করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এ বছরটা (২০২০) কি বাংলাদেশের বৌদ্ধিক ভুবন ও সাংস্কৃতিক জগতের জন্যও ক্রান্তিকাল? গণমাধ্যম, সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগসম্পন্ন মানুষ মাত্রই জানেন উল্লিখিত ভুবনগুলোতে ক্ষতির পরিমাণ। করোনা সংক্রমণে কিংবা ভিন্নতর জটিল রোগে এই অতি অল্প সময়ের মধ্যে সামাজিক বিচারে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন অসাধারণ মানুষকে আমরা হারিয়েছি। অংশত হলেও তাতে তৈরি হয়েছে শূন্যতা, সেই সঙ্গে হারিয়েছি বিভিন্ন পেশার অনেক বিশিষ্টজনকে, সমাজে যাঁদের অবদান কোনো অংশে কম নয়।
জামিলুর রেজা চৌধুরী বা আনিসুজ্জামান প্রমুখের ধারাবাহিকতায় এবার প্রস্থান (২০ জুন ২০২০) বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানীর (১৯৩৪-২০২০)। ‘বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব’ কথাটি বলছি এ কারণে—রাজনীতি, সংস্কৃতি, সাংবাদিকতা এবং সব শেষে কলাম রচনার মতো নানা পেশার, নানা ঘাটে তাঁর সফল বিচরণ। মৃত্যু এসে তাতে ছেদ টেনে দিল।
দুই.
কামাল লোহানী—আমার একান্তজন, তাঁরও রাজনৈতিক জীবনের সূচনা, যদিও বয়স বিচারে বছর কয় দেরিতে, তবু অনিবার্য একুশের ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে। তিনি তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী (কথাটা তাঁর মুখেই শোনা)। পরের ঘটনাটিও তাঁর মুখেই শোনা। ১৯৫৩ সালে পাবনায় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কাউন্সিল মিটিংয়ের মহা আয়োজনে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত দু-একজন হেভিওয়েট নেতার আগমনের বিরুদ্ধে স্থানীয় শিক্ষার্থীদের যে ব্যাপক ও তীব্র প্রতিবাদী আন্দোলন সংগঠিত হয়, তাতেও সংশ্লিষ্ট ছিলেন কামাল লোহানী। তাঁর ভাষায়, প্রবল ওই প্রতিবাদী আন্দোলনের তিনিও একজন সংগঠক ছিলেন। স্বভাবতই চরম পুলিশি দমননীতির মুখে আরো অনেকের সঙ্গে কামাল লোহানীও গ্রেপ্তার।
ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতিমনস্ক কামাল লোহানীর শিক্ষাজীবনে পড়াশোনার চেয়েও রাজনৈতিক আন্দোলন ও মুসলিম লীগ দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলন অধিকতর আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। স্বভাবতই মুসলিম লীগ বিরোধী যুক্তফ্রন্ট গঠন, একুশ দফা ইশতেহারের নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে যোগদানে অধিক আগ্রহী হয়ে ওঠেন কামাল লোহানী।
পঞ্চাশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক ঘটনা হক (ফজলুল হক)-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী—এই তিন প্রধান মিলে প্রাদেশিক নির্বাচনে লড়াইয়ের জন্য যুক্তফ্রন্ট গঠন এবং জনবান্ধব একুশ দফার ভিত্তিতে এ লড়াইয়ে প্রবল শক্তিমান মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টের ধসনামা বিজয়, হক মন্ত্রিসভা গঠন (১৯৫৪) এবং পূর্ববঙ্গজুড়ে মানুষের বিজয়-উল্লাস, কার্জন হলে মহাসমারোহে সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্মেলন।
এ বিজয় সহ্য হয়নি কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ শাসনের। অন্যায়ভাবে, অনৈতিক ও অন্যায্যভাবে ১৯৫৪-র মে মাসে কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক ৯২-ক ধারার মাধ্যমে কেন্দ্রের শাসন জারি, হক মন্ত্রিসভা বাতিল, মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা পূর্ববঙ্গের গভর্নর পদে অধিষ্ঠিত এবং তাঁর দুঃশাসনে ব্যাপক গ্রেপ্তার—রাজনৈতিক নেতাকর্মী, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, সাংস্কৃতিক কর্মী এবং তা দেশজুড়ে। অনেকের সঙ্গে কামাল লোহানীও গ্রেপ্তার। (আমি গ্রেপ্তার এড়াতে বছরখানেকেরও বেশি সময় আত্মগোপনে, আমার শিক্ষাজীবন বিপর্যস্ত)।
এক বছরের মধ্যে নানা রাজনৈতিক স্বার্থ ও কূটনীতির টানে যুক্তফ্রন্ট বিভক্ত, কেন্দ্রীয় শাসন বাতিল, হক সাহেবের কেএসপির মন্ত্রিসভা গঠন, আবু হোসেন সরকারের মুখ্যমন্ত্রিত্বে ১৯৫৫ সালের শেষার্ধের প্রথম দিকে। কারারুদ্ধ নেতাকর্মীদের মুক্তি, মুক্ত কামাল লোহানীও। পূর্ববঙ্গে আদর্শবিচ্যুত রাজনীতির দ্বিতীয় পর্যায় শুরু। কামাল লোহানী পাবনা থেকে ঢাকায়। তাঁরও জীবনের নতুন পর্ব শুরু। শুরু তাঁর সাংবাদিকতার জীবন।
তিন.
কামাল লোহানী প্রগতিবাদী রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক, গণরাজনীতিনির্ভর একাধিক ধারার সাংস্কৃতিক কর্মী ও সংগঠক এবং কলামিস্ট। জীবিকা ও পেশাগত প্রয়োজনে সাংবাদিকতা, কিন্তু সংস্কৃতির ভুবনই তাঁর প্রধান কর্মক্ষেত্র। বিশেষ করে মঞ্চনাট্য, নৃত্যনাট্য, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং সেই প্রয়োজন মেটাতে মাঝেমধ্যে সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা। জীবনের প্রধান আকর্ষণ এ দিকটাতেই।
তাঁর এসব কর্মকাণ্ডের প্রধান সময়টা ছিল ষাটের দশকজুড়ে, শুরুটা অবশ্য পঞ্চাশের দশকের একেবারে শেষ দিক থেকে। এরই মধ্যে মার্ক্সবাদী রাজনীতিও তাঁর মধ্যে প্রবল। সেই টানে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান। অন্যদিকে জনবান্ধব রাজনীতির প্রবক্তা এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি মওলানা ভাসানীর প্রতি অনুরাগবশতই বোধ হয় ১৯৫৭ সালে বিখ্যাত কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন কামাল লোহানী। সেখানে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেনি, সেটা ঘটেছে অনেক পরে।
সেখানেই আওয়ামী লীগের দুই পীরের রাজনৈতিক আদর্শগত সংঘাত—মার্কিন পুঁজিবাদ বনাম প্রগতিবাদ। পরিণামে দ্রুতই ভাঙন, রূপমহল সিনেমা হলে ভাসানীর সভাপতিত্বে বামধারার পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠিত হয়। একসময় কামাল লোহানী ন্যাপে যোগ দেন। কারণটা স্পষ্ট—গোটা মার্ক্সবাদী বিশ্ব ষাটের দশকের শুরুতে মস্কো বনাম পিকিংয়ের মতাদর্শিক সংঘাতে বিভক্ত। মাও সে তুংয়ের জনগণতন্ত্র, নয়া গণতন্ত্র, নয়া মানুষ এবং নয়া জনগণতান্ত্রিক রাজনীতি ও সংস্কৃতির টানে আলোড়িত, বিশেষ করে তরুণসমাজ। ব্যতিক্রম নয় বাংলাদেশ। ভাসানী নিজেও চীনপন্থী (মার্ক্সবাদী না হয়েও)। অনেক তরুণের সঙ্গে কামাল লোহানীও ন্যাপে।
অনেক সম্ভাবনা সত্ত্বেও, প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যাপক সাড়া সত্ত্বেও ন্যাপের বড় সমস্যা ছিল অন্তর্নিহিত একাধিক মতের বিরোধ এবং ন্যাপকে গণসংগঠনের পরিবর্তে পার্টি সংগঠনের চরিত্রে পরিণত করার চেষ্টা—সেসব এখানে আলোচনার বিষয় নয়। হয়তো এসব কারণে এবং সংস্কৃতির প্রতি সহজাত অধিক টানে কামাল লোহানী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলায় অধিক আগ্রহী। গঠিত হয় গণসংগীতের সংগঠন ‘ক্রান্তি’। তাঁর নেতৃত্বে ক্রান্তি ষাটের দশকের শেষার্ধে উদীচীর পাশাপাশি ভিন্ন মতাদর্শে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।
চার.
তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় যখন কামাল লোহানী সপরিবারে মতিঝিল কলোনিতে বাস করছেন। সুঠাম, দীর্ঘকায়, লম্বা ঝোলা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরিহিত (এটাই তাঁর বরাবরের বেশ) কামাল লোহানীর সঙ্গে পরিচয়ের মাধ্যম হুমায়ূন (আহমেদ হুমায়ূন)। দুজনেই সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক মতাদর্শে চীনপন্থী। এবং উভয়ের মধ্যে যথেষ্ট সখ্য। লোহানীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক তাঁর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত। কী কারণে জানি না, যুক্তিহীনভাবে বয়সে বছর পাঁচেকের ছোট কামাল লোহানীকে আমি বরাবর ‘লোহানী’ বলেই ডেকে এলাম (অথচ ওটা তো পদবি), তাতে তাঁর কোনো প্রকার অসন্তোষ লক্ষ করিনি। এরপর অনেকটা সময় একসঙ্গে পথচলা।
পরিচিতি আরো গাঢ় হয়, যখন আশির দশকে একুশে চেতনা পরিষদ গঠন উপলক্ষে শফিক খান ও কামাল লোহানী এক সকালে নিউ বেইলি রোডস্থ আমাদের প্যাথলজি ল্যাব ‘বায়োপ্যাথ’-এ এসে হাজির। উদ্দেশ্য আমাকে এই সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত করা। সংগঠনটির মূল উদ্দেশ্য ছিল সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে তিন-চার দিনব্যাপী ভাষাসংগ্রামীদের সম্মেলন অনুষ্ঠান। আমি এককথায় রাজি। সংগঠনের সভাপতি গাজীউল হক, সেক্রেটারি কামাল লোহানী, আমাকে যুক্ত করা হলো সহসভাপতি পদে।
এই সম্মেলন উপলক্ষে শফিক খান ও কামাল লোহানী বগুড়া, পাবনাসহ উত্তরবঙ্গের একাধিক শহর চষে বেড়িয়েছে। এ ছাড়া ঢাকার নিকটবর্তী একাধিক শহরে। এ সম্মেলনের উদ্বোধক ছিলেন মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ। সম্মেলন খুবই সফল ও উপভোগ্য হয়েছিল বিভিন্ন জেলা থেকে আগত ভাষাসংগ্রামীদের অভিজ্ঞতানির্ভর আলোচনায়। এ বিষয়ে বিশদ আলোচনায় না গিয়ে এটুকুই বলে কথা শেষ করি। অনেক টানাপড়েন সত্ত্বেও আমার ও কামাল লোহানীর যৌথ সম্পাদনায় পূর্বোক্ত স্মৃতিচারণার একটি সংকলন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
গুরুত্বপূর্ণ বিধায় পরের কথা আগে বলা হয়ে গেল। এ ঘটনার ইতি টানি কয়েক লাইনে। কামাল লোহানী তখন সবে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক। পূর্বোক্ত একুশে চেতনা পরিষদ মৃত বললেও চলে। একে সক্রিয় করে তোলা হয় প্রকৌশলী জিয়াউল হক প্রমুখ কয়েকজনের আগ্রহে। এবার আমি সংগঠনের সভাপতি, সহসভাপতি ডা. সাঈদ হায়দার এবং অনেকটা জোর করেই কামাল লোহানীকে পূর্ব পদে বহাল করা হয়। এতে যোগ দেন জামিল আখতার বীনু, শফিক খান, গোলাম শফিক প্রমুখ। লোহানীর কর্মতৎপরতায় বিভিন্ন জেলা থেকে আগত ভাষাসংগ্রামীদের নিয়ে পর পর কয়েক বছর কয়েকটি ভাষাসংগ্রামী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় শিল্পকলা একাডেমিতে, যথেষ্ট উদ্দীপনা নিয়ে।
স্থানাভাব, তাই সংক্ষেপে পূর্বকথা বলি, উনসত্তরের গণজাগরণেও কামাল লোহানীর সাংস্কৃতিক ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এরপর মুক্তিযুদ্ধ উপলক্ষে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তাঁর যোগদান বার্তা সম্পাদক হিসেবে। যুদ্ধশেষে কিছুকাল তাঁর সরকার সংশ্লিষ্ট কার্যে ভূমিকা—অতঃপর বিচ্ছিন্নতা মতাদর্শগত কারণে। এ পর্বেও স্থবির ছিলেন না কামাল লোহানী। সোমেন স্মৃতিতে গঠিত সংগঠনের মতো একাধিক সাংস্কৃতিক সংগঠনে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা লক্ষণীয়। নানা রকম অসুস্থতার মধ্যেও চলছে কলাম লেখা, মূলত রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগদান অব্যাহত।
এককথায় একটি সক্রিয় রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জীবন যাপন করে গেলেন বহুজনকথিত ‘সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব’ কামাল লোহানী। ভাষাসংগ্রামীদের তালিকা প্রণয়ন ও গ্রন্থ প্রকাশে ছিল তাঁর প্রবল আগ্রহ। কিন্তু একুশে চেতনা পরিষদের মতো একটি অর্থনৈতিক অসচ্ছল সংগঠনের পক্ষে এ কাজ অসম্ভবই ছিল। শেষ কয়েক বছরে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ কমে এলেও প্রায়ই রাতে ফোন কুশল সংবাদ জানতে এবং যথারীতি নতুন কর্মপরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা। সংস্কৃতি ভুবনের একটি কর্মময় তাৎপর্যপূর্ণ সময় পর্ব শেষ হলো কামাল লোহানীর জীবনাবসানে।
লেখক : কবি, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী