ইসি আইনে রাজনৈতিক ঐক্যের আলো ফুটছে?

হাসান শান্তনু

নির্বাচন কমিশন
ফাইল ছবি

নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে প্রস্তাবিত খসড়া ‘না পড়ে, না দেখে’ ওই আইন সম্পর্কে ‘নেতিবাচক’ মন্তব্য করছে সরকারবিরোধি কয়েকটি রাজনৈতিক দল। সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত তাদের মন্তব্য আমলে নিতে রাজি নন দেশের আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। তারা মনে করেন, কোনো সম্ভাব্য আইনের খসড়া ‘না পড়ে’ এ বিষয়ে মন্তব্য করার সুযোগ নেই, উচিতও নয়। আইনের খসড়া না দেখে এর ‘বিরোধিতা করা বিরোধিতার জন্য বিরোধিতার শামিল’!

বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ইসি গঠনে আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদনের বিষয়টি ইতিবাচক। একে স্বাগত জানানো ছাড়া অন্য কিছু ভাবনার দরকার এ মুহূর্তে নেই। এর মধ্য দিয়ে ইসি গঠনে সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী অবশেষে আইন প্রণয়ন হতে যাচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পঞ্চাশ বছর পর। আইনটি ছাড়া গত কয়েক যুগের রাজনৈতিক বিরোধ মেটার পথ তৈরির আভাস মিলছিল না। এতো বছরের মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের সরকার প্রথম আইনটি প্রণয়নের উদ্যেগ নেয়। সেজন্য দলটি ও এর নেতৃত্বের সরকারের সাধুবাদ প্রাপ্য।

রাষ্ট্রপতির সঙ্গে অনুষ্ঠিত সংলাপে দেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের দাবি ছিল ইসি গঠনে আইন প্রণয়নের। দলগুলোর দাবি অনুযায়ী আইন হচ্ছে। আইন প্রণয়নের উদ্যোগ কেন্দ্র করে অনেকদিন পর রাজনৈতিক দল, বিশেষজ্ঞ, বিশ্লেষক, সুশীল সমাজ ও বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্যে মতামতের ঐক্য দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক ঐক্যের আলো ফুটছে। এটাকে ধরে রেখে গণতন্ত্র চর্চা ও পরবর্তী সংসদ নির্বাচন কীভাবে নিরপেক্ষ করা যায়, সেসব দিকে লক্ষ্য রেখে সরকার ও সরকারি দলসহ সব দলকে দায়িত্বশীল হতে হবে।

বিশিষ্ট নাগরিকরা মনে করেন, নতুন আইন প্রণয়নের আগে সময় পেলে সংশ্লিষ্টদের মতামত নেওয়া যেতে পারে। যেমন, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, রাজনৈতিক দলের অভিজ্ঞ, প্রবীণ ও শীর্ষনেতাদের পরামর্শ ও মত। তবে সময় স্বল্পতার বিষয়টিও সবাইকে বিবেচনায় রাখতে হবে। কারণ, আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারির আগেই আইন প্রণয়ন করে ইসি গঠনের বাধ্যবাধকতা আছে। আইনটি যেন একপেশে না হয়, সেটিও খেয়াল রাখতে হবে। সরকারবিরোধি রাজনৈতিক দলগুলোরও ‘সরকারের সবকিছুর বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতার সংস্কৃতি’ বাদ দিতে হবে।

সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ও গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন এ প্রসঙ্গে মত ও পথকে বলেন, ‘সংবিধানে বলা আছে, ইসি গঠনে আইন প্রণয়নের কথা।স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের মধ্যে তা হয়নি, যা অবশ্যই দু:খজনক। এ সরকার আইনটি করতে যাচ্ছে, এটি প্রশংসাজনক। আইনে কী আছে, থাকছে- সেগুলো না দেখে কেউ মন্তব্য করা ঠিক হবে না।’

‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের’ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ইসি আইন প্রণয়নের পথে অনেকটা আকস্মিকভাবে সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা ইতিবাচক। নিবন্ধিত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির আলোচনা শুরুর আগে থেকে নাগরিক সমাজ আইন প্রণয়নের তাগিদ দেয়।’ ‘জনগণের প্রত্যাশা’ গুরুত্ব দিয়ে নাগরিক সমাজ, অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে খসড়া চূড়ান্ত করে আইন প্রণয়নের দাবি জানান তিনি।

গত সোমবারে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন-২০২২’ এর খসড়া অনুমোদন পায়। এরপর রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান সাংবাদিকদের এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘নতুন আইনের উদ্যোগ- যেই লাউ সেই কদু’। এ প্রসঙ্গে আজ বুধবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষিত আইন প্রণয়নের মহৎ উদ্যোগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করতে বিএনপির নেতারা বিভ্রান্তিকর মন্তব্য করছেন। তাঁরা অপপ্রচার চালাচ্ছেন।’

তিনি বলেন, ‘বিএনপির নেতারাসহ একটি চিহ্নিত মহল ইসি গঠনের আইন প্রশ্নবিদ্ধ করতে তাঁদের চিরাচরিত অপপ্রচার, মিথ্যাচারের অপরাজনীতিতে লিপ্ত হয়েছেন। দেশের বিশিষ্টজন ও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধানের নির্দেশনা মেনে নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন।’ তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেন, “আইনের খসড়া না পড়েই বিএনপি নেতাদের মন্তব্য তাঁদের রাজনীতির অন্তঃসারশূন্যতা এবং সবকিছুতে ‘না’ বলার বাতিকেরই প্রমাণ।”

মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পাওয়া আইনের খসড়া সংক্রান্ত বিল আগামী ২৩ জানুয়ারি জাতীয় সংসদের চলতি অধিবেশনে উপস্থাপনের কথা রয়েছে। সংসদীয় রীতি অনুযায়ী খসড়া সংসদে উত্থাপনের পর আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পাঠানো হবে। সেখান থেকে সুপারিশ আকারে সংসদের বৈঠকে উঠবে। আলোচনার মধ্য দিয়ে আইন চূড়ান্ত হবে। সংসদে প্রধান বিরোধিদল জাতীয় পার্টির ও সরকারবিরোধি দল বিএনপির সংসদ সদস্যরা তখন আইনের বিষয়ে তাঁদের মতামত ও প্রস্তাব উপস্থাপনের সুযোগ পাবেন।

তথ্যমতে, ইসি গঠনে গত ২০ ডিসেম্বর থেকে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ শুরু হলে আইন প্রণয়নের দাবি জোরালো হয়ে উঠে। শুরুতে আওয়ামী লীগের কেউ কেউ বলেন- ‘আইনে প্রণয়নের সময় নেই’। দলীয় সিদ্ধান্তের আগে তারা এটা বলেন। পরে অবশ্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে অনুষ্ঠিত সংলাপে ইসি গঠনে আইন প্রণয়নের প্রস্তাব দেয় দলটি। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এ প্রসঙ্গে মত ও পথকে বলেন, ‘একদিনের মধ্যেও ইসি গঠনে আইন প্রণয়ন সম্ভব। অতীতে ইতিহাস আছে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আইন তৈরি হয়েছে। এমন কি সংসদে ষোড়শ সংশোধনীও একদিনে করা হয়।’

বিশ্লেষকদের মতে, ইসি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয় গত ২০ ডিসেম্বর জাতীয় পার্টির সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সংলাপের মধ্য দিয়ে। ১৭ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় আমন্ত্রিত দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সংলাপ। কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বের বর্তমান ইসির মেয়াদ আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি শেষ হচ্ছে। এর আগেই রাষ্ট্রপতিকে নতুন ইসি গঠন করতে হবে।

শেয়ার করুন