গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট থেকে রাষ্ট্রীয়খাতের ব্যাংকগুলোকে মূলধন ঘাটতি পূরণে কোনো অর্থ দেয়নি সরকার। তবে এ খাতের বেশ কয়েকটি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি প্রকট আকার ধারণ করেছে। যার ফলে অনেক ব্যাংকেরই ব্যবসা করতে সমস্যা হচ্ছে। এমন অবস্থায় মূলধন ঘাটতি পূরণে সম্প্রতি সোনালী ব্যাংক তাদের ৬ হাজার কোটি টাকার সরকারি গ্যারান্টিপত্র ইস্যু করার আবেদন করে। কিন্তু সে আবেদন নাকচ করে দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এ আবেদন নাকচ করে সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি সোনালী ব্যাংকের সিইও অ্যান্ড ম্যানেজিং ডিরেক্টরের কাছে পাঠানো হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, মূলধন ঘাটতি পূরণে সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের অনুকূলে ৬ হাজার কোটি টাকার সরকারি গ্যারান্টি প্রদানের সুযোগ নেই।
অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, জনগণের করের টাকায় প্রতিবছর সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি মেটানোর জন্য অর্থ দেয়া হয়। অর্থ দেয়ার পরও এসব ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ভালো হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে এই ব্যাংকগুলোকে আদৌ অর্থ দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তাই এবার তাদের কোনো অর্থ দেয়া হয়নি।
সরকারি ব্যাংকগুলো বাজেট থেকে জনগণের করের টাকা না দেয়া ও সরকারি গ্যারান্টি না দেয়াকে ইতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখছেন অর্থনীতিবিদরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘একটি ব্যাংকে যখন সুশাসন থাকে না, তখন জাল-জালিয়াতির প্রবণতা বেড়ে যায়। ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। এর প্রভাবে মূলধন ঘাটতি বাড়ে।’
তিনি বলেন, ‘জনগণের করের টাকা থেকে ব্যাংকগুলোকে এভাবে মূলধনের জোগান দেয়ার আগে তাদের কাজের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা উচিত। জবাবহিদিতা থাকলে জালিয়াতি হবে না। তখন ঋণও খেলাপি হবে না। স্বাভাবিকভাবে কমে যাবে মূলধন ঘাটতি।’
- আরও পড়ুন >> পদ্মায় পিনাক-৬ ডুবির ৫ বছর আজ
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে সোনালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৩২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে হলমার্কসহ কয়েকটি জালিয়াতির কারণে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এতে বেড়েছে ঘাটতি।
আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোকে তাদের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে কমপক্ষে ১০ শতাংশ মূলধন রাখতে হয়। তবে এর পরিমাণ হবে কমপক্ষে ৪০০ কোটি টাকা। কোনো ব্যাংক ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে ওই হারে অর্থ রাখতে না পারলে মূলধন ঘাটতি হিসেবে ধরা হয়। যে পরিমাণ অর্থ ঘাটতি থাকবে সেটিই তাদের মূলধন ঘাটতি। ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণ খেলাপি হলেই ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বেড়ে যায়।
অর্থ বিভাগ সূত্র জানায়, সরকারি কয়েকটি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে ধুঁকতে থাকলেও প্রায় ১০ বছর পর গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট থেকে কোনো অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়নি তাদের। বরং অর্থবছরের শেষদিন অর্থাৎ গত ৩০ জুন দুটি ব্যাংকের জন্য মাত্র ১৫১ কোটি ১২ লাখ টাকা ছাড় করা হয়। তবে এই অর্থ মূলধন ঘাটতি পূরণে দেয়া হয়নি। দেয়া হয়েছে ভর্তুকি হিসেবে এবং একটি ব্যাংকের সরকারি অংশের শেয়ার টিকিয়ে রাখার জন্য।
২০১৮-২০১৯ অর্থবছরের বাজেটে মূলধন পুনর্গঠন খাতে বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এই অর্থ থেকে দুটি ব্যাংককে দেয়া হয়েছে ১৫১ কোটি ১২ লাখ টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংককে দেয়া হয়েছে ১৫০ কোটি টাকা এবং গ্রামীণ ব্যাংকে থাকা সরকারি শেয়ার ধরে রাখার জন্য দেয়া হয় ১ কোটি ১২ লাখ টাকা। অন্য কোনো ব্যাংককে আর অর্থ দেয়া হয়নি। এবার কোনো ব্যাংককেই মূলধন ঘাটতি পূরণে অর্থ দেয়া হয়নি।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে সরকারি চার ব্যাংকের পক্ষ থেকে মূলধন ঘাটতি পূরণে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা চেয়ে একটি চাহিদাপত্র দেয়া হয়। তবে গত মার্চ মাসে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে অর্থ বিভাগে বরাদ্দের সমপরিমাণ অর্থ অর্থাৎ প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা চাওয়া হয়। তবে অর্থ বিভাগ এবারই প্রথম আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কথায় কর্ণপাত করেনি। ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতিতে উন্নতি না হওয়ায় অর্থ বিভাগ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বরাদ্দ থাকার পরও এ খাতের জন্য কোনো অর্থ ছাড়েনি।
সরকারি বাজেট ডকুমেন্ট ও অর্থ বিভাগ সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, গত প্রায় ১০ অর্থবছর ধরে সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি পূরণে অর্থ বরাদ্দ রাখছে সরকার। ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে পুনর্মূলধন খাতে ১ হাজার কোটি টাকা দেয়া হয়েছিল। তার পরের অর্থবছর ২০১০-২০১১ অর্থবছরে দেয়া হয় ১ হাজার ৫০ কোটি টাকা।
একইভাবে ২০১১-২০১২ অর্থবছরে দেয়া হয় ৭০০ কোটি; ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে ৪২০ কোটি; ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে ৫ হাজার ৬৮ কোটি; ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে ২ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা; ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা; ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে ২ হাজার কোটি এবং ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয় ২ হাজার কোটি টাকা।
এ ছাড়া অর্থ বিভাগের তথ্য মতে, ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত সময়ে মূলধন পুনর্ভরণ, সুদ ও ভর্তুকিসহ নানা উপায়ে সরকার ব্যাংকগুলোকে ১২ হাজার ৪৭২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে।