বিদায় কবি হায়াৎ সাইফ, বিদায়…

মীর রবি

‘কোনোদিন জাগিবে না আর
জানিবার গাঢ় বেদনার
অবিরাম— অবিরাম ভার
সহিবে না আর—’

চলে গেলেন ষাট দশকের খ্যাতিমান কবি ও অনুবাদক হায়াৎ সাইফ। গত রাত বারটার সময়ে তিনি রাজধানীর ইউনাইটেট হাসপাতালে মৃত্যু বরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। তিনি স্ত্রী, দুই সান্তানসহ অসংখ্য শুভাকাঙ্খী ও আত্মীয়-স্বজন রেখে গছেন।

ইউনাইটেট হাসপাতাল থেকে মত ও পথকে কবির মৃত্যু সংবাদ নিশ্চিত করে জানানো হয়, কবি হায়াৎ সাইফ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত রাতের প্রথম প্রহরে মারা যান।

কবিকে গত ২২ মার্চ এই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। ভর্তির পর থেকেই তাকে হাসপাতালের আইসিইউতে রাখা হয়েছিল। হাসপাতালের মরচুয়ারিতে কবির মরদেহ রাখা হয়েছে। প্রয়াত কবির জানাজা মঙ্গলবার (১৪ মে) রাজধানীর কাকরাইলের স্কাউট ভবনে সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত হবে।

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী জানান, ‘আগামীকাল কবি হায়াৎ সাইফের মরদেহ বাংলা একাডেমিতে আনা হবে। একাডেমিতে কবির প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানানো হবে। কবির ছেলে ও মেয়ে বিদেশে রয়েছেন। তারা দশে আসার পর একাডেমিতে কবির মরদেহ আনার সময় ঠিক করা হবে।’

এদিকে কবি হায়াৎ সাইফের মৃত্যুতে শোক নেমে এসেছে শিল্প ও সাহিত্যাঙ্গনে। শোক জানিয়ে কবি ও সাংবাদিক মারুফ রায়হান বলেন, ‘কবি হায়াৎ সাইফের প্রতিবেশী ছিলাম বেশ ক’বছর উত্তরায়। তখন খুব যাওয়া আসা ছিল। উভয় দিক থেকেই। কবির বাড়িতে আনুষ্ঠানিক কবিতাপাঠ হতো। তিনি ছিলেন কবিতামগ্ন মানুষ, প্রকৃত শিক্ষিতজন। ভালো বক্তাও। আড্ডা দিয়ে ভালো লাগতো।

তিনি আরও বলেন, ‘আমাকে জোর করেই সাইফ ভাই সাধারণ সম্পাদক করেছিলেন রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের। মঞ্চে কবিতাপাঠের আসরে আমন্ত্রণ জানালে সাড়া দিতেন ব্যক্তিগত অসুবিধা উজিয়ে। ভাল কবিদের প্রস্থান আমাদের জন্যে মহাক্ষতি। হায়াৎ সাইফকে হারিয়ে বড় অসহায় লাগছে। কিছুটা অপরাধবোধও। ভিন্ন পাড়ায় চলে যাওয়ার পর তেমন সাক্ষাৎ হতো না। এ নিয়ে তার অনুযোগ ছিল। তাছাড়া টিভির বিশ্বসাহিত্য অনুষ্ঠানে তাকে আমন্ত্রণ জানানোর পরিকল্পনা ছিল অনেকদিনের। সেখানেও দেরি করে ফেললাম।আর দেখা হবে না, এমনটা ভাবতেই পারছি না…’

প্রগতি লেখক সংঘের সভাপতি, কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু বলেন ‘কবি হায়াৎ সাইফ, আমাদের সিনিয়র কবি ছিলেন, যখনই দেখা হয়েছে, আন্তরিকতায় টেনে নিয়েছেন, এই আন্তরিকতা আমার কাছে কম মূল্যের নয়, তার মৃত্যুর এই সময়ে, তার প্রতি ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধা জানাই।’

ঢাকা ট্রানস্লেশন ফেস্টের উপদেষ্টা, কবি ও অনুবাদক গৌরাঙ্গ মোহান্ত বলেন, ‘ঢাকা ট্রানস্লেশন ফেস্টের পুরোধা, মেধাবী কবি হায়াৎ সাইফের তিরোধান বেদনা ও শূন্যতা বয়ে আনলো। তার শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সহমর্মিতা জানাই। বিশ্বাস করি তার কবিতা অনেক কবির স্বপ্নবীজ অঙ্কুরণে সহায়ক হবে।’

খ্যাতিমান কবি হায়াৎ সাইফ ১৯৪২ সালের ১৬ ডিসের ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। স্কুল জীবন থেকেই লেখালেখি শুরু। তার প্রথম কবিতা ১৯৬২ সালে ‘মাসিক সমকাল ’এ প্রকাশ পায়। ইংরেজী সাহিত্যে এম.এ পাস করার পর তিনি পাকিস্তান রেডিওতে সংবাদ পাঠ ও অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন। পরে সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। ১৯৯৯ সালে তিনি সরকারি চাকরি থকে অবসরে যান।

তিনি বাংলাদেশ স্কাউট এর ন্যাশনাল কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন। ২০০৩ সালে বিশ্ব স্কাউট কমিটির একমাত্র ও বিশ্ব স্কাউট পরিমন্ডলের সবচেয়ে সম্মানজনক পদক ‘ব্রোঞ্জ উলফ’ প্রদান করা হয় তাকে। ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ‘একুশে পদক’-এ ভূষিত হয়েছেন তিনি।

কবির কৃত নাম সাইফুল ইসলাম খান। হায়াৎ সাইফ তার লেখক নাম। তার প্রকাশিত কবিতার বই আটটি ও কয়েকটি গদ্য এবং অনূদিত বই রয়েছে। ১৯৯২ সালে তার লেখা সাহিত্য বিষয়ক সংকলন গ্রন্থ উক্তি ও উপলব্ধি প্রকাশিত হয়। ২০০৪ সালে মাহবুব তালুকদারের সাথে যৌথভাবে বাংলাদেশের সমসাময়িক গদ্য নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ২০০৯ সালে প্রকাশিত হয় কবিতা সংকলন প্রধানত স্মৃতি এবং মানুষের পথচলা যাতে ৭৫টি কবিতা রয়েছে।

১৯৯৮ সালে দিব্য প্রকাশ থেকে ফয়জুল লতিফ চৌধুরীর সম্পাদনায় ভয়েস অব হায়াৎ সাইফ নামে একটি ইংরেজি অনুবাদকৃত কাব্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটিতে ৪৫টি কবিতা রয়েছে। ২০০১ সালে পাঠক সমাবেশ থেকে হায়াৎ সাইফ: সিলেক্টেড পয়েম্স নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে