ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন শুরু

অর্থনৈতিক প্রতিবেদক

এনবিআর
ফাইল ছবি

পাশ হওয়ার প্রায় ৭ বছর পর  অবশেষে সোমবার থেকে বাস্তবায়নের পথে যাত্রা শুরু করল আলোচিত মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন-২০১২।

২০১২ সালে নতুন আইনটি প্রণয়ন করা হলেও ব্যবসায়ীদের আপত্তিতে তা সাত বছর পর কার্যকর হলো। আর ব্যবসায়ীদের চাপে নানামুখী ছাড় দিয়ে মূল আইনে অনেক পরিবর্তন করা হয়েছে।

অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা মনে করেন, নতুন আইনটি বাস্তবায়ন অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং ও হয়রানিমূলক হবে। নতুন ভ্যাট আইনটি মাঠপর্যায়ে কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, তা নিয়ে অস্পষ্টতা আছে। প্যাকেজ ভ্যাট প্রথা উঠে যাওয়ার ফলে কিসের ভিত্তিতে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ভ্যাট মওকুফের সীমা নির্ধারণ করা হবে, তা স্পষ্ট নয়। স্বয়ংক্রিয়ভাবে হিসাবপত্র রাখার বিষয়টিও শুধু কাগজ-কলমে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

মূল আইনের একক ১৫ শতাংশ হারের পরিবর্তে আটটি ভ্যাট হার করা হয়েছে। নতুন ভ্যাট হারগুলো হলো ২, ২.৪, ৩, ৪.৫, ৫, ৭.৫, ১০ ও ১৫ শতাংশ। পাশাপাশি টার্ন-ওভার ট্যাক্স সীমা ও ভ্যাট অব্যাহতির সীমাও বাড়বে। যদিও সম্পূরক শুল্ক তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকেও সরে এসেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

অধিকতর যুগোপযোগী ও ব্যবসাবান্ধব করার লক্ষ্যে নতুন আইনে কিছু সংস্কার ও সহজীকরণের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। যেগুলোর মধ্যে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের জন্য টার্ন-ওভার ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত মূসক অব্যাহতি ছাড়াও রয়েছে-

ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতকে উৎসাহ দিতে ৫০ লাখ টাকা থেকে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত বার্ষিক টার্ন-ওভারের ক্ষেত্রে ৪ শতাংশ হারে কর দেওয়ার সুযোগ;

মূসক নিবন্ধন সীমা ৮০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ কোটি টাকা করা;

১৫ শতাংশ মূসকের পাশাপাশি নির্দিষ্ট পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ, সাড়ে ৭ শতাংশ ও ১০ শতাংশ মূসক আরোপ;

স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে করভার কমানোর জন্য মূসক হার ৫ শতাংশ নির্ধারণ;

ওষুধ ও পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের ক্ষেত্রে বর্তমানের মতো স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে মূসকের হার যথাক্রমে ২ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ২ শতাংশ অব্যাহত রাখা।

পণ্য ও সেবার সরবরাহের ক্ষেত্রে চালানের তথ্য ধারণের জন্য দোকান ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) এবং সেলস ডেটা কন্ট্রোলার (এসডিসি) স্থাপন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।  সরকার ইএফডি মেশিন ক্রয়ের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে।

পাশাপাশি বাজেট প্রস্তাবে সংশোধিত আইনের বিশেষ কিছু দিকও তুলে ধরেছেন অর্থমন্ত্রী। এর মধ্যে রয়েছে পণ্য সরবরাহের আগে বিদ্যমান মূল্যঘোষণা পদ্ধতি বাতিল করে বিনিময় বা ন্যায্য বাজার মূল্যের ভিত্তিতে কর পরিশোধের ব্যবস্থা করা।

যেক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ মূসক প্রযোজ্য সেক্ষেত্রে দাখিলপত্রের মাধ্যমে উপকরণ কর রেয়াত গ্রহণ করা যাবে এবং দাখিলপত্রই রিফান্ডের আবেদন হিসেবে বিবেচিত হবে।

২০১২ সালে জাতীয় সংসদে পাশ হওয়ার পর ব্যবসায়ীদের আপত্তির কারণে উদ্যোগ নিয়েও বারবারই আইনটি বাস্তবায়ন পেছাতে হয়েছে এনবিআরকে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরেও বাজেটে চূড়ান্তভাবে বাস্তবায়নের ঘোষণা আসার পরও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে স্থগিত রাখতে হয়েছে এর বাস্তবায়ন।

বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে প্রণীত মূল আইনটিতে ভ্যাটের সার্বজনীন হার নির্ধারণ করা হয় ১৫ শতাংশ। এ হার ধরেই ভ্যাট আদায়ে অনলাইন প্রক্রিয়ার সফটওয়্যার স্থাপন করা হয়। ব্যবসায়ীদের বারবার আপত্তির কারণে শেষ পর্যন্ত আইনের মূল মেরিট থেকে সরে একটি বহুস্তর ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে সরকার।

নতুন ভ্যাট আইনটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এনবিআরকে সবচেয়ে বেশি ছাড় দিতে হয়েছে টার্ন-ওভার ট্যাক্স সীমায়। ২০১২ সালের আইনটিতে ৮০ লাখ টাকা পর্যন্ত টার্ন-ওভারে ভ্যাটের পরিবর্তে ৩ শতাংশ টার্ন-ওভার ট্যাক্স দিতে হতো। এখন এ সীমা ৩ কোটি করা হচ্ছে।

অর্থাৎ ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত টার্ন-ওভারে ভ্যাটের পরিবর্তে টার্ন-ওভার ট্যাক্স দিতে হবে। তবে এ করহার ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে।

২০১২ সালের প্রস্তাবিত আইনে ভ্যাটমুক্ত টার্ন-ওভার সীমা ৩০ লাখ ছিল। ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে এতে পরিবর্তন এনে ৫০ লাখ টাকা করা হচ্ছে। অর্থাৎ ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিকিকিনিতে ভ্যাট দিতে হবে না ব্যবসায়ী পর্যায়ে।

নতুন আইনে সম্পূরক শুল্ক তুলে দেওয়ার প্রস্তাব ছিল বিশ্বব্যাংকের। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে ১ হাজার ৪০০ পণ্যে সম্পূরক শুল্ক বহাল রাখছে এনবিআর। কিছু পণ্যে শুল্কহার কমলেও মোবাইলফোনে কথা বলা, বিমানে ভ্রমণ ও গাড়ির নিবন্ধনসহ বেশ কিছু পণ্যে এ শুল্কহার বাড়ানো হয়েছে।

জাতীয় সংসদে ঘোষণার পর পণ্য ও সেবাভেদে ভ্যাটহার ২, ৫, ৭.৫, ১০ ও ১৫ শতাংশ হারে কার্যকর হবে। আগে ১০-১৫ শতাংশ ভ্যাট হার থাকলেও আগামী অর্থবছর থেকে বিদ্যুৎ খাতে মাত্র ২ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায় করবে এনবিআর।

একইভাবে ট্যারিফের পরিবর্তে মাত্র ২ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায় করা হবে ওষুধ ও রডের মতো প্রয়োজনীয় পণ্যে। সম্পূরক শুল্ক শূন্য করে দেওয়া হয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাসের ক্ষেত্রে।

ভ্যাটের হার কমিয়ে ৫ শতাংশ করে আরোপ হবে আগে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দেওয়া ইন্টারনেট, ইনডেন্টিং সংস্থায়। ৮ শতাংশের পরিবর্তে ৫ শতাংশ করা হচ্ছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে।

আইনে ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ হচ্ছে খাদ্য সামগ্রীসহ প্রয়োজনীয় আরো শতাধিক পণ্যে, যার অধিকাংশ পণ্যেই ১৫ শতাংশ ভ্যাট নির্ধারণ করা ছিল।

সেবার ক্ষেত্রে অধিকাংশই সাড়ে ৭ ও ১০ শতাংশ হারে ভ্যাট নির্ধারণ করে নতুন আইনটি প্রস্তাব করেছে এনবিআর। তবে আগের মতোই ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট থাকছে স্বাস্থ্যহানিকর ও বিলাসবহুল পণ্যে।

২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বাংলাদেশে নতুন ভ্যাট আইন করার জন্য সুপারিশ করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। তৎকালীন সরকার আইএমএফের ওই সুপারিশ আমলে নেয়নি। যুক্তি ছিল, অভিন্ন ভ্যাট হার করার সময় আসেনি।

এরপর ২০০৯ সালে নতুন সরকার আসার পর আইএমএফ নতুন ভ্যাট আইন করার বিষয়ে আবারো তাগিদ দেয়। ২০১২ সালে বাংলাদেশকে বর্ধিত ঋণ সহায়তার (ইসিএফ) প্রায় ১০০ কোটি ডলার অনুমোদন করে আইএমএফ। এই ঋণ পাওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত ছিল নতুন ভ্যাট আইন করা।

আইএমএফের শর্তানুযায়ী ২০১২ সালে আইনটি জাতীয় সংসদে পাশ করে সরকার। এরপর ২০১৫ সালে তা কার্যকরের উদ্যোগ নেয় এনবিআর। তবে ব্যবসায়ীদের আপত্তির কারণে পিছিয়ে যায়।

এরপর ২০১৭ সালের বাজেটে জাতীয় সংসদে আইন চূড়ান্তভাবে পেশ করার পরও ব্যবসায়ীদের বিরোধিতায় তা দুই বছরের জন্য পিছিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী।

ওই আইনটিতে ভ্যাটের একক হার, ট্যারিফ তুলে দেওয়া, সম্পূরক শুল্ক না রাখাসহ নানা শর্ত ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত এসব সিদ্ধান্তের কোনোটিই পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারে নাই এনবিআর।

১৯৮৬ সালে বিশ্বব্যাংকের কর সংস্কার মিশনের সুপারিশে প্রথম ভ্যাট ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৯৯০ সালে ভ্যাট আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। ১৯৯১ সালের ১০ জুলাই থেকে সীমিত পরিসরে ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন শুরু হয়। পরে বিভিন্ন সময়ে ওই আইনের বিচ্যুতি হয়। দীর্ঘ ২১ বছর পর ২০১২ সালে নতুন ভ্যাট আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে বাস্তবায়নের কথা থাকলেও ব্যবসায়ীদের আপত্তিতে তা দুই বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে