রবীন্দ্রনাথ: নাটক ও নাট্যাভিনয় প্রসঙ্গ

বীরেন মুখার্জী

সৃষ্টিপ্রাচুর্যের মধ্যেই প্রতিফলিত রয়েছে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সৃজনকৌশল এবং ব্যক্তিজীবনের নানামাত্রিক ঘোর। রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রবীন্দ্রসাহিত্যে অন্তর্নিহিত রহস্যময় আলোকরশ্মি তার সৃষ্টির গভীরতা নির্দেশক। এ জন্য রবীন্দ্রসাহিত্য পাঠে পাঠকসমাজ যেমন অমেয় রসের সন্ধান পান; তেমনি গবেষকরা খুঁজে পান নতুনতর মৌলতথ্য। স্রষ্টা হিসেবে তিনি জীবন ও পরিবেশশ্লিষ্ট যেসব বিষয়াদি সাহিত্যের উপকরণ হিসেবে তুলে ধরেছেন তা কালক্রমে দৃষ্টান্ত হিসেবে গৃহীত হয়েছে।

ফলে রবীন্দ্রমনীষা অন্বেষণে তার সাহিত্যভাণ্ডারে ডুব দিয়ে মণিমুক্তা আহরণের চেষ্টা করেন বোদ্ধারা। সত্য যে, অধ্যাত্মপ্রেম ও তীক্ষ্ম জীবনবোধে জারিত রবীন্দ্রমানস গঠিত হয় পারিবারিক সাহিত্য পরিমণ্ডলে। সাহিত্য-রাজনীতি-ধর্ম-দর্শন এসব নানাবিধ প্রপঞ্চ পারিবারিকভাবেই সঞ্চয়ন ঘটে রবীন্দ্রমননে। সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতো নাটক রচনায়ও রবীন্দ্রনাথ পারঙ্গমতার পরিচয় দেন। নিজের রচিত নাটকে অভিনয় করে অসাধারণ কৃতিত্বের দাবিদারও তিনি। অভিনয় শিল্প সম্পর্কে তার অভিনিবেশ, চর্চা ও অনুশীলন প্রকারান্তরে তার সৃষ্টিকেই সমৃদ্ধ করেছিল। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের অনেক সদস্য অভিনয়ের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। মূলত পারিবারিক নাট্য ঐতিহ্য রবীন্দ্রনাথকে নাট্যাভিনয়ে উৎসাহ জোগায়। 

রবীন্দ্রনাথের সময়পর্বে বাঙলার নাটকের ইতিহাস মাত্র তিরিশ বছরের। তৎকালীন নাটকের ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, ১৭৯৫ সালে গেরাসিম লেবেদেভ নামে জনৈক রুশ দেশীয় আগন্তুক কোলকাতায় ‘বেঙ্গল থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই রঙ্গমঞ্চে ‘The Disguise’, ‘Love is the best Doctor’ সর্বপ্রথম অভিনীত হয়। বাঙলায় অনূদিত এ দুটি নাটকের মাধ্যমে লেভেদেভের নাম বাঙলায় ছড়িয়ে পড়ে। এরপর প্রসন্ন কুমার ঠাকুরের আগ্রহে ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘হিন্দু থিয়েটার’। প্রকৃতপে ১৮৩৫ সালে নবীনচন্দ্র সেনের বাড়িতে ‘বিদ্যাসুন্দর’-এর অভিনয়ের পর থেকে বাঙলা নাটকের সূচনা বলে মনে করেন অনেকে।

তবে বাঙলা নাটকের উন্মেষপর্বে যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, কালিপ্রসন্ন সিংহ, রামনারায়ণ তর্করত্ন, তারাচরণ শিকদার, হরিশচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ নাট্যকারের অবদান অনস্বীকার্য। আবার বাঙলা নাটকের বিকাশপর্বে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও দীনবন্ধু মিত্রের নামও স্মরণীয়। মাইকেল মধুসূদন দত্ত পাশ্চাত্য আদলে নাটক রচনা করেন। বাঙলা নাটকের পরিণতিপর্বে ন্যাশনাল থিয়েটার স্থাপন ও গিরিশ চন্দ্র ঘোষের বাঙলা নাট্যমঞ্চে আবির্ভাব সমসাময়িক ঘটনা হলেও গিরিশ চন্দ্র ঘোষকে প্রথমদিকে মধুসূদন ও দীনবন্ধু মিত্রের নাটকে অভিনয় করতে হয়। এ সময় সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কিছু উপন্যাসের নাট্যরূপ দেয়া হয়। বাঙলা নাটকের পরিণতি পর্বে পেশাদার নাট্যগোষ্ঠীর আবির্ভাবেও সৌখিন নাট্যচর্চা থেমে থাকেনি বরং পেশাদার নাট্যগোষ্ঠী তৎকালীন মধ্যবিত্ত শিক্ষিত চিত্তের দাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়। ফলে ঠাকুরবাড়ির শখের থিয়েটার চর্চা যেমন বন্ধ হয়নি তেমনি, ঠাকুর পরিবারের থিয়েটার-চাহিদা ও অভিনয়ে প্রশংসারও ঘাটতি পড়েনি।

তৎকালীন বিভিন্ন পেশাদার নাট্য সংগঠনের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত যুবকদের সান্ধ্যবিনোদনের কেন্দ্র হিসেবে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে ১২৯৯ বঙ্গাব্দে ‘সঙ্গীত সমাজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। সঙ্গীত সমাজের উদ্যোগে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নাটক অভিনীত হলেও রবীন্দ্রনাথ সংগঠনটির সঙ্গে জন্মলগ্ন থেকে জড়িত ছিলেন। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘এই সময়ের অভিনীত নাটকের অধিকাংশ নায়ক-নায়িকার উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি, অঙ্গভঙ্গি ভালো ছিল না। এসব দেখার দায়িত্ব রবীন্দ্রনাথের ওপর বর্তেছিল।’ কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, গীতিকবিতা ইত্যাদি রচনার ভেতর দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন সময়ে অসংখ্য নাটক রচনা করেন। নাটক যতরকম হতে পারে, রবীন্দ্রনাথ তার সবগুলো নিয়েই নিরীক্ষা করেছেন। গীতিনাট্য, কাব্যনাট্য, গীতিকাব্য, হেঁয়ালি নাট্য, একক নাট্য, নাটিকা, গদ্য-নাটক, প্রহসন ছিল রবীন্দ্র নিরীক্ষার বিষয়।

রবীন্দ্রনাথ কেন নাটক রচনায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন- প্রশ্নটির উত্তর পাওয়া গেলে রবীন্দ্রনাথের যুগরুচি ও আধুনিকতা নিয়ে তার অবস্থান নির্ণয় সম্ভব। নাটকের মাধ্যমে তিনি তৎকালীন সমাজব্যবস্থার বাস্তবতা যেমন তুলে ধরেছেন তেমনি পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রবেশ ঘটিয়েছেন বাঙলা সাহিত্যে। নাটকগুলিতে কৌতুক ও সঙ্কেতের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় বার্তা পৌঁছে দিতে সচেষ্ট থেকেছেন। ঐতিহাসিক, পৌরাণিক উপাদান-উপকরণ প্রয়োগ এবং সাঙ্গীতিক বাণীভঙ্গির আশ্রয়ে তত্ত্ব প্রচার করেছেন। নাটকের মধ্যে জীবনাচার ও নানামুখী সামাজিক বৈষম্য ও এসবের ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন। 


‘রবীন্দ্র নাট্যসাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ অংশ হচ্ছে রূপক নাট্য বা সাঙ্কেতিক নাট্যের বিভাগটি। এসব নাটকের ভাষা যেমন শাণিত তেমনি যুগজীবনের নানা জটিল জিজ্ঞাসাও মাথা তুলে দাঁড়ায় প্রতিটি চরিত্রের সংলাপের মধ্য দিয়ে। রবীন্দ্রনাট্যের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হলো সঙ্গীতাত্মক বাণীভঙ্গির আশ্রয়ে ‘কাব্য ও তত্ত্বে’র মিলিত রূপ।’

‘রাজা ও রাণী’ রবীন্দ্রনাথের একটি বিখ্যাত নাটক। এ নাটকের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেন, ‘সুমিত্রা ও বিক্রমের মধ্যে একটি বিরোধভাব আছে- সুমিত্রার মৃত্যুতে সেই বিরোধের সমাধান হয়। বিক্রমের যে প্রচণ্ড আসক্তি পূর্ণভাবে সুমিত্রাকে গ্রহণ করবার অন্তরায় ছিল, সুমিত্রার মৃত্যুতে সেই আসক্তির অবসান হওয়াতে সেই শান্তির মধ্যের সুমিত্রার সত্য উপলব্ধি বিক্রমের পক্ষে সম্ভব হলো’। এ নাটকে রবীন্দ্রনাথ মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণে সচেষ্ট থেকেছেন এমনটি মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। রবীন্দ্রনাথের নাটকে মানব-মানবীর প্রবল প্রণয়াকাক্ষা যেমন দুর্লঙ্ঘ নয়, তেমনি বিষয় বৈচিত্র্যের উপস্থিতিও তীব্রভাবে লক্ষ্য করা যায়। রবীন্দ্রনাথের থিয়েটার বা নাট্যচর্চাকে তিনপর্বে বিভক্ত করলে, প্রথম পর্ব (১৮৮১ সাল থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত) কোলকাতা পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব (১৯০২ সাল থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত) শান্তিনিকেতন পর্ব এবং এর পরবর্তী ২৫ বছরের নাট্যচর্চাকে মিশ্রপর্ব হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

নাট্য বিশেষজ্ঞ নন্দগোপাল সেনগুপ্ত ‘রবীন্দ্র সংস্কৃতি’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘যারা পৃথিবীতে শুধু নাট্যকাররূপেই প্রসিদ্ধ, যেমন শেকসপীয়র, মলেয়ার, ইবসেন শ্য রচনার বৈচিত্র্যে ও পরিমাণে তাঁরাও কেউ রবীন্দ্রনাথের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে না।’ তিনি রবীন্দ্রনাথের নাট্য সাহিত্যকে পাঁচপর্বে বিভক্ত করেন। এগুলো হচ্ছে, গীতিনাট্য, কাব্যনাট্য, কৌতুক নাট্য, সাঙ্কেতিক নাটক ও নৃত্য নাট্য। রবীন্দ্র নাট্যসাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ অংশ হচ্ছে রূপক নাট্য বা সাঙ্কেতিক নাট্যের বিভাগটি। এসব নাটকের ভাষা যেমন শাণিত তেমনি যুগজীবনের নানা জটিল জিজ্ঞাসাও মাথা তুলে দাঁড়ায় প্রতিটি চরিত্রের সংলাপের মধ্য দিয়ে। রবীন্দ্রনাট্যের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হলো সঙ্গীতাত্মক বাণীভঙ্গির আশ্রয়ে ‘কাব্য ও তত্ত্বে’র মিলিত রূপ। রবীন্দ্রনাথ জীবনের প্রথমদিকে রচনা করেন ‘রুদ্রচণ্ড’ নাটকটি। ক্ষুদ্র এ নাট্যকাব্য অমিত্রাক্ষর ছন্দে লিখেছেন তিনি। নাটকটি সম্পর্কে রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের কথা স্মরণযোগ্য। তিনি ‘রবীন্দ্র জীবনী’ ১ম খণ্ডে উল্লেখ করেছেন, “আমাদের মনে হয় রবীন্দ্রনাথ বাল্যকালে বোলপুরে আসিয়া ‘পৃথ্বীরাজ পরাজয়’ নামে যে কাব্য রচনা করেন এই রুদ্রচণ্ড তাহারই নাটকীয় রূপান্তর।” রবীন্দ্রনাথ ‘আপনি আচরি ধর্ম জীবেরে শিখাও’ নীতিতে বিশ্বাস করতেন, এজন্য তার সৃষ্টি ও ব্যক্তি চরিত্র ছিল পরিপূরক। তিনি যেমন বাহ্যজগত সম্পর্কে নিজে সজাগ থাকতেন তেমনি রচনার মধ্য দিয়েও এ সত্য প্রতিষ্ঠা করতেন। বিশ্বস্রষ্টার রহস্যময় অপূর্ব কীর্তি প্রকৃতির সান্নিধ্যে একাত্ম হয়ে ‘বাউল’ মননের খোঁজ করতেন। ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ নাটকটিতে তিনি ‘বাউল দর্শন’ তুলে ধরেছেন। রবীন্দ্রনাথের বাউল চরিত্রের বিশেষত্ব এই যে, এ চরিত্রটি মনের মধ্যে মনের মানুষ খুঁজে বেড়ায় না, বরং তার পরিবর্তে পার্থিব জীবনের মানবিক সম্পর্কের প্রত্যক্ষ বন্ধনের ভেতর দিয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সন্ধান করে।

রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য নাটকের আদলে বাঙলা নাটকের পূর্ণাঙ্গ রূপ দেন। তিনি বালকদের অভিনয়ের চিন্তা মাথায় রেখে রচনা করেন হেঁয়ালিনাট্য। এসব নাটকের মধ্য দিয়ে ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ ও শ্লেষ প্রচণ্ডভাবে প্রকাশিত হয়। আবার নারী উন্নয়নের চিন্তা করে রচনা করেন ‘মায়ার খেলা’ নাটকটি। তৎকালীন সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারীরা এ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন। নাটকটি সম্পর্কে ইন্দিরা দেবী উল্লেখ করেন- ‘মায়ার খেলার অভিনয় তখনকার দিনে নিশ্চয় বেশ একটি স্মরণীয় ঘটনা, সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়েরা বোধ হয় এই প্রথম সংঘবদ্ধভাবে অভিনয়ে নামেন।’ তৎকালীন সময়ে এ নাটকটি নারীদের একটি সামাজিক বিপ্লব হিসেবে চিহ্নিত। ‘রাজা ও রানী’ এবং ‘বিসর্জন’ রবীন্দ্রনাথের উল্লেখযোগ্য নাটকের দুটি। ‘রাজা ও রানী’ হৃদয়াবেগ থেকে উত্থিত কল্পনা, বিষয়বস্তু ও ঘটনাবৈচিত্র্যে সমুজ্জ্বল। অপরদিকে ‘বিসর্জন’ নাটকটি ধর্মের অর্থহীন নিষ্ঠুর সংস্কার ও আচারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ। এ দুটি নাটক প্রত্যক্ষভাবে ইংরেজি নাটকের প্রভাবে রচিত। রচনারীতি, প্রকরণ ও সংলাপে যেমন শেকসপীয়রের অমিত্রাক্ষর ছন্দের বুনন রয়েছে তেমনি নাটকের ভাববিচারেও শেকসপীয়রের বিখ্যাত নাটক ‘ম্যাকবেথ’-এর রয়েছে সাদৃশ্য।

পরিণত বয়সে রচিত অধিকাংশ নাটকের আখ্যানভাগ রচনায় রবীন্দ্রনাথ মহাভারত থেকে উপাদান সংগ্রহ করতেন। এক্ষেত্রে পৌরাণিক কাহিনির মর্যাদা ধরে রেখেই নিজের রচনা সমৃদ্ধ করতেন। মহাভারতের অর্জুনের কাহিনি নিয়ে রচিত ‘চিত্রাঙ্গদা’ কাব্যনাট্যের মূল সুর  মিলন-ব্যাকুলতা।  

প্রহসনমূলক নাটক রচনায় রবীন্দ্রনাথের রয়েছে প্রভূত খ্যাতি। বিশুদ্ধ হাস্যরস সৃষ্টির উদ্দেশেই তিনি রচনা করেন ‘চিরকুমার সভা’ নাটকটি। তিনি নিজে যেমন কথায় কথায় মানুষের মনে রস সঞ্চার করতেন তেমনি সৃষ্টি দিয়েও মানুষকে উজ্জীবিত করতেন। রূপকথার আশ্রয়ে তিনি ‘তাসের ঘর’ নাটক রচনা করেন।  ‘মালিনী’ নাটকটি বৌদ্ধ সাহিত্যের উপাদান নিয়ে রচনা করেন। এছাড়া ‘নটীর পূজা’, ‘রাজা’, ‘চণ্ডালিকা’, ‘অরূপরতন’, ‘শাপমোচন’ নাটকও বৌদ্ধ সাহিত্য ও সমাজ-পরিবেশনির্ভর। 

ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধায় ‘সেকালের কথা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন- রবীন্দ্রনাথের ছয় বছর বয়সে জোড়াসাঁকোর নাট্যশালা বন্ধ হয়ে যায়। আর দ্বিতীয় পর্বের সূচনা হয় রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে। ঠাকুরবাড়ির দ্বিতীয়পর্বের শুরুতে ‘বিদ্বজন সমাগম সভা’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয় ১২৮১ বঙ্গাব্দের ৬ বৈশাখ। সংগঠনটি আত্মপ্রকাশের পর থেকে সারাবছর কোনও না কোনও অনুষ্ঠানের আয়োজন করত। সংগঠনটির বার্ষিক অনুষ্ঠানে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘পুরুবিক্রম’ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন রবীন্দ্রনাথ। মাত্র তের বছর বয়সে এই নাটকে অভিনয় করে উপস্থিতিদের তাক লাগিয়ে দেন তিনি।

আবার অনেকে মনে করেন ‘সঙ্গীত সমাজ’ এর উদ্যোগে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রহসনমূলক ‘এমন কর্ম আর করব না’ নাটকে অলীকবাবুর ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ প্রথম অভিনয় করেন। ‘অলীকবাবু’ চরিত্রটি ফরাসি নাটক থেকে নিয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। কিন্তু অভিনয়ের পূর্বে রবীন্দ্রনাথ এই চরিত্রটিকে অনেক অদলবদল করে ফরাসি গন্ধ দূর করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনের বন্ধু প্রিয়নাথ সেনের মন্তব্য তুলে ধরেছেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়- ‘এমন সুন্দর অভিনয় কখনও দেখি নাই। … যাঁহারা রবিবাবুর অভিনয় দেখিয়াছেন- তাহারা জানেন যে কবিবর শুধু আধুনিক বঙ্গ সাহিত্যের শিরোমণিই নহেন, নট চূড়ামণিও বটে।’ প্রিয়নাথ সেনের এ মন্তব্যে রবীন্দ্রনাথের অভিনয় প্রতিভা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। কৈশোরে দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে নিজের নাট্যভাবনা ও অভিনয় প্রতিভার দ্যুতি ছড়িয়েছিলেন তিনি। মূলত জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের উৎসাহ রবীন্দ্রনাথের নাট্যজীবনে ব্যতিক্রম ধারার সূচনা করে। ‘মানময়ী’ নাটকে রবীন্দ্রনাথ ‘মদন’ চরিত্রে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ‘ইন্দ্র’ এবং কাদম্বিরী দেবী ‘উর্বশী’ চরিত্রে অভিনয় করেন। এ নাটকটি বাঙলা নাট্যসাহিত্যে গীতিনাট্যের প্রথম প্রয়াস হিসেবে স্বীকৃত। ‘বিদ্বজন সমাগম সভা’র রবীন্দ্রনাথ নিজের লেখা ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ নাটকের বাল্মীকি চরিত্রে অভিনয় করেন। রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্রী প্রতিভাদেবীও এ নাটকে সরস্বতীর ভূমিকায় অভিনয় করেন। ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের অভিষেক ঘটে পরিবারের বাইরে সাধারণ দর্শকদের সামনে। ব্যাপকভাবে দর্শকনন্দিত হন রবীন্দ্রনাথ।

‘বাল্মীকি প্রতিভা’র অভিনয় সাফল্যের পর তিনি ‘কালমৃগয়া’ নামে একটি গীতিনাট্য রচনা করেন। ঠাকুরবাড়ির তিন তলার ছাদে এই নাটকটি প্রদর্শনের আয়োজন করা হয়। কোলকাতার বহু সম্ভ্রান্ত ও গণ্যমান্য ব্যক্তির সামনে প্রদর্শিত এই নাটকে রবীন্দ্রনাথ ‘অন্ধমুনি’ চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের তাক লাগিয়ে দেন। পরবর্তীতে তিনি শান্তিনিকেতনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় পারিবারিকভাবে অভিনীত নাটকে অভিনয় ছেড়ে দেন। 

অভিনয় দক্ষতায় নাটকের চরিত্রের বলিষ্ঠতা যথাযথভাবে প্রমাণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। বাণীভঙ্গি, সাজ ও চরিত্রের অন্তর্নিহিত বক্তব্যটি যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলতেন বলেই তার অভিনীত নাটক তৎকালীন সময়ে খুব জনপ্রিয় ছিল। অভিনয়ের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ নাটকের নির্দেশনা থেকে শুরু করে, প্রয়োজনা, গান গাওয়া ইত্যাদি বহুবিধ ভূমিকা পালন করতেন। ‘সঙ্গীত সমাজ’ আয়োজিত বিভিন্ন নাটকে এই নেপথ্যের কাজটি তিনি করতেন দক্ষভাবে। ১৩০৩ বঙ্গাব্দে ‘সঙ্গীত সমাজ’ আয়োজিত ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ নাটকে রবীন্দ্রনাথ কেদারের ভূমিকায় অভিনয় করেন। এই নাটকে নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ অভিনয় করেছিলেন। কেদারের সাজপাট ও ঢিলেঢালা মেকআপে রবীন্দ্রনাথ এমন কপট বিনয়ের অবতারণা করেছিলেন, এতে চরিত্রের মূলভাবটি অনায়াসে দর্শকরা বুঝতে পেরেছিলেন।

এছাড়া শান্তিনিকেতনে অভিনীত প্রহসন নাটক ‘বিনে পয়সার ভোজ’ এ যাদুকরী অভিনয় দিয়ে দর্শকদের অভিভূত করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মূল উদ্দেশ্য ছিল অভিনয়ের মাধ্যমে বাঙলা নাটকের উন্নয়ন। একই সঙ্গে নাটকের সঙ্গে সাহিত্যের সব শাখার সমন্বয় সাধন। তিনি যেমন ঠাকুরবাড়ির অগ্রজদের নাটকে অভিনয় করতেন তেমনিভাবে নিজের রচিত নাটকেও অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকদের রসসিক্ত করতেন। রবীন্দ্রনাথের ৬৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে নৃত্যনাট্য ‘নটীর পূজা’ অভিনীত হয় শান্তিনিকেতনে। এ নাটকে ‘ভূপালি’ চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। এ নাটকের দর্শক হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯২২ সালে কোলকাতার আলফ্রেড ও ম্যাডান রঙ্গমঞ্চে ‘শারদোৎসব’ নাটকে সন্ন্যাসীর ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথের অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেন- “শারদোৎসব এর অভিনয়াঙ্কিকের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের ভবিষ্যৎ নাটকসমূহের অভিনয় বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পাইয়াছিল। রবীন্দ্রনাথের নাট্যাভিনয় ক্ষেত্রে পরবর্তীকালে যে যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধিত হইয়াছিল, ‘শারদোৎসব’ অভিনয়ের মধ্য দিয়াই তাহার প্রথম সূচনা দেখা দিয়াছিল।” 

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ‘রবীন্দ্র জীবনী’ গ্রন্থে উলে­খ করেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ তাঁহার বাল্যকালে নাটক ও অভিনয়ের যে দৃষ্টান্ত ও আদর্শ সৃষ্টবোধের অগোচরে উপলব্ধি করিয়াছিলেন, তাহা বাংলাদেশের যাত্রাগান, কৃষ্ণলীলা, নিমাই সন্ন্যাস নহে, তাহা সম্পূর্ণ ইউরোপের আদর্শে গড়া থিয়েটারের অনুকরণে রচিত নাটকের অভিনয়। এই সব অভিনয়ের ক্ষীণ স্মৃতিকণিকাগুলি বালকের অবচেতনে মনের স্তরে সঞ্চিত ছিল এবং উত্তরকালে তাহাই পূর্ণাঙ্গ আর্টরূপে কবির জীবনে প্রকাশ পায়।’ শেষ জীবনে এসে তিনি নৃত্যনাট্যের ওপর জোর দিয়েছিলেন। নৃত্যকলার মাধ্যমে উচ্চাঙ্গ অভিনয় দক্ষতা অর্জনে তিনি দেহের প্রতিটি অঙ্গকে কীভাবে অভিনয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যায় সেদিকে মনোনিবেশ করেছিলেন। যে কারণে রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য আজো দর্শক শ্রোতার মননে গভীর রেখাপাত করে। এ প্রসঙ্গে নৃত্যশিল্পী শান্তিদেবী ঘোষ বলেছিলেন- ‘নাটকের বিভিন্ন চরিত্রের অভিনয় একা তিনি শিখিয়েছেন পাখী পড়ানোর মতো করে। প্রত্যেকটি কথার সঙ্গে কোথায় কিভাবে ঝোঁক দিতে হবে, কিভাবে স্বরের বৈচিত্র্য আসবে, সবই তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খুরূপে দেখিয়েছেন।’ 

বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ নাটক রচনায় ক্ষেত্রে যেমন বহুতত্ত্বের সমন্বয় ঘটিয়েছেন তেমনি অভিনয়েও নতুনত্ব ও আধুনিকতার বিস্তার ঘটিয়েছেন। আবার নির্দেশক হিসেবে সাজসজ্জা, আলোক প্রক্ষেপণ থেকে শুরু করে মঞ্চনির্মাণ, সঙ্গীতায়োজনে সংলাপ, নৃত্য, সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্রের বহুমাত্রিক ব্যবহারে নাট্যাঙ্গনকে বহুমাত্রিকতা ও বিশিষ্টতা দান করেছেন। প্রহসন নাটক রচনা করে সমাজের, ধর্মের কুসংস্কারের গভীরে তীব্র খোঁচা দিয়েছেন। রবীন্দ্রত্তোর বাঙলার দর্শক সমাজে বাঙলা নাটকের যে সমাদর তার বীজ রবীন্দ্রনাথের হাতেই প্রোথিত। বাঙলা সাহিত্যের প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথ যেমন প্রাসঙ্গিক তেমনি তার উন্নত রুচি ও অভিনয় ঐশ্বর্য নাট্যমুগ্ধ বাঙালির হৃদয়েও চিরভাস্বর। 

লেখক পরিচিতি:

বীরেন মুখার্জী: নব্বইয়ের দশকের অন্যতম কবি। কবিতার পাশাপাশি গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস ও রাজনৈতিক কলাম লিখে চলেছেন একাধারে। তার আগ্রহের অন্যতম বিষয় ‘মুক্তিযুদ্ধ’ এবং ‘লোকঐতিহ্য’। এ বিষয়ে তার অনেক প্রবন্ধ জাতীয় দৈনিক এবং বিভিন্ন ছোটকাগজে প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। তার কবিতা চৈতন্যের আঁধারে সঞ্জীবিত ত্রিকালদর্শী বাস্তবতাকে সম্প্রসারিত করে, যেখানে অন্তর্গত পর্যবেক্ষণই মুখ্য। চিত্রকল্পের আবিষ্কার ও প্রয়োগে তিনি অভিনব, ঊর্ধ্বমুখী ও উৎকেন্দ্রিক। তার কবিতা অন্তর্গত জীবনের মুখোমুখি দাঁড়ায়। তাৎক্ষণিক সময় আর স্থান তার কবিতার প্রারম্ভবিন্দুকে নিয়ে যায় স্বয়ংসিদ্ধ এক সময়ে। সময়ের আড়ালে আরেক সময়, পৃথিবীর আড়ালে আরেক পৃথিবী- এমন পর্যবেক্ষণ তার কবিতাকে ঋদ্ধ করে। তার কবিতার আবিষ্কার ও উপলব্ধিসমূহ তাই ইন্দ্রিয়াতীত। অতীন্দ্রীয় থেকে ইন্দ্রিয়ের ইঙ্গিতময়তায় ঋদ্ধ তার কবিতা মগ্নতা ও উত্তেজনা দেয়।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে