আমার ‘শিক্ষাবিদ’ হিসেবে একটা আংশিক কিন্তু মুখ-গম্ভীর পরিচয় অনেক সময় আমাকে খুব মুশকিলে ফেলে। আমি তো নিছক শিক্ষাবিদ নই, আমি ১৯৪৭ সালে পূর্ববঙ্গ থেকে ছিটকে এ পারে চলে আসা এক উদ্বাস্তু-বালক, যখন আমার মধ্যে ‘শিক্ষাবিদ’-এর কোনো দূরতম চিহ্নও তৈরি হয়নি। অথচ, এই লেখার জন্য অনুরোধ করার সময়ে যেমন শুনলাম, আমাদের মতো বয়সের লোকেদের এই উপমহাদেশে বড় হওয়ার আখ্যান লতা মঙ্গেশকরের গানের সঙ্গে অনেকটাই জড়িয়ে গিয়েছিল। কথাটা শুনে আমি চমকে উঠে ভাবলাম, তাই তো, কথাটা তো একটা মনোহর সত্য কথা। আমি শিক্ষাবিদ হই আর না হই, আমি আমার দীর্ঘ জীবনে তার গান শুনে মুগ্ধ হওয়ার অনুভূতিকে তো কখনো প্রত্যাখ্যান করিনি, ভুলিওনি। কারণ জীবন মানে তো শুধু বই পড়া নয়, পৃথিবীর রূপরসশব্দগন্ধস্পর্শকে পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে নিজের মধ্যে টেনে নেওয়া। তাতে লতার গানকে বহিষ্করণ করার মতো ছেঁদো পাণ্ডিত্যমুখোশ তৈরি করার ইচ্ছেই হয়নি কখনো। ঐ গানের কাছে রুচির তথাকথিত আভিজাত্য বা উন্নাসিকতা চুরমার হয়ে গেছে। মনে হয়েছে, এমন কণ্ঠের কাছে নতজানু হওয়া যায়। ফিল্মের গান, বিশেষত তখনকার বম্বাই ফিল্মের গান বলে কান ফিরিয়ে থাকার অর্থ হয় না। পরে যখন শিক্ষাবিদের গুরুভার পোশাক আমার গায়ে চাপল, তখনো আমি জনপ্রিয় গানের থেকে ছুটে পালাবার কথা ভাবিনি। মনে পড়ে, রবীন্দ্রভারতীতে একটা ভালো চাকরি পেয়ে আমি শিক্ষকদের সংবর্ধনার উত্তরে ‘মধুমতী’ ছবির ‘সুহানা সফর, ঔর য়ে মৌসম হসি’ গানটি গেয়েছিলাম, তা সংবাদপত্রে টীপ্পনীলাভ করেছিল। তাই লতা মঙ্গেশকরকে নিয়ে কিছু লেখার সুযোগ পেয়ে আমি আজ বর্তে গেলাম। হাতটা নিশপিশ করছিল তো।
আমি বিশেষভাবে এই সাংস্কৃতিক ঘটনার জন্য কৃতজ্ঞ থাকি যে, পশ্চিমের ছবি সাধারণভাবে গানকে বর্জন করে—তারা গানের ছবি আলাদা করে তৈরি করে, কিন্তু ভারত তা করেনি। নীরব চলচ্চিত্রের যুগ শেষ হওয়ামাত্র একেবারে প্রথম থেকেই ভারতীয় সিনেমায় গান এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তাকে আচ্ছন্ন করে থেকেছে। তার একটা কারণ সম্ভবত এই যে, হিন্দি ছবিতে একজন নায়ক আর নায়িকার প্রেম প্রথম থেকেই আখ্যানের ভিত্তি হয়েছে, এবং কে না জানে যে, এ উপমহাদেশের সংস্কৃতিতে প্রেমের প্রাথমিক ভাষা হলো গান! আর একই সঙ্গে কৃতজ্ঞ থাকি নীতীন বসুর কাছে, শুনেছি যাঁর হিন্দি ‘ধুপছাওঁ’ (বাংলা ‘ভাগ্যচক্র’-এর হিন্দি রূপ, ১৯৩৫) ছবিতে, রাইচাঁদ বড়ালের নির্দেশনায় প্রথম সেই মহামূল্য প্রযুক্তির প্রবর্তন ঘটল, যার নাম ‘প্লে ব্যাক’। এই প্লে ব্যাক না হলে আরো অনেকের মতো লতা মঙ্গেশকরকে আমরা এই মহিমময় বিস্তারে পেতাম না। হ্যাঁ, তার ‘নন-ফিল্ম সং’ যাকে বলে তারও নিশ্চয় অনেক নমুনা আছে ৭ হাজার না ১০ হাজার গানের মধ্যে, হিন্দিতে ‘অ্যয় মেরে ওয়াতনকে লোগোঁ’ ছাড়া আর কিছু আমার মনে নেই। তবে বেশ কিছু বাংলা গান অবশ্য মনে আছে, সলিল চৌধুরীর সুরে অসামান্য পুজোর গানগুলি, নিজের আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত। যেমন মহম্মদ রফির ক্ষেত্রে মনে আছে ‘সুনো সুনো ভাই দুনিয়াওয়ালে বাপুজিকি অমর কহানি’ আর দু-একটি নজরুলগীতি। কিন্তু তার উলটোদিকের পাল্লায় তো অসংখ্য ফিল্মের গান আমার কানে আর প্রাণে ঝংকার তুলে চলেছে, শেষ পর্যন্ত তুলতে থাকবে।
১৯৪৭ সালে সীমান্ত পেরিয়ে যখন এ পারে খড়্গপুর শহরে উদ্বাস্তু জীবন আরম্ভ হলো তখন বাঙালিবিরল, মূলত হিন্দিভাষী ঐ রেলকারখানা শহরে হিন্দি বা মুম্বইয়ের ছবি আর তার গান বালকের যাপনে ঝড় তুলল বলা যায়। ঐ শহরে যে কোনো উপলক্ষ্যে মাইক বাজত। জন্ম, অন্নপ্রাশন, বিবাহ, পুজো, ফুটবল বা ক্যারমের প্রতিযোগিতা, এমনকি মৃতু্যশোভাযাত্রা সবকিছুতেই বিপুল উচ্চরবে মাইক্রোফোনে হিন্দি গান বাজানো হতো। দুটি সিনেমা হল, ‘অরোরা’ আর ‘বম্বে টকিজ’, পরে মিলনীতে সিনেমা শুরুর আধঘণ্টা আগে থেকে গান, এবং মূলত হিন্দি সিনেমার গান। তা ছাড়া শহর জুড়ে পানের দোকান (যেখানে গোপনে তরল পানীয় বিক্রি হতো বলে শুনেছি), সেখানে রেডিয়ো বাজত সকাল থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত, তাতে ‘রেডিয়ো সিলোন’ নামে একটা কেন্দ্র সব সময় খোলা থাকত, তাতে নিরবচ্ছিন্নভাবে বাজানো হতো ‘ফিল্মি গানা’। কাজেই ফিল্মের গানকে এড়িয়ে আমাদের জীবনযাত্রা চালানো অসম্ভব ছিল।
আর ১৯৪৭-এই বোধ হয় লতা মঙ্গেশকর এসে খড়্গপুরের সংগীতমুখর বাতাসের দখল নিয়ে নিলেন। বম্বে টকিজ প্রতিষ্ঠানের প্রায় ভৌতিক এক ছবি ‘মহল’ মুক্তি পেল, তাতে দেখা গেল প্রায় প্রৌঢ় অশোককুমারের সঙ্গে অসামান্য এক কিশোরী সুন্দরী মধুবালাকে, সে ছায়ায়, কুয়াশায়, প্রাসাদবাড়ির নানা কক্ষে ঘুরতে ঘুরতে, নায়ককে উদ্ভ্রান্ত করে মিলিয়ে যেতে যেতে খেমচাঁদ প্রকাশের সম্মোহনী দুরে গাইতে লাগল আয়েগা, আয়েগা, আয়েগা আনেওয়ালা’, সে গান ভারতের আবালবৃদ্ধবনিতাকে উন্মাদ করে তুলল। সেই হলো আমাদের জীবনে প্রথম লতা মঙ্গেশকর নামক সুরধারার সম্প্রপাত ঘটল।
এ লেখা তার জীবনীচর্চা নয়, ধারাবাহিক কীর্তিবীক্ষাও নয়। ঐ ‘আয়েগা আনেওয়ালা থেকে শুরু হলো, তার পর শত শত ছবি, শত শত গান আমাদের ভুলিয়ে-দুলিয়ে চলে গেল, তার কতটুকুই-বা আজকের পাঠকের কাছে তুলে ধরতে পারি, এই পঁচাশির দরজায় এসে। প্রথমে মনে পড়ে রাজকাপুরের ছবিগুলির কথা। জানি না, ‘বরসাত’-এর ‘জিয়া বেকরার হ্যয়, তেরা ইন্েতজার হ্যয়’ গানটি তার গাওয়া কি না, সম্ভবত নয়। কিন্তু পরের ছবিগুলোতে তার উপস্হিতি, সুরকার শঙ্কর জয়কিষেনের আমন্ত্রণে তো অনিবার্য হয়ে উঠল। শ্রী৪২০-এ মান্না দের সঙ্গে গাওয়া ‘পিযার হুয়া, একরার হুয়া’, অমিয় চক্রবর্তীর ‘পতিতা’তে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ‘ইয়াদ কিয়া দিল নে কহাঁ হো তুম্’, কোন্ একটা ছবিতে মুকেশের সঙ্গে ‘শাওন কে মাহিনা, পবন করে শোর’, আর এই সেদিন ‘জংলি’ ছবিতে সেই চমত্কার গানটি ‘এহসান তেরা হোগা মুঝপর দিল’, যেটা মুহম্মদ রফিও আলাদা করে গেয়েছিলেন, কিন্তু মনে হয় লতা এখানে অনেক বেশি নম্বর উপার্জন করেছেন।
ডুয়েটগুলির কথা আগে মনে এলো কেন কে জানে। তার একার গানের তো সীমাসংখ্যা নেই। সেই যে ‘আয়েগা আনেওয়ালা দিয়ে শুরু হলো, তার পরে সি রামচন্দ্রের সুর ‘আনারকলি’র গান, ভি শান্তারামের ‘অমর ভূপালি’ ছবিতে অজস্র গান, ‘নাগিন’-এ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (থুড়ি, হেমন্ত্ কুমারের) ‘মন দোলে, মেরা তন দোলে’ গানটি গেয়ে ত্রিভুবন মাতিয়ে দেওয়া, এবং ‘মধুমতী’তে সেই অসাধারণ ‘আজা রে পরদেশি, ম্যয় তো কব্ সে খড়ি ইসপার, এ আঁখিয়া থক গয়ে পন্থ নিহার’¦যাতে সলিল চৌধুরী ওই ছবিরই আর-একটি গানের (লতারই ‘ঘড়ি ঘড়ি মেরা দিল্, ধড়কে, কিঁউ ধড়কে’¦আসলে কলকাতা রেডিয়োর জন্য সলিলদার তৈরি রম্যগীতি ‘হলুদ গাঁদার ফুল দে এনে দে’র সুর ব্যবহার করেছিলেন ইন্টারলিউড হিসেব। আরো কত গান, কত গান! সেই যে ‘একদিন রাত্রে’ সলিল চৌধুরী সরল ভৈরোঁর সরগমের ওপর ‘জাগো, মোহন প্যারে’ (বাংলায় ‘জাগো, মোহন প্রীতম’) গানটি তৈরি করেছিলেন, তার সম্মোহন আজও কাটাতে পারলাম কোথায়। কোন ছবিতে মনে নেই, ‘রহে না রহে হম্’ বলে একটা অসাধারণ গান শুনেছিলাম, তার সুরের উত্থান-পতন কেমন মন কেড়ে নিয়েছিল।
‘জাগো, মোহন প্রীতম’ গানটার কথায় আমার ছাত্রী সর্বাণীর (প্রখ্যাত লেখক আশুতোষ মুখোপাধ্যাযের কন্য) পোস্টটির কথা মনে পড়ল। সদাশয় মানুষ আশুবাবুর পুত্রটি, জয়, ছিল জড়বুদ্ধি। সে সকালে দেরিতে উঠত। এই রকম একটি দিনে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় লতা মঙ্গেশকরকে নিয়ে আশুদার বাড়িতে গেছেন, জয় তখনো ঘুমোচ্ছে দেখে লতা ঐ ‘জাগো মোহন প্রীতম’ গানটি ধরলেন হঠাত্, জয় মহাবিস্ময়ে ধড়ফড় করে উঠে পড়ল। কার এমন সৌভাগ্য হয় যে, স্বয়ং সুরের সম্রাজ্ঞীর গানে তার ঘুম ভাঙে !
লতার বাংলা গানগুলি কি বাঙালি ভুলতে পারবে কোনো দিন? দুটি একক রবীন্দ্রসংগীত, ‘শাঙন গগনে’ আর ‘হূদয় আমার নাচে রে’, আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দুটি রবীন্দ্রসংগীত ‘তোমার হল শুরু’ আর ‘মধু গন্ধে ভরা’ তো আছেই। কিন্তু সলিল চৌধুরীর সুরে অজস্র পুজোর গান, সেদিনকার ‘সাত ভাই চম্পা জাগো রে’ পর্যন্ত যে সাংস্কৃতিক সম্পদ তৈরি করেছে, তাতে বাঙালির তার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকা উচিত। শুধু সলিল চৌধুরী কেন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে অজস্র গান (‘ও বাঁশিতে ডাকে যে’), সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুরে ‘আকাশ প্রদীপ জ্বলে দূরের তারার পানে চেয়ে’, শচীন কর্তার রাহুলের সুরে আজস্র হিন্দি ছবির গান ছাড়াও বাংলা ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই, ও যে ডাকাতিয়া বাঁশি’, এসব অন্তহীন সুরলহরি কি বাঙালি কখনো ভুলতে পারবে?
এই ভাবেই এক সংস্কৃতির মানুষ অন্য সংস্কৃতির আপনজন হয়ে ওঠে, ভূগোল আর ভাষার বেড়া ভেঙে, জাতি গোষ্ঠী ধর্ম আর বিশ্বাসের গণ্ডি পার হয়ে, শিল্পের অমোঘ টানে মানুষ মানুষের আপন হয়ে ওঠে। সেদিনকার মহারাষ্ট্রের সেই কিশোরীটি কালক্রমে সারা ভারতের, তা কেন, এই মহাদেশের বা তারও সীমানা পেরিয়ে অর্ধেক পৃথিবীর হূদয়প্রতিমা হয়ে উঠেছিল। সে চলে গেল, কিন্তু তার গান, পৃথিবীর বিপুল ঐশ্বর্য সে রেখে গেল আমাদের জন্য।
লেখক : পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ