ঢাকায় মেট্টোরেল প্রকল্পের কাজের প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে ধরা পড়লো ‘মারাত্মক ভুল’। ‘ভুলটি’ ধরতে কর্তৃপক্ষের এক দশক সময় কেটে গেছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরুর আট বছর পর এ ‘অসংগতি’ নজরে পড়েছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনসহ (ডিএনসিসি) সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। এতে প্রকল্পে বাড়তি খরচ যোগ হচ্ছে।
অন্যান্য দেশে মেট্টোরেলের সিঁড়ি ফুটপাতে স্থাপন করা হয় না। ঢাকায় মেট্টোরেলের সিঁড়ি ফুটপাতে রাখার পরিকল্পনা নিয়ে প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে ‘জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা’ (জাইকা) ২০১১ সালে এ বিষয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করে সমীক্ষার মাধ্যমে। এতে মেট্রো স্টেশনের সিঁড়িগুলো রাখা হয় ফুটপাতের ওপর। যা পরে মূল নকশায় অন্তর্ভুক্ত হয়। ওই সমীক্ষা পরিচালিত হয় দশ বছর আগে।
ফুটপাতে সিঁড়ি থাকলে চলাচলের পথ সরু হয়ে আসা, কোথাও কোথাও চলাচল দুঃসাধ্য হয়ে ওঠার বিষয়গুলো কর্তৃপক্ষের কারো মাথায় আসেনি। এতোদিন পর এসে ‘অসংগতি’ নিয়ে ডিএনসিসির ‘আপত্তি’ ও ঢাকার সচেতন বাসিন্দাদের সমালোচনায় প্রকল্পের নীতিনির্ধারকরা জমি অধিগ্রহণ করে পথচারীর চলাচলের ‘বিকল্প চিন্তা’ করছেন। এ প্রক্রিয়ায় ‘জটিলতা’ থাকায় সেটা করতে গেলে প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হয় কী না, এমন প্রশ্ন সামনে আসছে।
দেশের প্রথম মেট্টোরেল ঢাকায় নির্মাণ হচ্ছে সম্পূর্ণ উড়ালপথে (এলিভেটেড)। ট্রেনে ওঠা-নামার স্টেশনগুলোও উড়ালপথে। ট্টেন চলাচল করবে উড়ালপথ ও স্টেশনের নিচে। স্টেশনের দ্বিতীয় তলায় থাকবে টিকিট কাউন্টার। ওঠা-নামার জন্য থাকছে সিঁড়ি, লিফট আর চলন্ত সিঁড়ি। নকশা অনুযায়ী সিঁড়ি নির্মাণ হচ্ছে ফুটপাতে, সেখানে তিনতলা সমান উঁচু স্টেশন থেকে সিঁড়ি নামবে। ট্রেনে ওঠার একমাত্র পথ স্টেশন ভবন। এতে ফুটপাতের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ জায়গা সিঁড়ির দখলে চলে যাচ্ছে। ওই ফুটপাতে একজনের বেশি চলাফেরা করা দায়।
৫ ও ৬ নম্বর স্টেশনের সিঁড়ি (ল্যান্ডিং) ফুটপাতের ওপর হওয়ায় গত ২০ ফেব্রুয়ারি ‘আপত্তি’ তোলেন ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম। সিঁড়ির বিষয়ে ‘বিকল্প চিন্তার’ পরামর্শ দিয়ে ওই দিন সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘ফুটপাতে সেগুলো থাকলে উচ্চ ঝুঁকির আশঙ্কা থাকে।’
শুরুতে কেন ডিএনসিসি বিষয়টি নিয়ে ‘আপত্তি’ করেনি- এমন প্রশ্নে তিনি মত ও পথকে বলেন, ‘ডিএনসিসি শুরু থেকে বলে আসছে ফুটপাতে মেট্টোরেলের সিঁড়ি থাকলে পথচারীদের চলাচল বিঘ্নিত হবে। এমন কোনো অবকাঠামো তৈরি করা যাবে না। আমরা নতুন করে কিছু বলছি না।’
পরিবহন বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হক মেট্টোরেল প্রকল্পের শুরু থেকে পরিকল্পনা, সমীক্ষা ও নির্মাণকাজ পর্যবেক্ষণের সঙ্গে যুক্ত আছেন। যোগাযোগ করলে বিষয়টিকে ‘মারাত্মক ভুল’ অ্যাখ্যায়িত করে তিনি মত ও পথকে বলেন, ‘ফুটপাতে সিঁড়ি নির্মাণের বিষয়টি নিয়ে শুরু থেকে আপত্তি জানিয়ে আসছি। এর বদলে জমি অধিগ্রহণ করে সিঁড়ি, ফুটপাত আলাদা করার পরামর্শ দিয়েছি। কর্তৃপক্ষ বিষয়টিতে গুরুত্ব দেয়নি।’
সরেজমিন গেলে দেখা যায়, ঢাকার মিরপুর-১০ নম্বর, পল্লবী, মিরপুর-১১, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া ও আগারগাঁওয়ে ফুটপাতে মেট্টোরেলে ওঠা-নামার সিঁড়ির ‘জটিলতা’ রয়েছে। সরকারের অগ্রাধিকারের এ প্রকল্পে স্টেশন থাকছে মোট ১৭টি। শুরুর ‘গলদটি’ এতোদিনে ‘ধরা পড়ায়’ সরকারি জমি অধিগ্রহণ করে বিকল্প পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে।
জমি অধিগ্রহণের কাজটি করছে ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। সেখানে খোঁজ নিলে জানা যায়, কোথাও জমি মিলছে, কোথাও মিলছে না। এ নিয়ে ‘হোঁচট’ খেতে হচ্ছে। শেওড়াপাড়া স্টেশনের পাশে ১৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ জমি অধিগ্রহণের অনুমতি পাওয়া গেছে। ওই স্টেশনের আশপাশে সরকারি জমি নেই। মিরপুর-১০ ও আগারগাঁও এলাকায় আছে সরকারি জমি। আগারগাঁওয়ে গণপূর্তের ১০৯৪, বিমানবাহিনীর ৫৯৬, মিরপুর-১০ নম্বর সেকশনের স্টেশনের পাশে ডিএনসিসির আঞ্চলিক কার্যালয়ের ১২০ এবং ফায়ার সার্ভিসের ২৪৩ বর্গমিটার জমি ব্যবহারের অনাপত্তি চাওয়া হয়েছে।
প্রকল্পের নথি ঘেঁটে পাওয়া তথ্য বলছে, মেট্রোরেল দিয়ে ৩৫ মিনিটে ঢাকার উত্তরা থেকে মতিঝিলে যাওয়া যাবে। শুরুতে দৈনিক চার লাখ ৮৩ হাজার যাত্রী যাতায়াত করতে পারবেন। উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ দশমিক ১ কিলোমিটার মেট্রোরেলের দিয়াবাড়ী-আগারগাঁও অংশ চলতি বছর ডিসেম্বরে চালু হবে।২০১২ সালে অনুমোদিত এমআরটি-৬ প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৬ সালে, ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণ করে।
এরই মধ্যে প্রকল্প ব্যয় ১১ হাজার ৪৮৭ কোটি বাড়িয়ে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা করার প্রস্তাব করা হয়। পাশাপাশি মেয়াদও এক বছর বাড়িয়ে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়।যানজটমুক্ত রাজধানীর স্বপ্নবাহন মেট্রোরেল। তা চালু হলে নগর পরিবহনের নতুন যুগে প্রবেশ করবে ঢাকা।