প্রথম ওয়ানডেতে জিম্বাবুয়ে পাত্তাই পায়নি। দ্বিতীয়টিতে দারুণ লড়াই করেছিল। তৃতীয় ম্যাচে বাংলাদেশের সামনে ২৯৯ রানের বড় লক্ষ্য ছুড়ে দিয়ে জয়ের স্বপ্নই দেখছিল স্বাগতিকরা। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। জিম্বাবুয়েকে স্বান্ত্বনার জয়ও পেতে দিল না তামিম ইকবালের দল। হারারেতে সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে বড় লক্ষ্য হেসেখেলেই পাড়ি দিয়েছে বাংলাদেশ, জিতেছে ৫ উইকেট আর ২ ওভার হাতে রেখে।
এই জয়ে ‘মিশন হোয়াইটওয়াশ’ও পূর্ণ করেছে টাইগাররা। ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে তাদের মাঠে হারানোর এক যুগ পর আবারও বিদেশের মাটিতে হোয়াইটওয়াশ করার কৃতিত্ব দেখাল তারা।
২৯৯ রানের বড় লক্ষ্য। শুরুটা যেমন ভালো হওয়া চাই, তেমনই দিলেন দুই ওপেনার তামিম ইকবাল আর লিটন দাস। প্রথমে দেখেশুনে খেললেও (৬ ওভারে ২৬ রান) পরে আস্তে আস্তে রানের গতি বাড়িয়েছেন এই যুগল।
ওভারপ্রতি ছয়ের ওপর নিয়ে দলকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন তারা। এরই মধ্যে তামিম তুলে নেন ক্যারিয়ারের ৫২তম হাফসেঞ্চুরি, ৪৬ বলে। কিন্তু তামিমের ফিফটি ছোঁয়া ওভারেই উইকেট হারিয়ে বসেন লিটন।
ওয়েসলে মাদভেরে নিজের প্রথম ওভার করতে এসেই সাজঘরে ফিরিয়েছেন লিটনকে, তাতে ভাঙে ৮৮ রানের উদ্বোধনী জুটি। সুইপ খেলতে গিয়ে ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগে ক্যাচ হন এই ওপেনার। ৩৭ বলে ৩ বাউন্ডারিতে করেন ৩২ রান।
তারপর সাকিব আল হাসানের সঙ্গে ৬৯ রানের আরেকটি জুটি তামিমের। সেই জুুটিটি ভেঙেছেন লুক জঙউই। জিম্বাবুইয়ান পেসারের স্লোয়ার এক ডেলিভারিতে ব্যাট চালিয়ে উইকেটরক্ষকের ক্যাচ সাকিব। ৪২ বলে একটি করে চার-ছক্কায় বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের ব্যাট থেকে আসে ৩০ রান।
৩৪ ওভার শেষে ২ উইকেটে ২০৪ রান ছিল বাংলাদেশের। ৯৬ বলে দরকার ৯৫। পানি পানের বিরতিতে যাওয়ার সময় সহজ জয়ের পথেই ছিল টাইগাররা।
কিন্তু বিরতির পরই জোড়া আঘাত ডোনাল্ড তিরিপানোর। টানা দুই বলে সেঞ্চুরিয়ান তামিম আর অভিজ্ঞ মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে ফিরিয়ে জিম্বাবুয়েকে লড়াইয়ে ফেরান ডানহাতি এই পেসার।
৯৭ বলে ৮ চার আর ৩ ছক্কায় ১১২ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলা তামিম উইকেটরক্ষকের ক্যাচ হওয়ার পর প্রায় একইভাবে আউট হন মাহমুদউল্লাহ (০)। হ্যাটট্রিক বল খেলতে উইকেটে আসেন সিরিজে প্রথমবারের মতো একাদশে সুযোগ পাওয়া নুরুল হাসান সোহান।
সোহান অবশ্য ওই বলটিতে একটুও নার্ভাস হননি। বরং বাউন্ডারিতে দূর করেন হ্যাটট্রিকের শঙ্কা। চোখ ধাঁধানো কিছু শট খেলে দলকে এগিয়ে নিয়েছেন এরপরও।
পঞ্চম উইকেটে মিঠুনের সঙ্গে গড়েন ৫৪ বলে ৬৪ রানের জুটি। যাতে মূল অবদান সোহানেরই (৩৯)। মিঠুন খেলেছেন ভীষণ ধীরগতিতে। একের পর এক শট খেলতে গিয়ে মিস করেছেন। একদমই আত্মবিশ্বাসহীন মনে হচ্ছিল তাকে।
শেষ পর্যন্ত নিজেই যেন নিজের ওপর বিরক্ত হয়ে যান মিঠুন। জিম্বাবুইয়ান স্পিনার মাদভেরেকে বড় শট খেলতে ডাউন দ্য উইকেটে এসেছিলেন, এবারও ঠিকমত ব্যাটে বলে করতে পারেননি। লংঅফে ক্যাচ হয়েছেন চাতারার।
তবে এরপর আর দলকে কোনো বিপদে পড়তে দেননি সোহান-আফিফ। ৩৪ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটিতে বিজয়ীর বেশেই মাঠ ছেড়েছেন তারা। সোহান ৩৯ বলে ৬ বাউন্ডারিতে ৪৫ আর আফিফ হোসেন ধ্রুব ১৭ বলে ৩ চার, এক ছক্কায় ২৬ রানে অপরাজিত থাকেন।
এর আগে ২৯৮ রানের বড় সংগ্রহ দাঁড় করায় জিম্বাবুয়ে। রেগিস চাকাভা ওপেনিংয়ে নেমে ৮৪ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলে দিয়েছেন। তারপরও অনেকটা সময় জিম্বাবুয়ের ব্যাটিং লাইনআপকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন বাংলাদেশি বোলাররা।
সেই নিয়ন্ত্রণ ছুটে যায় সিকান্দার রাজা আর রায়ান বার্লের এক জুটিতে। ষষ্ঠ উইকেটে ঝড়ো গতিতে ৮০ বলে ১১২ রান যোগ করেন এই যুগল। যাতে ভর করেই প্রায় তিনশোর কাছাকাছি স্কোর দাঁড় করিয়েছে স্বাগতিকরা।
তবে শেষদিকে মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন (৩/৮৭) আর মোস্তাফিজুর রহমানের (৩/৫৭) ঝলকে বেশ কয়েকটি উইকেট তুলে নেয় বাংলাদেশ। তাতেই ইনিংসের ৩ বল বাকি থাকতে জিম্বাবুয়ে অলআউট হয়েছে ২৯৮ রানে।
হারারে স্পোর্টস ক্লাব মাঠে টস জিতে জিম্বাবুয়েকে ব্যাটিংয়ে পাঠায় বাংলাদেশ। চলতি সিরিজের প্রথম ম্যাচটিতে পাঁচ নম্বরে নেমে দলের পক্ষে একমাত্র ফিফটি করেছিলেন রেগিস চাকাভা। দ্বিতীয় ম্যাচে তাকে নামানো হয় তিন নম্বরে। আর আজ প্রমোশন পেয়ে ইনিংস সূচনার দায়িত্বই বর্তায় এ উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যানের কাঁধে।
ওপেনিংয়ে নেমে প্রথম ওভারটা দেখেশুনেই খেলেন চাকাভা। তবে সাইফউদ্দিনের করা দ্বিতীয় ওভারে আত্মবিশ্বাসী শটে জোড়া বাউন্ডারি হাঁকান তিনি। এরপর মোস্তাফিজুর রহমান ও তাসকিন আহমেদের বিপক্ষেও সাবলীল ব্যাটিং করেন তিনি। যার সুবাদে জিম্বাবুয়ের শুরুটাও হয়েছিল বেশ ভালো। প্রথম ৮ ওভারে কোনো সাফল্য পায়নি বাংলাদেশ।
মনে হচ্ছিল, প্রায় তিন বছর পর প্রথম উইকেটে ৫০ রানের জুটি গড়তে পারবে জিম্বাবুয়ে। কিন্তু নবম ওভারে আক্রমণে এসে তা আর হতে দেননি সাকিব আল হাসান। বাঁহাতি ওপেনার তাদিওয়ানাশে মারুমানিকে ফিরিয়ে বাংলাদেশকে এনে দেন প্রথম সাফল্য।
শুরু থেকেই ইতিবাচক ব্যাটিং করছিলেন চাকাভা। অপরপ্রান্তে মারুমানি ছিলেন খানিক নড়বড়ে। যার ফায়দাই নিয়েছেন সাকিব। তিনি হালকা ঝুলিয়ে দেয়া ডেলিভারিতে সুইপ শটে প্রলুব্ধ করেন মারুমানিকে। আর সেই ফাঁদে পা দিয়ে লেগ বিফোর আউট হয়েছেন জিম্বাবুইয়ান বাঁহাতি ওপেনার।
আউট হওয়ার আগে খেলা ১৯ বলে ৮ রান করতে পেরেছেন মারুমানি। এরপর যখন মনে হচ্ছিল প্রাথমিক চাপ সামাল দিয়ে ফেলেছেন চাকাভা ও টেলর, তখনই আঘাত হানেন মাহমুদউল্লাহ।
দ্বিতীয় উইকেটে ৯ ওভারে চাকাভা-টেলর তুলেন ৪২ রান। টেলরকে (২৮) তামিম ইকবালের ক্যাচ বানিয়ে এই জুটিটি ভাঙেন ক্যারিয়ারের দুইশতম ম্যাচ খেলতে নামা মাহমুদউল্লাহ।
এরপর ডিয়ন মায়ার্সকে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেন চাকাভা। তৃতীয় উইকেটে তাদের ৭১ রানের জুটিটিও ভাঙেন মাহমুদউল্লাহ। ৩৪ রান করা মায়ার্সকে করেন বোল্ড।
বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি ওয়েসলে মাদভেরে (৩)। মোস্তাফিজুর রহমানের স্লোয়ার বুঝতে না পেরে ব্যাট পেতে দিয়ে মিডউইকেটে সাকিবের ক্যাচ হন তিনি।
এর তিন ওভার পর পথের কাঁটা চাকাভাকে সাজঘরের পথ দেখিয়ে বাংলাদেশ শিবিরে হাসি ফোটান তাসকিন আহমেদ। সেঞ্চুরির কাছাকাছি এসে তাসকিনের দারুণ এক ডেলিভারি ফ্লিক করতে গিয়ে লাইন মিস করে বসেন চাকাভা, ওপরে যায় অফস্ট্যাম্প। ৯১ বলে ৭ বাউন্ডারি আর ১ ছক্কায় তিনি তখন ৮৪ রানে।
১৭২ রানে ৫ উইকেট হারানো জিম্বাবুয়ে আরও একবার অল্পতেই আটকে যাবে, মনে হচ্ছিল তখন। কিন্তু ষষ্ঠ উইকেটে সব হিসেব বদলে দেন রাজা আর বার্ল। চার-ছক্কায় মাঠ মাতিয়ে দলকে এগিয়ে নেন তারা অনেকদূর।
শেষ পর্যন্ত ৪৮তম ওভারে এসে ১২০ রানের জুটিটি ভাঙেন মোস্তাফিজ। কাটার মাস্টারের সুইংয়ে পরাস্ত হয়ে ক্যাচ তুলে দেন ৫৪ বলে ৭ চার আর ১ ছক্কায় ৫৭ রান করা রাজা।
৪৯তম ওভারে মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন তুলে নেন সফরকারি দলের তিন-তিনটি উইকেট। তাতেই জিম্বাবুয়ের তিনশো ছোঁয়া সম্ভব হয়নি।
ওভারের দ্বিতীয় বলে রায়ান বার্লকে (৪৩ বলে ৪টি করে চার-ছক্কায় ৫৯) ক্যাচ আর তৃতীয় বলে ডোনাল্ড তিরিপানোকে (০) বোল্ড করে হ্যাটট্রিকের সম্ভাবনা জাগিয়েছিলেন সাইফউদ্দিন। সেটা না হলেও ওভারের শেষ বলে তেন্দাই চাতারাকে (১) বোল্ড করেন এই পেসার। পরের ওভারের তৃতীয় বলে ব্লেসিং মুজারবানিকে (০) বোল্ড করে জিম্বাবুয়েকে তিনশোর আগে আটকান মোস্তাফিজ।