ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম পত্রিকা ‘বেঙ্গল গেজেট’ থেকে শুরু করে সবশেষ প্রকাশিত পত্রিকা, টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকরা কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতাবানদের কটূক্তির শিকার হয়েছেন। মামলা-টামলা, হামলা, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কবলে পড়েছেন। তবে ফুটবল ফেডারেশনে বছরের পর বছর ধরে নিকৃষ্টতম কায়দায় সভাপতির পদ দখলে রাখা কাজী সালাউদ্দিনের মতো সাংবাদিকদের মা-বাবাকে নিয়ে এমন নিম্নরুচির মন্তব্য কেউ আজ পর্যন্ত করেননি। তার মতো মনুষ্যত্বহীন দ্বিতীয় কেউ এ অঞ্চলে জন্ম নেয়ার দরকার আছে বলে হয়তো স্রষ্টা মনে করেননি। কোনো নারী-পুরুষ বিবাহিত জীবনে যখন সন্তান জন্ম দেয়ার পরিকল্পনা করেন, তখন অনাগত সন্তানের মুখ, ভবিষ্যৎ চরিত্র, রুচির কোনো ছবি দেখেন না।
সন্তান বড় হয়ে সালাউদ্দিনের মতো অন্যের বাবা-মাকে ‘গরিব’ হওয়ার দায়ে ‘অপমান’ করবেন, জুতা পরে ছবি তুলতে না পারার দারিদ্র্যকে ‘ঠাট্টা’ করবেন, এটা আগেভাগে জানতে পারলে এ দেশের যে কোনো নারী-পুরুষ সন্তান জন্মানোর কাজটার সময় সতর্ক হতেন। এমন সন্তান জন্ম দিতে অনাগ্রহী হতেন তারা। সালাউদ্দিনের অনুষ্ঠানে যেতে ‘সাংবাদিকদের বাবা-মায়ের জুতা পরা ছবি লাগবে’ বলে মন্তব্যের অর্থ হচ্ছে- সাংবাদিকরা ‘অতি গরিব শ্রেণির পরিবার’ থেকে উঠে আসেন। তাদের বাবা-মা গরিব হওয়ায় জুতা পরার সামর্থ্য রাখেন না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিব, লাল মওলানা ভাসানীও সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁরা ‘রাজনৈতিক সাংবাদিকতা’ করতেন। তাঁদের কারো জন্মই নবাব, খাজা পরিবারে নয়।
কবি ও গণসাংবাদিকতায় আরেক পথিকৃৎ কাজী নজরুলের বাবা-মা ছিলেন হতদরিদ্র। আওয়ামী লীগের টানা তিনবারের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও একসময় পুরোদস্তুর সাংবাদিক ছিলেন। তাঁর জন্মও বনেদি পরিবারে নয়। বাস্তববাদী সমাজতান্ত্রিক সাহিত্যের প্রতিষ্ঠাতা ম্যাক্সিম গোর্কির দাদি একসময় ভিক্ষা করতেন। গোর্কি কয়েকমুঠো ভাতের জন্য ছোটবেলায় জুতার দোকানে কাজ করেছেন, চুরিও (যা তখন অপরাধ ছিলো না ওই সমাজে) করেন। মার্কসবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের জন্মও কা. সালাউদ্দিনের ইঙ্গিতের ‘ছোট পরিবারে’। মেধা, প্রতিভা, শ্রমের মধ্য দিয়ে মানুষ নন্দিত হয়ে উঠেন। পরিবার, বাবা-মায়ের আর্থিক অবস্থার বিচারে শ্রদ্ধাপূর্ণ খ্যাতির আসনে মানুষের ঠাঁই হয় না। তা বোঝার বুদ্ধি নিয়ে সালাউদ্দিন জন্মেছেন কী না, এটাও প্রশ্ন।
ভাষাগানের রচয়িতা আবদুল গাফফার চৌধুরী বলেছিলেন, একশ্রেণির রাজনীতিক, ক্ষমতাবান পেশাজীবী যে ভাষায় কথা বলেন, সাংবাদিকরা হুবহু তা তুলে ধরলে পাঠক, দর্শক তাদেরকে চরম অশিক্ষিত মনে করতেন। তারা শুদ্ধ বাংলা জানেন না, ভালোমতো কথা বলাও শেখেননি। কা. সালাউদ্দিন ওই শ্রেণিরই অন্তর্ভুক্ত। তার মতো একটা লোকের সাংবাদিকদের মা-বাবার অপমানকে আবার অনেক সাংবাদিক গায়ে মাখছেন না। তারা মনে করছেন, সালাউদ্দিন তাদের বাবা-মাকে অপমান করেছেন, তাদেরকে তো নয়। বর্বর বক্তব্যের জন্য সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে যতোটা প্রতিবাদ হওয়ার দরকার ছিলো, ততোটা হচ্ছে না তাদের জন্যেও। তারা সালাউদ্দিনের ‘প্যাকেট সাংবাদিক’।
ম্যাক্সিম গোর্কির কথা ধার করে বলা যায়, ‘সংসার হলো অন্ধকার রাত। এখানে প্রত্যেক মানুষকে নিজ হাতে আলো জ্বালাতে হয়।’ কে কোন পরিবারে জন্মেছেন, এটা দিয়ে কাউকে বিচার করতে যাওয়ার প্রবণতা হিংস্র পশুদেরও নেই, শুভবোধের কোনো মানুষের মধ্যে সেটা থাকতে পারে না। সালাউদ্দিনেরও জন্ম একটা সাধারণ পরিবারেই, যদিও এটা তার অপরাধ নয়। এ দেশের সাংবাদিকতায় অনেকেই এসেছেন অভিজাত পরিবার থেকে, কা. সালাউদ্দিনরা না জানলেও সেটা ধ্রুব সত্য।
হাসান শান্তনু: সাংবাদিক ও গণমাধ্যম গবেষক।