সুস্থ রাজনীতি, বলিষ্ঠ ছাত্র-আন্দোলন, পঠন-পাঠন—সব অহংকার ঐতিহ্য ধুলায় মিশিয়ে দিচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার ছাত্রসমাজের একাংশ। অতীব সংখ্যালঘু এ অংশ, তবু ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর ও বুয়েট থেকে শুরু করে দেশের বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে একের পর এক জঘন্য ও ন্যক্কারজনক ঘটনা গোটা দেশের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গর্ব করার মতো একেকটি শিক্ষায়তন, তাদের শিক্ষক ও ছাত্রসমাজ। অথচ এদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষায়তনগুলোতে সুশিক্ষার পরিবেশের বদলে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য, নির্মমতা ও নৃশংসতা, রাজনীতির নামে দুর্বৃত্তপনা, দুর্নীতি ও অনৈতিকতা। ভিন্নমত অসহ্য। জীবনের দাম বিনা কড়িতে লুটায়। এমন সহিংস নৈরাজ্য কারো ভাবনায় ছিল?
পঞ্চাশ-ষাটের দশকের ছাত্ররাজনীতির আদর্শ অদৃশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে অনেক, দুর্বৃত্তপনাও বেড়েছে সেই হারে। শিক্ষক সমাজও স্বার্থপর বিভাজনে সব আদর্শ বিকিয়ে দিয়েছে। নিরীহ, মেধাবী ছাত্রদের অবস্থান নড়বড়ে, দুর্বল। ঐতিহ্যবাহী যে ডাকসুর জন্য এত লেখালেখি, এত আহ্বান, সেই ডাকসুর নির্বাচন সত্ত্বেও সে পূর্ব ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। শুধু স্বার্থপর সহিংসতা আর অসুস্থ ক্ষমতার লড়াই, সেখানে নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড ডাল-ভাত। তাতে প্রতিক্রিয়ার বলিষ্ঠতা সর্বব্যাপী নয়।
এ অবস্থার প্রকাশে ডাকসুর পুনরুজ্জীবনের কোনো প্রয়োজন ছিল কি? বুয়েটের সাম্প্রতিক ঘটনা, প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি কোনো আদর্শিক প্রভাব তৈরি করেছে কি? না, সেসব দূর-অস্ত। দুর্বৃত্তরা দুর্বার, ওরা বেপরোয়া। ওরা ছাত্রত্বের আদর্শ হারিয়েছে অথবা বিকিয়ে দিয়েছে। বিস্ময়কর যে দীর্ঘদিন ধরে চলা এ অবস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ ও পরিবর্তনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোনো প্রকার মাথাব্যথা নেই।
বুয়েটের নৃশংস ঘটনা তথা আবরার হত্যার ভয়াবহতার প্রতিক্রিয়া আন্তর্জাতিক মহলেও দেখা দেয়। প্রধানমন্ত্রীর তৎপরতায় বিষয়টি আইনসম্মত সমাধানের পথ ধরে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির সুস্থতার পথে চাপ তৈরি হয়। কিন্তু এর নিয়মতান্ত্রিক পথনির্দেশনার সার্বিক বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে এর সমাধান সম্পন্ন করা হয়। ভাবা হয় না ভবিষ্যতের কথা। এর পরিণাম হলো ডাকসু ঘটনাবলি।
দুই.
বুয়েটের নৃশংস ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বহু আলোচনার বিষয় ছিল, ঘটনার বিচ্ছিন্ন সমাধানই নয়, ছাত্র-শিক্ষায়তনে এই নৈরাজ্যের স্থায়ী সমাধান, যেমন বুয়েটের দাবি—ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা। আনুষঙ্গিক বিষয় ছিল, এতে শিক্ষকদের সংশ্লিষ্টতা বন্ধ করা। সব মিলিয়ে শিক্ষায়তনে দুর্বৃত্তপনা, নিষ্ঠুরতা আর নয় (র্যাগিংসহ)। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন—কারো এ বিষয়ে আগ্রহ দেখা গেল না।
অশান্ত বুয়েট শান্ত হলো, ব্যস সব তৎপরতা ও চিন্তাভাবনা শেষ। কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা না নেওয়ার ফলে অনায়াসে নির্বিকারচিত্তে ঘটানো হলো ডাকসুর ভিপি নুরুল হকের ওপর হামলা। হাসপাতালে তাঁকে দেখতে গিয়ে ঢাবির উপাচার্য যে আশঙ্কা প্রকাশ করেন, আক্রান্ত ভিপির প্রতিক্রিয়া ভিন্ন নয়, হামলার উদ্দেশ্য ছিল তাঁকে হত্যা করা, একটি লাশ ফেলা, আতঙ্ক সৃষ্টি করা।
কেন? যাতে আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার জোরালো প্রতিবাদ না হয়। হামলাকারীদের পরিচিতি নিয়েও ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামক একটি সংগঠনকে নিয়ে। অথচ পত্রপত্রিকায় বলা হচ্ছে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা ভিপি নুরুল হকের ওপর দুই দফা হামলা চালিয়েছে। তাহলে কি মুক্তিমঞ্চের ব্যানারে এই হামলা যাতে হামলাকারী হিসেবে ছাত্রলীগের নাম না ওঠে, প্রধানমন্ত্রীকে বিব্রত হতে না হয়।
আপাতদৃষ্টিতে উদ্দেশ্য সিদ্ধ মনে হলেও সাংবাদিক ও সংবাদপত্র মহল হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছে—অর্থাৎ যাহা মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ তাহা ছাত্রলীগ। ভিপি নুরুল হক যে ‘আবরার হননি’ তার কারণ তাঁর সংগঠন ‘ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’, না কি অন্য কিছু। একটি দৈনিকের প্রতিবেদন—‘নুরুল হক কেন বারবার মার খান’? এ প্রশ্নের আলোচনার আগে দেখা যাক অকুস্থলে কী ঘটেছে। পত্রিকা লিখেছে—‘এখন বলা হচ্ছে যেন মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ আর ছাত্রলীগ দুটি আলাদা বিষয়। কিন্তু…হামলা পর্যন্ত যে ছাত্রলীগের কর্মীরাই এর সদস্য, সেটা সবার জানা। এরাই যখন অন্য সময়ে অন্যত্র অন্যদের ওপর হামলা চালিয়েছে, তাতে বাহ্বা দেওয়ার লোকের অভাব হয়নি।’
লক্ষ করার বিষয় যে পুলিশের মামলা ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে নয়, মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সদস্যদের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে স্বনামখ্যাত আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ‘এ হামলা অন্যায়, অগ্রহণযোগ্য। ডাকসুর ভিপির গায়ে হাত তোলা সব ছাত্রসমাজের জন্য কলঙ্ক’। অন্য এক খ্যাতনামা নেতা এক পা এগিয়ে বলেছেন—‘এ হামলা বর্বর ও পৈশাচিক।’ অন্য নেতারাও একই সুরে কথা বলেছেন, অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চকে ধিক্কার দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের নেতারা হামলার প্রতিবাদ করেছেন, ভালো কথা। উপাচার্য ও প্রক্টরের উদ্দেশ্যমূলক উদাসীনতা সত্ত্বেও বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। তাই প্রধানমন্ত্রীকে আর এগিয়ে আসতে হলো না। কিন্তু বাস্তব ঘটনা হলো, ছাত্র-শিক্ষক সবাই তো সবাইকে চেনেন, তাঁদের রাজনৈতিক চরিত্রও ভালোভাবেই জানেন। কোন শিক্ষক কোন দিকে, কোন ছাত্রসংগঠন কোন দিকের, তাও কারো অজানা নয়। সে অবস্থায় কি সত্য গোপন করা যাবে?
তিন.
আমার দুঃখ, দুর্ভাগ্য দেশের স্বচ্ছ রাজনৈতিক মঞ্চের যে একটি মেধাবী ছাত্রের শাহাদাতবরণের শিক্ষা বৃথা গেল। বুয়েট-ছাত্রদের দাবি হাওয়ায় ভেসে গেল। একই কারণে এবার একজন ছাত্র-প্রতিনিধি ডাকসু ভিপি হত্যার উদ্দেশ্যে হামলার শিকার। অর্থাৎ ভিন্নমতের কারণে। ভিন্নমতটা আবরারের মতোই, দেশের স্বার্থবিষয়ক। ভারতের নাগরিক আইন ও এনআরসি নিয়ে প্রতিবাদ।
রাজনৈতিক কারণে ভিন্নমত হলেই তার ওপর হামলা চালাতে হবে? তাকে মেরে ফেলার চেষ্টা চালাতে হবে? যুক্তিতথ্য দিয়ে একমত খণ্ডন করে অন্যমত প্রতিষ্ঠা অসম্ভব মনে করেই কি একেবারে উৎস শেষ করার চেষ্টা। এ কোন দেশি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বাংলাদেশের রাজনীতিতে। ভিপি নুরুল হকের বক্তব্য মতেই এ তথ্য জানা যাচ্ছে।
ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সম্পর্ক সত্ত্বেও বিজেপিশাসিত ভারত বাংলাদেশের স্বার্থে সঠিক ভূমিকা পালন করছে? তিস্তা শুকিয়ে গেলে কি উত্তরবঙ্গ উর্বর হবে, শস্য উৎপাদন বাড়বে? আসাম বা ভারতের অন্য রাজ্য থেকে বাংলাদেশি মুসলমান খেদিয়ে এ দেশে পুশব্যাক করলে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা হবে? সর্বোচ্চ ঘনবসতির বাংলাদেশের কি অর্থনৈতিক উন্নতি হবে, শ্বাসপ্রশ্বাস স্বচ্ছ হবে?
আমরা ভুলিনি একাত্তরে ভারতের ব্যাপক সশস্ত্র সাহায্য এবং শরণার্থী আশ্রয়দানের কথা, ভূ-রাজনৈতিক সাহায্যের কথা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রিকভাবে সে কারণে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এসেছে বরাবর। দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা চুক্তিতে অনেক সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে ভারতকে, যেগুলোর মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট বা আসামের সঙ্গে, ত্রিপুরার সঙ্গে যোগাযোগে বিরাট এক আশীর্বাদস্বরূপ। এ রকম বহু সুযোগ-সুবিধা ও তেমন স্বার্থরক্ষা সম্পন্ন হয়েছে উভয় দেশের জন্য। ভারত বা বাংলাদেশের কারোরই তা ভুলে যাওয়ার কথা নয়।
চার.
বুয়েটে ছাত্রলীগের ঘাতক হামলার রাজনীতির পরিণামে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া ও নির্দেশনা মনে হয় বিফলে গেল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতি সুস্থ ও স্বচ্ছ ধারা অনুসরণ করবে বলে মনে হচ্ছে না। করলে ডাকসু ভিপির ওপর ঘাতক হামলা চলত না এবং ছাত্রলীগের সংশ্লিষ্টতা রদের চেষ্টার দরকার হতো না। পুলিশের তৎপরতা সে ক্ষেত্রে সঠিক পথ ধরে চলতে পারত।
সে ক্ষেত্রে পত্রিকাগুলোতে এত বিপরীত মতের প্রকাশ ঘটত না। এতে কি ছাত্রলীগের মর্যাদা বেড়েছে? যেমন একটি তির্যক শিরোনাম : ‘হামলায় আছে ছাত্রলীগ/পুলিশের মামলায় নেই’। ‘ডাকসুতে হামলার পেছনে কারা’? এ প্রতিবেদনে ডাকসুর অতীত গৌরবের কথা স্মরণ করে বর্তমান আচরণে গভীর ক্ষোভ ও আবেগ প্রকাশ করা হয়েছে। অন্য একটি প্রতিবেদন : এত ঠাণ্ডায়ও ‘ডাকসুতে হামলার প্রতিবাদে সমাবেশ’/ক্ষোভে ফুঁসছে ছাত্র-শিক্ষক-জনতা।
এ পর্যায়ে পরিস্থিতি অনুধাবন করতে খুব একটা অসুবিধা হয় না। ছাত্র-শিক্ষকদের দাবি জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার—অন্যথায় সারা দেশে শিক্ষার্থীদের নিয়ে আন্দোলনে নামার ঘোষণা, এরই মধ্যে অকুস্থলের সিসি ফুটেজ গায়েব। উদ্দেশ্য সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপাট। স্বাভাবিক হিসাবেই অভিযোগের আঙুল আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে। অপরাজেয় বাংলায় মানববন্ধন। সেই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ ও মানববন্ধন।
কিন্তু নির্বিকার মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ, নির্বিকার ছাত্রলীগ। তবে শেষ পর্যন্ত সাময়িক আন্দোলনের চাপে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের তিন নেতা রিমান্ডে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে। এরই মধ্যে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের স্মারকলিপি ঢাবি উপাচার্যকে। আর থানায় নুরের অভিযোগ সনজিত-সাদ্দামসহ ৩৭ জনের বিরুদ্ধে। এত বড় অপরাধের পরিণাম কী হতে পারে তার আভাস-ইঙ্গিতও দিচ্ছেন কথিত মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতারা—তাঁরা হাস্যোজ্জ্বল মুখে দাঁড়িয়ে আসামির কাঠগড়ায়।
ঘটনা এখানেই শেষ নয়। ঘটনার পরিহাসই বলতে হয়, হামলায় গুরুতর আহতরা যখন হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন এবং ঘটনা কারা ঘটিয়েছে এ বিষয়ে সবাই যখন নিশ্চিত এবং প্রতিবাদী, তখন অবস্থা বেগতিক দেখে আক্রান্তদের বিরুদ্ধেই মামলা করেছেন মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতারা। এবং পুলিশ সে মামলা নিয়েছে, যা করা হয়েছে অন্য দফায়।
এসব ঘটনা কিসের আলামত? ছাত্ররাজনীতি ও শিক্ষার্থী সমাজে অস্থিরতা, নৈরাজ্য ও অশান্তি সৃষ্টিই মূল উদ্দেশ্য নয় কি? সেটা কী? সমাজের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে নিজেদের মর্জিমতো সব কিছু চালনা করা? তাতে কি সব রক্ষা হয়? রক্ষা হয় বহু গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক ও মানবিক মূল্যবোধ? দুর্ভাগ্য, বুয়েটের শিক্ষা শিক্ষায়তনিক ক্ষেত্রে বৃথা গেল। শিক্ষায়তন বুঝি সহিংসতার কেন্দ্র হয়েই থাকবে?
লেখক : কবি, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী
- আরও পড়ুন >> নাগরিক আইনের পরিণতি কোন দিকে?