দুয়ারে নতুন বছর। বিভিন্ন কারণে ২০২০ সাল মহাকালের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি, মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া, মৃত্যুর মিছিল, ভ্যাকসিনের প্রত্যাশা ইত্যাদি এ বছর ছিল আলোচিত বিষয়। বিশে বিষময় এমন একটি বছরে করোনা ভাইরাস ছাড়াও বেশ কিছু ঘটনা আলোচিত-সমালোচিত হয়েছে বছরের বিভিন্ন সময়। আমাদের অর্জন, হতাশা, বেদনা, প্রাপ্তি, প্রত্যাশা পূরণের সেই ঘটনাগুলো আরেকবার দেখে নিতেই এই আয়োজন। এই পর্বে থাকছে আলোচিত-সমালোচিত জাতীয় কিছু বিষয়। গ্রন্থনা ও সম্পাদনা করেছেন ফয়জুল আল আমীন
মুজিববর্ষ
করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে কর্মসূচিগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব না হওয়ায় মুজিববর্ষের মেয়াদ বাড়িয়েছে সরকার। এ বিষয়ে গেজেট প্রকাশ করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। তাতে বলা হয়েছে, স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের লক্ষ্যে সরকার ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ সময়কে মুজিববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করে। মুজিববর্ষ উদযাপনের লক্ষ্যে গৃহীত কর্মসূচিগুলো কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারির কারণে নির্ধারিত সময়ে যথযাথভাবে করা সম্ভব হয়নি। সে কারণে সরকার মুজিববর্ষের সময়কাল ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত ঘোষণা করল।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। কালক্রমে তার হাত ধরেই ১৯৭১ সালে বিশ্ব মানচিত্রে নতুন দেশ হিসেবে স্থান করে নেয় বাংলাদেশ। ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মের শত বছর পূর্ণ হয়েছে। আগামী বছরের ২৬ মার্চ বাংলাদেশ উদযাপন করবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। জাতির জনকের জন্মশতবর্ষ উদযাপনে ২০১৮ সালের জুলাইয়ে সরকার ২০২০-২০২১ সালকে ‘মুজিববর্ষ’ ঘোষণা করে। গত ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিবসে মুজিববর্ষের লোগো উন্মোচনের পাশাপাশি ক্ষণ গণনার মাধ্যমে মুজিববর্ষের আয়োজন শুরু হয়।
এরপর সব পরিকল্পনামাফিক এগোতে থাকে। ১৭ মার্চ বর্ণাঢ্য আয়োজনে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ঘটা করে উদযাপন করবে- এমনই ছিল পরিকল্পনা। কিন্তু ফেব্রুয়ারির মধ্যেই বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে ওই কর্মসূচি স্থগিত করা হয়। জনসমাগম এড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর উদ্বোধন অনুষ্ঠান ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মক্ষণ রাত ৮টায় দেশের সব টেলিভিশন চ্যানেল, অনলাইন ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে একযোগে সম্প্রচার করা হয়। ‘মুক্তির মহানায়ক’ শিরোনামের অনুষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত সম্প্রচারের পর রাষ্ট্রপতির বাণী, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ, বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানার অনুভূতি প্রকাশ ও তার লেখা কবিতা প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে পাঠ, বিভিন্ন দেশ ও সংস্থাপ্রধানদের ভিডিও বার্তা প্রচার করা হয়। সেই আয়োজনের পর জাতির জনকের জন্মদিনের সব অনুষ্ঠান ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে উদযাপনের সিদ্ধান্ত হয়।
বঙ্গবন্ধুকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের ৭৭টি দূতাবাসে ২৬০টিরও বেশি অনুষ্ঠানের আয়োজনের পরিকল্পনা ছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। সেগুলোও করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির উত্তরণের অপেক্ষায় রয়েছে।
ভাস্কর্যের বিরোধীতা
২০২০ সালের শেষের দিকে হঠাৎ করেই রাজধানীতে একটি সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধ গোষ্ঠী প্রকাশ্যে সভা করে জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে জাতির পিতার একটি ভাস্কর্য নির্মাণের পরিকল্পনার বিরোধীতা শুরু করে। এমনকি ভাস্কর্য নির্মাণ করা হলে তা ভেঙে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়ার ভয়ানক দম্ভোক্তিও করে। অথচ ভাস্কর্য ও মূর্তির মধ্যে পার্থক্য সবাই জানে।
ভাস্কর্য শহরের সৌন্দর্য বর্ধন ও জাতীয় হেরিটেজ রক্ষার জন্য তৈরি করা হয়। মূর্তি বা প্রতিমা তৈরি করা হয় পূজা করার জন্য। পৃথিবীর অনেক মুসলিম দেশেই সেই দেশের জাতীয় নেতা ও বীরদের ভাস্কর্য আছে। ভাস্কর্য নির্মাণের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক বা বিরোধ নেই। হাজার বছরের মুসলিম সভ্যতার দিকে আমরা তাকালেই দেখব ইউরোপ, এশিয়া, আরব এবং আফ্রিকার দেশগুলোতে ইসলামি সংস্কৃতির নানা উপস্থাপনের মধ্যে ভাস্কর্য অন্যতম প্রধান হিসেবে স্থান করে আছে।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে মহান রাব্বুল আলামীন এরশাদ করেন, ‘তারা সুলায়মানের ইচ্ছানুযায়ী উপাসনালয় ও দুর্গ, ভাস্কর্য, হাউজসদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং চুল্লির উপর স্থাপিত বিশাল ডেগ নির্মাণ করত। হে দাউদ পরিবার! (এসব নেয়ামতের জন্য) কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। (যদিও) আমার বান্দাদের মধ্যে অল্পসংখ্যকই কৃতজ্ঞ।’ ( সুরা সাবা: আয়াত-১৩)
- আরও পড়ুন >> ফিরে দেখা ২০২০: বিশ্বের ক্ষমতাধর যত নারী
এ আয়াত থেকে জানা গেল, খনিজ সম্পদ ও ধাতব পদার্থ দিয়ে নানা ধরনের শিল্পসামগ্রী তৈরির কৌশল আল্লাহ তায়ালাই তার কোনো কোনো নবী-রাসুলকে শিক্ষা দিয়েছিলেন যাতে ধীরে ধীরে মানব সভ্যতা পূর্ণতা লাভ করতে পারে। আর এমন বাস্তবতায় ডিজিটাল যুগে ভাস্কর্যের বিরোধীতা করা মুর্খতা ছাড়া আর কিছু নয়।
রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর শুরু
কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় থাকা ১২ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে গত ৪ ডিসেম্বর ১ হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গাকে নোয়াখালী সংলগ্ন দ্বীপ ভাসানচরে নেওয়া হয়। ২৯ ডিসেম্বর দ্বিতীয় দফায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অত্যাধুনিক জাহাজে করে প্রায় ১ হাজার ৮০০ রোহিঙ্গাকে নিয়ে যাওয়া হয় ভাসানচর। এ সময় নানা বয়সী এসব মিয়ানমারের নাগরিকের চোখে মুখে খেলা করছিল নতুন স্বপ্ন। তাদের পরনে ছিল লাইফ জ্যাকেট। নদীতে ছিল নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, র্যাব, নৌ পুলিশের স্পিড বোটগুলোর টহল, কড়া নজরদারি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর লাখ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। নতুন পুরনো মিলে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা এখন বসবাস করছেন কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরে। প্রাথমিকভাবে সেখান থেকে এক লাখ রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর ভাসানচরে স্থানান্তরের উদ্যোগ নেয় সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের মে মাসে সাগর পথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় বঙ্গোপসাগরে ভাসমান অবস্থা থেকে উদ্ধার করে ৩০৬ জন রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে আশ্রয় দেওয়া হয়। এরপর গত ৪ ডিসেম্বর আরও এক হাজার ৬৪২ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হয়।
- আরও পড়ুন >> ফিরে দেখা ২০২০: বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি
ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তরের জন্য নিজস্ব তহবিল থেকে ৩ হাজার ৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে সরকার। সেখানে এক লাখ রোহিঙ্গা বসবাসের উপযোগী ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়। যেখানে রয়েছে- শিশুদের খেলার মাঠ, স্কুল, চিকিৎসা কেন্দ্র, দ্বীপে কর্মরত দেশি-বিদেশি সংস্থার লোকজনের জন্য থাকার আলাদা ভবনসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা। এ ছাড়া জোয়ার-জলোচ্ছ্বাস থেকে সেখানকার ৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা রক্ষা করতে ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ১৯ ফুট উঁচু বাঁধ এবং জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের জন্য ভবন ও জেটি নির্মাণ করা হয়েছে ভাসানচরে।
র্যাব-পুলিশের অভিযান
করোনা ভাইরাস মহামারীর বছর ২০২০ সালে সবকিছু প্রায় সবকিছু থমকে থাকলেও সক্রিয় ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। করোনা চিকিৎসা ও সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ নিয়ে প্রতারণার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ছিল তাদের। এ বছর অপরাধ ও অনিয়মে জড়িত থাকায় সরকারি দলের এমপি থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালী বিভিন্ন ব্যক্তির বাড়ি এবং প্রতিষ্ঠানে একাধিক অভিযান হয়েছে। বছরজুড়ে এমন নয়টি অভিযান ছিল ব্যাপক আলোচনায়।
বছরের শুরুতে সবচেয়ে আলোচিত ছিল ক্যাসিনোকাণ্ডের হোতা গেণ্ডারিয়ার আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক এনু ও রুপন ভূঁইয়াকে সিআইডি’র গ্রেফতার অভিযান। এরপরেই দেশজুড়ে আলোচনায় আসে র্যাবের হাতে আটক যুবলীগ নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়ার নানা অপকর্ম। আলোচিত এই দুই অভিযানের পর পরই শুরু হয় করোনা ভাইরাসের প্রকোপ। মার্চে দেয়া হয় লকডাউন। এ সময় আলোচনায় আসে রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মো. সাহেদ ও জেকেজি হেলথ কেয়ারের চেয়ারম্যান সাবরিনা আরিফ চৌধুরীর করোনার নমুনা সংগ্রহ করে ভুয়া রিপোর্ট দেয়ার বিষয়টি। আলোচনায় ছিলেন নকল এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহের অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার শারমিন জাহানও। এরপর আলোচিত হয় হাজী সেলিমের পুরান ঢাকার ‘চাঁন সরদার দাদা বাড়ী’তে র্যাবের অভিযান ও তার কাউন্সিলর পুত্র ইরফান সেলিমকে আটকের বিষয়টি। নবাব পরিবারের সন্তান পরিচয়ে প্রতারণার অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া নবাব খাজা আলী হাসান আসকারীকে নিয়েও ছিল আলোচনা। বছরের শেষ দিকে নভেম্বরে গামছা বিক্রেতা থেকে জমি ব্যবসার ‘মাফিয়া’ হয়ে ওঠা গোল্ডেন মনিরের বাসায় র্যাবের অভিযান ছিল আলোচনার কেন্দ্রে। এর বাইরে সাদিয়া জান্নাত ওরফে জান্নাতুল ফেরদৌসের ‘পাত্র চাই’ বিজ্ঞাপন দিয়ে ৩০ কোটিরও বেশি টাকা হাতিয়ে নেয়া হতবাক করেছিল সবাইকে।
ক্যাসিনোকাণ্ডের এনু ও রুপন গ্রেফতার: ১৩ জানুয়ারি ক্যাসিনোকাণ্ডের হোতা গেণ্ডারিয়ার আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক এনু ও রুপন ভূঁইয়াকে গ্রেফতার করে সিআইডি। গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে নগদ ৪০ লাখ টাকা ও ১২টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। ছোট লোহা-লক্কড়ের দোকানি থেকে বিপুল অর্থের মালিক হয়েছিলেন তারা। জিজ্ঞাসাবাদে তারা নিজেদের ১২০টি বাড়ি আছে বলে তথ্য দিয়েছে।
পাপিয়ার ১২৯ দিনের হোটেল বিল ৩ কোটি ২৩ লাখ টাকা: বছরের শুরুর দিকে আলোচনার কেন্দ্রে ছিল যুবলীগ নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়ার (২৮) গ্রেফতার। ২২ ফেব্রুয়ারি প্রতারণা, অবৈধ অর্থ পাচার, জাল টাকা সরবরাহ, মাদক ব্যবসা ও অনৈতিক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে পাপিয়াকে গ্রেফতার করে র্যাব। টানা ৪ মাস ৯ দিন গুলশানের একটি পাঁচ তারকা হোটেলের চারটি কক্ষ (একটি প্রেসিডেনশিয়াল স্যুটসহ) ভাড়া নিয়েছিলেন শামীমা নূর পাপিয়া। ২০১৯ সালের ১৩ অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হোটেলটির কক্ষ ভাড়া, খাবার, আনুষঙ্গিক খরচসহ তিনি মোট বিল পরিশোধ করেছেন ৩ কোটি ২৩ লাখ টাকা। প্রতিদিন হোটেলের বিল বাবদ গড়ে খরচ করেছেন আড়াই লাখ টাকা।
- আরও পড়ুন >> ফিরে দেখা ২০২০: বিশ্বে আলোচিত যেসব ঘটনা
রিজেন্ট হাসপাতালের সাহেদ গ্রেফতার: করোনার ভুয়া পরীক্ষা করে দেশজুড়ে আলোচনায় ছিলেন রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ। ৬ জুলাই সীমাহীন অনিয়ম ও অপকর্মের অভিযোগের ভিত্তিতে উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান চালায় র্যাব। পরদিন অভিযান চলে হাসপাতালের মিরপুর শাখায়। এরপর থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে সাহেদের চাঞ্চল্যকর সব প্রতারণার তথ্য। জানা যায়, অন্তত ছয় হাজার নমুনা কোনো পরীক্ষা না করেই করোনাভাইরাসের মনগড়া পজিটিভ-নেগেটিভ রিপোর্ট দিয়েছিলেন তিনি। হাসপাতালটির ছিল না কোনো অনুমোদন। এছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছিলেন সাহেদ।
করোনার নমুনা সংগ্রহ করে ড্রেনে ফেলত জেকেজি: করোনা ভাইরাস টেস্টের নামে প্রতারণার অভিযোগে ২৩ জুন জেকেজি হেলথ কেয়ারের চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরীর স্বামী আরিফ চৌধুরীসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করে তেজগাঁও থানা পুলিশ। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। কর্মচারী হুমায়ুন কবির ও তার স্ত্রী তানজিনা পাটোয়ারী জানান, করোনার নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা না করে ড্রেনে ফেলে দিত জেকেজি। এভাবে তারা হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা।
মাস্ক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে গ্রেফতার ঢাবির সহকারী রেজিস্ট্রার: বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) নকল এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহের ঘটনা। এ ঘটনায় ২৪ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারি রেজিস্ট্রার শারমিন জাহানকে গ্রেফতার করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিলেন, অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী শারমিনের সরবরাহ করা এক হাজার ৭০০ মাস্কের মধ্যে নকল মানহীন মাস্ক পাওয়া যায়।
- আরও পড়ুন >> ফিরে দেখা ২০২০: হলিউড ও বলিউডের আলোচিত যেসব ঘটনা
হাজী সেলিমের বাসায় র্যাবের অভিযান: চলতি বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা ছিল পুরান ঢাকার দাপুটে নেতা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এমপি হাজী সেলিমের বাসায় র্যাবের অভিযান। ২৫ অক্টোবর সন্ধ্যার পর রাজধানীর কলাবাগান ক্রসিংয়ের কাছে মারধরের শিকার হন নৌ বাহিনীর কর্মকর্তা ওয়াসিফ আহমেদ খান। তার মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দিয়েছিল সংসদ সদস্যের স্টিকার লাগানো একটি গাড়ি। এরপর গাড়ি থেকে নেমে কয়েক ব্যক্তি ওই কর্মকর্তাকে বেদম প্রহার করেন ও তার স্ত্রীকে নাজেহাল করেন। এ ঘটনায় ধানমণ্ডি থানায় হত্যাচেষ্টার মামলার পর ২৬ অক্টোবর পুরান ঢাকার চকবাজারে হাজী সেলিমের রাজসিক প্রাসাদ ‘চাঁন সরদার দাদা বাড়ী’তে দিনভর অভিযান চালায় র্যাব। এ সময় র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিমকে মাদক রাখার দায়ে এক বছর ও অবৈধ ওয়াকিটকি রাখার কারণে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন। চকবাজার থানায় অস্ত্র ও মাদক আইনে আরও চারটি মামলা হয়। কয়েক দফায় রিমান্ডে নেয়া হয় তাদের। এসব ঘটনার পর হাজী সেলিমের পুরান ঢাকার সাম্রাজ্য ওলটপালট হতে শুরু করে।
নবাব পরিবারের সন্তান পরিচয়ে প্রতারণা: ২৮ অক্টোবর নবাব পরিবারের সন্তান পরিচয়ে প্রতারণার অভিযোগে নবাব খাজা আলী হাসান আসকারীকে (৪৮) পাঁচ সহযোগীসহ গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফুপু পরিচয় দিতেন তিনি। আরও বলতেন, দুবাইয়ে তার গোল্ডের কারখানা রয়েছে। বাবা ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, থাকেন নিউইয়র্কে। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের মালিকানায় অংশীদারিত্ব রয়েছে তাদের। বাবার কোটি কোটি টাকার ব্যবসা পরিচালনা করেন তিনি নিজেই। চলেন বডিগার্ড নিয়ে। নিজে থাকেন নেদারল্যান্ডসে। এরকম আরও অনেক ভুয়া পরিচয় ছিল তার। এসব পরিচয় দিয়ে ভয়ঙ্কর এ প্রতারক সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা।
‘পাত্র চাই’ বিজ্ঞাপন দিয়ে ৩০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া সাদিয়া গ্রেফতার: বছরের আলোচিত প্রতারণাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ‘পাত্র চাই’ বিজ্ঞাপন দিয়ে ৩০ কোটিরও বেশি টাকা হাতিয়ে নেয়া। অবশেষে প্রতারক সাদিয়া জান্নাত ওরফে জান্নাতুল ফেরদৌসকে গ্রেফতার করা হয়। ১৮ সেপ্টেম্বর তাকে গ্রেফতারের খবর জানায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
তারা জানায়, আমেরিকা-কানাডার সিটিজেন, প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী- এমন পরিচয়ে পত্রিকায় পাত্র চেয়ে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন সাদিয়া। নিজেকে ‘নামাজি পাত্রী’ ও ‘ডিভোর্সি’ পরিচয়ে কানাডায় ২০০ কোটি টাকার ব্যবসা দেখভালের জন্য পাত্র চেয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতেন তিনি।
গোল্ডেন মনিরের বাসায় র্যাবের অভিযান: ২১ নভেম্বর রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় স্বর্ণ ব্যবসায়ী মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনিরের বাসায় অভিযান চালায় র্যাব। ওই বাড়ি থেকে ৯ লাখ টাকা মূল্যমানের বিদেশি মুদ্রাসহ ১ কোটি ৯ লাখ টাকা, চার লিটার মদ, ৮ কেজি স্বর্ণ, একটি বিদেশি পিস্তল ও কয়েক রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে র্যাব। গামছা বিক্রেতা থেকে জমির ব্যবসার ‘মাফিয়া’ হয়ে ওঠা মনিরের বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক হওয়ার বিষয়টিও ওই অভিযানের পর সামনে আসে।
গণপূর্ত ও রাজউকের সঙ্গে তিনি সখ্য গড়ে তোলেন এক মন্ত্রীর সঙ্গে। এরপর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। মনির ঢাকা ও আশপাশে ২০ বছরে ২ শতাধিক প্লট-ফ্ল্যাটের মালিক হন। তিনি প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ৩৫টি প্লটের কথা স্বীকার করেন।