়া কমে যাচ্ছে। এর বাইরে বিনিয়োগের পরিবেশও কাঙ্খিত পর্যায়ে নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত মোট ৭৪ হাজার ২৫৭ কোটি টাকার শিল্পঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৫ দশমিক ২৫ শতাংশ কম। গত বছরের (২০১৯) একই সময়ে এই খাতের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে শিল্প খাতে ঋণ বিতরণ কমেছে ৪০ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা। তবে চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিকে ৯১ হাজার ৬৬২ কোটি টাকার শিল্পঋণ বিতরণ করে ব্যাংকগুলো। সেই তুলনায়ও তিন মাসের ব্যবধানে জুন শেষে ১৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ শিল্পঋণ বিতরণ কমেছে ব্যাংকিং খাতের।
অন্যদিকে আগে বিতরণ করা শিল্পঋণ আদায়ের পরিমাণ কমেছে ৩০ শতাংশ। বছরের ব্যবধানে ৯১ হাজার ৯১৩ কোটি থেকে ৬৪ হাজার ১৩৫ কোটিতে নেমেছে আদায়। তবে মার্চ প্রান্তিকের তুলনায় জুনে আদায় কমেছে প্রায় ১৮ ভাগ। এ প্রসঙ্গে সাউথইস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম কামাল হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, করোনার কারণে শিল্পঋণ ৪০ হাজার কোটি টাকা কমেছে। অনেকে দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন, এখন এলসি খুলবে কি খুলবে না; ব্যবসা-বাণিজ্য কোনদিকে যাবে- এসব কারণে ঋণ কমে গেছে।
আলোচ্য সময়ে ব্যাংকের শিল্প খাতে বিতরণ করা ঋণের খেলাপিও কমেছে প্রায় ২১ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে ৫৭ হাজার ২০১ কোটি থেকে ৪৫ হাজার ৩২৮ কোটিতে নেমেছে খেলাপি ঋণ। তবে মার্চের তুলনায় খুব একটা কমেনি খেলাপি। তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি কমেছে মাত্র ৫০৪ কোটি টাকা, যা আগের তিন মাসের তুলনায় ১ দশমিক ১০ ভাগ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, করোনার প্রভাব থেকে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করতে প্যাকেজের ঋণগুলো দ্রুত বিতরণ করতে হবে। শিল্প খাতসহ সংশ্লিষ্ট সব অর্থনৈতিক খাতকে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু ঋণ বিতরণ বাড়ানো যাচ্ছে না। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একের পর এক শর্ত শিথিল করে যাচ্ছে।
১২ এপ্রিল জারি করা সার্কুলারে বলা হয়েছিল, প্যাকেজের মেয়াদ হবে তিন বছর। কিন্তু তা সুনির্দিষ্ট করা ছিল না। পরবর্তী সময়ে অন্য একটি সার্কুলারের মাধ্যমে এর মেয়াদ নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। চলতি বছরের ৪ আগস্ট থেকে ২০২৩ সালের ৩ আগস্ট পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যেই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আলোচ্য প্যাকেজের আওতায় বিতরণ করা ঋণের বিপরীতে পুনঃঅর্থায়ন সুবিধা নিতে হবে এবং তা পরিশোধ করতে হবে।
জানা গেছে, করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বড় শিল্প ও সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে কম সুদ ও সহজ শর্তে চলতি মূলধনের জোগান দিতে ১২ এপ্রিল ৩০ হাজার কোটি টাকার একটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর আওতায় সংশ্লিষ্ট খাতের উদ্যোক্তাদের সাড়ে ৪ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়ার কথা বলা হয়।
এ ঋণের মোট সুদের হার হবে ৯ শতাংশ। বাকি সাড়ে ৪ শতাংশ ভর্তুকি হিসেবে দেবে সরকার। এ প্যাকেজের আওতায় ঋণ দিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তহবিলের জোগান দিতে ২৩ এপ্রিল ১৫ হাজার কোটি টাকার একটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ তহবিল থেকে প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঋণ দিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ৫০ শতাংশ অর্থের জোগান দেয়া হবে। অর্থাৎ কোনো গ্রাহককে ১০০ কোটি টাকা ঋণ দিলে এর মধ্যে ৫০ কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক জোগান দেবে এবং বাকি ৫০ কোটি টাকা দেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদ নেবে ৪ শতাংশ। কিন্তু এ ঋণ বিতরণে তেমন কোনো গতি নেই।