মুদ্রণ ও শিল্পের কাজে ব্যবহৃত উন্নত মানের কাগজ এখন দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ বাজারের পাশাপাশি বিদেশেও যাচ্ছে বাংলাদেশের কাগজ। তবে চোরাই কাগজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশের বাজারেই টেকা কঠিন হয়ে পড়ছে দেশি কাগজের।
জানা যায়, রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য বন্ডেড ওয়্যারহাউস ব্যবস্থায় যে শুল্কসুবিধা দেওয়া হয়, তা চলে যায় কাগজ চোরাকারবারিদের পকেটে। এতে রাষ্ট্র রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে দেশি কাগজশিল্পে বিপুল বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়েছে।
সূত্র মতে, বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে কাগজ ও কাগজ বোর্ড এনে অবৈধভাবে দেশের বাজারে বিক্রি করায় বৈধ আমদানিকারকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএমএ) সূত্রে জানা যায়, দেশে বর্তমানে ছোট-বড় কাগজের কল আছে ১০৬টিরও বেশি। ওই সব কাগজকলে বিশ্বমানের কাগজ উৎপাদন হয়। এসব কাগজ আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক বাজারের কাগজের সমকক্ষ।
এ ছাড়া দেশের বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, টাঁকশাল, রাষ্ট্রের বিভিন্ন বাহিনী ও সব শিক্ষা বোর্ডের জন্য স্থানীয় কাগজ ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
এত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর যোগসাজশে এই বাজারকে অস্থির করে তোলা হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও তারা আমলে নেয় না। বরং কোনো কোনো সময় তাদের ছত্রচ্ছায়ায় অবৈধ কাগজের বাণিজ্য হয়।
বিপিএমএ সচিব নওশেরুল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের কাগজ ও কাগজজাতীয় পণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছে দুই কোটি ডলার বা ১৬৮ কোটি টাকা।
তিনি বলেন, এসব কাগজ রপ্তানি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ ১০ থেকে ১৫টি দেশে। শেষ হতে যাওয়া এই অর্থবছরে এর প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩০ শতাংশ। এ ছাড়া আমদানি বিকল্প পণ্য হিসেবে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে দেশি কাগজশিল্প।
দেশে কাগজের বাজার ও চাহিদা সম্পর্কে জানতে চাইলে নওশেরুল আলম বলেন, দেশি কাগজকলের উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ছয় লাখ টন। আর এই চাহিদার চেয়েও আড়াই গুণ বেশি উৎপাদন সক্ষমতা আছে।
এ ছাড়া চাহিদা কম থাকায় এবং প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় টিকে থাকতে না পারায় আরো ৫০টি কাগজকল এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। এ খাতে বিনিয়োগ প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। সরাসরি ১৫ লাখ শ্রমিক জড়িত। এ ছাড়া পরোক্ষভাবে ৬০ লাখ লোক জড়িত।
চোরাই কাগজে ঠাসা নয়াবাজার
রাজধানীতে কাগজের পাইকারি বাজার পুরান ঢাকার নয়াবাজারে। এখানে দেশে উৎপাদিত ও বৈধপথে আমদানি করা কাগজের সঙ্গে বিক্রি হচ্ছে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা কাগজও। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নয়াবাজারে সরু গলিতে শত শত কাগজের দোকান। ওই সব দোকানে সারি সারি সাজিয়ে রাখা দেশি-বিদেশি বিভিন্ন কাগজ। উন্নত মানের দেশি কাগজ থাকলেও দাম কম হওয়ায় বিদেশি কাগজের চাহিদা বেশি। বিশেষ করে পোশাক কারখানায় ব্যবহৃত বিশেষ টিস্যু কাগজ, ডুপ্লেক্স বোর্ড, নন-কার্বন রিকোয়ার্ড (এনসিআর) আর্ট কার্ড ইত্যাদি।
সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান, এসব কাগজ কাস্টমসে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে এবং আন্ডার-ইনভয়েসিং ও বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে রাতের আঁধারে নয়াবাজারে সরাসরি কাস্টম থেকে রাজধানীর কাগজের বাজারে চলে যায়। কোনো শুল্ক না থাকায় এসব বিদেশি কাগজ কম দামে বাজারে পাওয়া যায়।
নয়াবাজারের এক কাগজ ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দেশে বর্তমানে আন্ডার-ইনভয়েসের মাধ্যমে ভারতের ডুপ্লেক্স বোর্ড আসছে বাজারে। এসব কাগজ প্রতি রিম দেশি ৭০ থেকে ৭২ হাজার টাকা। আর ভারত থেকে চোরাই পথে আসা একই কাগজ বিক্রি হয় ৫০ থেকে ৫৫ হাজার টাকায়।
দেশে এনসিআর কাগজ উৎপাদনে প্রায় শতভাগ স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট ইসিজি পেপারের নামে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে অবাধে খোলা বাজারে চলে আসছে। দেশি কাগজ প্রতি রিম এক লাখ ৪০ হাজার টাকা হলেও চোরাই পথে আসা এই কাগজের দাম পড়ে এক লাখ ১০ হাজার টাকা।
এ ছাড়া ইদানীং প্যাকেজিংয়ের আড়ালে বাজারে সয়লাব হয়ে পড়েছে হোয়াইট প্রিন্টিং পেপার। দেশি শিল্পের পর্যাপ্ত সক্ষমতা থাকার পরও দাম কম হওয়ায় চোরাই কাগজেরই কদর বেশি। চোরাই এই কাগজ প্রতি টন ৯০ হাজার টাকায় পাওয়া যায়। আর স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কাগজের দাম পড়ে ৯৫ হাজার টাকা।
সংকটে আমদানিকারকরা
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) অভিযোগ জানিয়ে বাংলাদেশ পেপার ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন বলেছে, রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পের জন্য বন্ড সুবিধায় আনা কাগজ ও কাগজ বোর্ডে এখন খোলাবাজার সয়লাব। পোশাকশিল্পের নামে নির্ধারিত গ্রামের বাইরে নিম্ন গ্রামের কাগজ ও কাগজ বোর্ড আমদানি করে খোলাবাজারে ছাড়া হচ্ছে। এতে বৈধ পথে সরকারকে নির্ধারিত রাজস্ব দিয়ে আমদানি করা ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা অসম প্রতিযোগিতায় সংকটের মধ্যে পড়ছেন।
অ্যাসোসিয়েশন সূত্র মতে, ১৯৯৬ সালে তৈরি পোশাক শিল্পে ব্যবহারের জন্য বন্ড সুবিধায় কাগজ ও কাগজ বোর্ড আমদানি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। এতে শুধু ৩০০ গ্রাম বা তদূর্ধ্ব গ্রামের কাগজ আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়। রপ্তানিমুখী শিল্পে তেমন চাহিদা না থাকলেও ১০০ গ্রাম বা ১৫০ গ্রামের আর্ট পেপার বন্ডেড সুবিধাভুক্ত করা হয়। সুবিধার আড়ালে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করায় সরকার বিশাল অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে। আর উচ্চ শুল্ক দিয়ে আমদানি ও বিনা শুল্কে আমদানি করা পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি করায় বৈধ আমদানিকারকরা সংকটে পড়েছে।
পেপার ইমপোর্টার্সদের দাবি, দেশি কাগজ শিল্পে ছাপা ও লেখার কাগজ, নিউজপ্রিন্ট, মিডিয়া ও লাইনার পেপার, সিগারেট পেপার, টিস্যু পেপার বোর্ড উৎপাদিত হয়। কিন্তু মুদ্রণশিল্পের পাশাপাশি দেশে ডুপ্লেক্স বোর্ড, আর্ট পেপার, আর্ট কার্ড, কার্ড বোর্ড, সুইডিশ বোর্ড, ফোল্ডিং বক্স বোর্ড ও অ্যাডহেসিভ পেপারের ব্যাপক চাহিদা থাকলেও তা উৎপাদনের শিল্প বেশি গড়ে ওঠেনি।
- আরও পড়ুন >> রোববার আত্মবিশ্বাসী বাংলাদেশের মুখোমুখি হবে বিধ্বস্ত পাকিস্তান
- আরও পড়ুন >> লিবিয়া উপকূল থেকে ১৪ বাংলাদেশিসহ ২৯০ অভিবাসী উদ্ধার
- আরও পড়ুন >> ছাত্রলীগের বাধায় ভিপি নুরের ইফতার মাহফিল পণ্ড
এসব পণ্যের ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা ৬০ শতাংশের বেশি শুল্ক দিয়ে আমদানি করেন। কিন্তু পোশাকশিল্পের জন্য বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে শুল্কমুক্তভাবে আমদানি করা কাগজ ও কাগজ বোর্ড কৌশলে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে।
জানা যায়, ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে তিন বছরে তিন হাজার ৯৮৮ কোটি টাকার পেপার আমদানি করা হয়। এই আমদানির বিপরীতে ব্যবসায়ীরা শুল্ক সুবিধা পান দুই হাজার ৭৭২ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতিবছর সরকার প্রায় এক হাজার কোটি টাকা রাজস্ববঞ্চিত হচ্ছে। বন্ড সুবিধার বাইরে বৈধ পথে এই কাগজ আমদানি করা হলে সরকারের রাজস্ব আরো বাড়বে বলে মনে করছে বাংলাদেশ পেপার ইমপোটার্স অ্যাসোসিয়েশন।