বিশ্ব ঐতিহ্যের মঙ্গল শোভাযাত্রা

সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন

বিশ্ব ঐতিহ্যের মঙ্গল শোভাযাত্রা
বিশ্ব ঐতিহ্যের মঙ্গল শোভাযাত্রা। ফাইল ছবি

মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রতি বছর বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে আয়োজিত একটি তুলনামূলকভাবে নতুন বর্ষবরণ উৎসব। ১৯৮০’র দশকে স্বৈরাচারী শাসনের বিরূদ্ধে সাধারণ মানুষের ঐক্য এবং একইসঙ্গে শান্তির বিজয় ও অপশক্তির অবসান কামনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ সালে সর্বপ্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রবর্তন হয়। ঐ বছরই ঢাকাবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় এই আনন্দ শোভাযাত্রা। সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক-শিক্ষার্থীগণ পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে এই আনন্দ শোভাযাত্রা বের করার উদ্যোগ প্রতি বছর অব্যাহত রাখে। একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এটি একটি ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব হিসাবে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে প্রতিবছরই পহেলা বৈশাখে ঢাকা শহরের শাহবাগ-রমনা এলকায় এই মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। এই শোভাযাত্রায় চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক শিক্ষার্থী ছাড়াও বিভিন্ন স্তরের ও বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করে। শোভাযাত্রায় বিভিন্ন ধরনের প্রতীকী শিল্পকর্ম বহন করা হয়। এছাড়াও বাংলা সংস্কৃতির পরিচয়বাহী নানা প্রতীকী উপকরণ, বিভিন্ন রঙ-এর মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি নিয়ে হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হয়। বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আবেদনক্রমে ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেস্কোর মানবতার অধরা বা অস্পর্শনীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান লাভ করে।

universel cardiac hospital

শোভাযাত্রার অনতম আকর্ষণ হলো বিশালকায় চারুকর্ম পুতুল, হাতি, কুমীর, লক্ষ্মীপেঁচা, ঘোড়াসহ বিচিত্র মুখোশ এবং সাজসজ্জা, বাদ্যযন্ত্র ও নৃত্য। পহেলা বৈশাখ উদযাপন উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রা শুরু থেকেই জনপ্রিয়তা পেয়ে আসছে। পরের বছরও চারুকলার সামনে থেকে আনন্দ শোভাযাত্রা বের হয়। তবে সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী জানা যায়, ঐ বছর চারুশিল্পী সংসদ নববর্ষের সকালে চারুকলা ইন্সটিটিউট থেকে বর্ণাঢ্য আনন্দ মিছিল বের করে। শুরু থেকেই চারুকলার শোভাযাত্রাটির নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা ছিল না। জানা যায়, পূর্বে এর নাম ছিল বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা। সেই সময়ের সংবাদপত্রের খবর থেকেও এমনটা নিশ্চিত হওয়া যায়। সংবাদপত্র থেকে যতোটা ধারণা পাওয়া যায়, ১৯৯৬ সাল থেকে চারুকলার এই আনন্দ শোভাযাত্রা মঙ্গল শোভাযাত্রা হিসেবে নাম লাভ করে। তবে বর্ষবরণ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রা চারুকলায় ১৯৮৯ সালে শুরু হলেও এর ইতিহাস আরো কয়েক বছরের পুরানো।

১৯৮৬ সালে চারুপীঠ নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যশোরে প্রথমবারের মতো নববর্ষ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করে। যশোরের সেই শোভাযাত্রায় ছিলÑ পাপেট, বাঘের প্রতিকৃতি, পুরানো বাদ্যযন্ত্রসহ আরো অনেক শিল্পকর্ম। শুরুর বছরেই যশোরে শোভাযাত্রা আলোড়ন তৈরি করে। পরবর্তীকালে যশোরের সেই শোভাযাত্রার আদলেই ঢাকার চারুকলা থেকে শুরু হয় বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা।


ইউনেস্কোর অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্তি

জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেস্কো বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আবেদনক্রমে ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’-কে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। এই অন্তর্ভুক্তির ফলে বিশেষ সাংস্কৃতিক উপাদানটি বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতিই শুধু লাভ করে না, অন্যান্য দেশের মানুষকেও এ ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলে। প্রসঙ্গত, ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবায় অনুষ্ঠিত ২৮ নভেম্বর থেকে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর সংশিষ্ট আন্তজাতিক পর্ষদ (INTERGOVERNMENTAL COMMITTEE FOR THE SAFEGUARDING OF THE INTANGIBLE CULTURAL HERITAGE) বাংলাদেশ সরকারের প্রস্তাবটি অনুমোদন করে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের প্রস্তাবটি Nomination file no. 01091 হিসেবে চিহ্নিত ছিল। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষে বাংলা একাডেমি এই প্রস্তাবনাটি প্রণয়ন করে। পরবর্তীকালে ইউনেস্কোর চাহিদা অনুযায়ী এই প্রস্তাবনাকে গ্রহণযোগ্যরূপে পুনঃপ্রণয়ন করা হয়। ২০১৫ সালের ১ জুন প্যারিসে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম. শহিদুল ইসলাম এই পুনঃপ্রণীত প্রস্তাবনাটি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে পুনরায় ইউনেস্কোর নিকট দাখিল করেন।

সাম্প্রতিককালে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। অমঙ্গলের বিপরীতে মঙ্গল, অশুভর বিরুদ্ধে শুভ, অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর প্রত্যাশা থেকেই মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রচলন। ইউনেসকোকে ধন্যবাদ জানাই, বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান মঙ্গল শোভাযাত্রাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদানের জন্য। একই সঙ্গে অভিনন্দন জানাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক-ছাত্রসহ সর্বস্তরের সংস্কৃতিকর্মী এবং সাধারণ মানুষকে, যারা সব ভয়ভীতি উপেক্ষা করে পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন ও মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ঐতিহ্যে পরিণত করায় সাহসী ভূমিকা রেখেছেন। জয় হোক সংস্কৃতির। জয় হোক মানুষের।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে