মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে ভারতের একটি সাংস্কৃতিক দলের সঙ্গে উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর ঢাকায় সফরে আসেন। তিনি ঢাকায় জাতির জনক, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেন। ওই বছর ঘটে আরেকটি ঘটনা। মাত্র চার লাইনের একটি গান, ১৯৬৫ সালে গাওয়া। গানটির শিল্পীকে এর পূর্ণ রূপ দিতে পরামর্শ দেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর সম্মানেই পরে গীতিকার ও শিল্পী মিলে গানটির পূর্ণ রূপ দেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে লতা মঙ্গেশকর আসেন ভারতীয় সাংস্কৃতিক দলের প্রতিনিধি হিসেবে। ওই সময় তিনি ঢাকার পিলখানা মাঠে গান করেন। তাঁকে এফডিসিতে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সাংস্কৃতিক দলটিতে অভিনেত্রী ওয়াহিদা রেহমান, অভিনেতা সুনীল দত্ত ও তাঁর ছেলে সঞ্জয় দত্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেন লতা এবং একই মঞ্চে পাশাপাশি বসেন তাঁরা।
দেখা করা সময় একটি ছবি তোলা হয়। যে ছবির ফ্রেমের ভেতরে একসঙ্গে রয়েছেন বঙ্গবন্ধু ও লতা। ওই ছবি গতকাল রোববার নতুন করে ছড়িয়ে পড়ে নেটমাধ্যমে। ব্যাপক ভাইরাল হয়। বাংলাদেশ, ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে থাকা বাংলাভাষীর কাছে।
সুনীল দত্তের ‘অজন্তা’ শিল্পীগোষ্ঠীর সঙ্গে লতার ওই সফর ছিল বলে এক টুইটে জানিয়েছে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন। ঢাকার স্মৃতি তিনি কোনোদিন ভুলে যাননি। এর স্মৃতিচারণায় তিনি একবার টুইটারে লেখেন, ‘তখন আমরা বিমান বাহিনীর প্লেনে করে যাতায়াত করতাম।’ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বিশ্বব্যাপী জনমত গঠন ও মুক্তিযুদ্ধে তহবিল সংগ্রহে ঘুরেন ভারতের বিভিন্ন শহরে।
লতা গান গেয়ে যে তহবিল সংগ্রহ করেন, সেই টাকা ব্যয় করা হয় বাংলাদেশ থেকে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের জন্য। শুধু মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নয়, বিজয়ের পরও তিনি গান গেয়েছেন বাংলাদেশের জন্য। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায় ‘রক্তাক্ত বাংলা’ সিনেমায় ১৯৭২ সালে তিনি একটি গান গেয়েছিলেন। ‘ও দাদাভাই’ শিরোনামের গানটির সুর সলিল চৌধুরীর।
১৯৭২ সালে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে আসে ভারতীয় আরেকটি সাংস্কৃতিক দল। লতা মঙ্গেশকরের দলটি ঢাকায় আগে না পরে এসেছিল, তা জানা সম্ভব হয়নি। ওই দলে ছিলেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়, বরেণ্য শিল্পী শ্যামল মিত্রসহ কয়েকজন। তাঁদেরও দেখা হয় বঙ্গবন্ধুসহ তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে।
বাঙালির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শ্যামল মিত্রকে জানান, তাঁর গাওয়া ‘তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা, কে বলে আজ তুমি নাই, তুমি আছ মন বলে তাই…’ গানটি তাঁর প্রিয়। রাষ্ট্রপিতা বঙ্গবন্ধু বলেন শ্যামল মিত্রকে, গানটির পূর্ণ রূপ দিতে। তাঁর কথা শ্যামল মিত্র গানটির গীতিকারকে জানান। এরপর গানটি পূর্ণ রুপ পায়।
কে জানতো! বঙ্গবন্ধু এমন একটি গানকে পূর্ণ রূপ দিতে বলার মাত্র কয়েক বছর পরই বাঙালি জাতি ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায়ের মুখোমুখি হবে। সেদিন বঙ্গবন্ধুকে পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যসহ ঘাতক, নরপিশাচরা হত্যা করে।
‘তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা’ গানটি ‘অন্তরাল’ সিনেমায় সংযোজিত হয়। সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৬৫ সালে। সিনেমায় শুধু নয়, গানটিই তখন শুধু চার লাইনের ছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সম্মানে পূর্ণতা পায় গানটি। শ্যামল মিত্রের এ গান নানা কালের শ্রোতার কাছে নন্দিত।
মত ও পথের কাছে লতা মঙ্গেশকরের ঢাকায় সফরের স্মৃতিচারণ করেন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গঠিত ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’র অন্যতম সংগঠক সৈয়দ হাসান ইমাম। এ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, অভিনেতা বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর ঢাকার পিলখানায় ভারতীয় সৈন্যদের সম্মানে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেই দলে লতা মঙ্গেশকরও ছিলেন। তিনি পিলখানা মাঠে গান করেন। সুনীল দত্ত, সঞ্জয় দত্ত, মালা সিনহাও ছিলেন সেই দলে।’
তিনি বলেন, ‘আমার দায়িত্ব ছিল ভারতীয় সাংস্কৃতিক দলকে দেখাশোনা করার। আমি লতা মঙ্গেশকরকে এফডিসিতে আমন্ত্রণ জানালাম। তাঁকে এফডিসিতে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তিনি ভারত ফিরে গিয়ে আমাকে একটা চিঠি লেখেন ধন্যবাদ জানিয়ে। চিঠিটা হারিয়ে ফেলেছি। সেদিনের সেই বিকেল এখনও লতার গানের মতোই উজ্জ্বল আমার স্মৃতিকোঠায়।’
কাকতালীয় হলেও সত্য, বঙ্গবন্ধুর তনয়া, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও লতা মঙ্গেশকর- দুজনেরই জন্ম তারিখ ২৮ সেপ্টেম্বর। লতা মঙ্গেশকর জন্মেছিলেন ১৯২৯ সালে। শেখ হাসিনার জন্ম ভারতবর্ষের স্বাধীনতার বছর, ১৯৪৭ সালে।